পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

By

Published : Jan 5, 2020, 4:20 AM IST

Updated : Jan 5, 2020, 10:10 AM IST

ETV Bharat / bharat

সুলেমানি নিহতের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিতে গেলে বিপাকে পড়তে পারে ভারত

ইরানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক । বর্তমানে অ্যামেরিকার কাছে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশ হল ভারত । কূটনীতির ক্ষেত্রে দিল্লি কখনও ওয়াশিংটন ও তেহরানকে চটাতে চাইবে না । দুটো দেশই তার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । তাই সুলেমানির মৃত্যুর ঘটনায় ভারত ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেবে তা দিল্লির কাছে একটা বড় সমস্যা।

Qasem Soleimani
ছবি

দিল্লি, 5 জানুয়ারি : ড্রোন হামলায় শুক্রবার ভোরে ইরানের সেনা কমান্ডার জেনেরাল কাসেম সুলেমানি (62) নিহত হন । অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই এই হামলা বলে জানা গেছে । ইরানের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুলেমানির মৃত্যুর বদলা যে সে দেশের সরকার নেবে, তা বলাবাহুল্য । 22 বছর আগে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের (IRGC) শাখা আল-কুদসের কমান্ডার হন সুলেমানি । তারপর থেকেই তাঁর উপর একাধিক হামলা হয় । কিন্তু প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন । তাই তাঁর যে এভাবে মৃত্যু হবে, তা ইরান সরকার ও সুলেমানি নিজেও কখনও ভাবতে পারেনি । সুলেমানি ভাবতেন তাঁর শত্রুরা যতই চেষ্টা করুক না কেন, তাঁকে মারতে পারবে না । এমনকি অপারেশন ডেজ়ার্ট স্টর্মের মাধ্যমে ইরাক দখল করার পরও সুলেমানির উপর হামলা চালায়নি অ্যামেরিকা । তাই অ্যামেরিকা ঠিক কী কারণে সুলেমানির উপর হামলা চালাল, তা জানতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে । তবে এটা স্পষ্ট যে, সুলেমানির মৃত্যুর ঘটনার প্রভাব পড়বে ইরানের সঙ্গে ভারত সহ একাধিক দেশের সম্পর্কের উপর ।

ইরানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক । ইরানের নানা ক্ষেত্রে ভারতের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সে দেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশে মাকরান উপকূলে ছাবাহার বন্দর শহর । এখানে সমুদ্র বন্দরের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ভারত মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে । কিন্তু বর্তমানে অ্যামেরিকার কাছে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশ হল ভারত । তাই সুলেমানির মৃত্যুর ঘটনায় ভারত ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেবে তা দিল্লির কাছে একটা বড় সমস্যা । কারণ কূটনীতির ক্ষেত্রে দিল্লি কখনও ওয়াশিংটন ও তেহরানকে চটাতে চাইবে না । কারণ দুটো দেশই তার কাছে কূটনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । তাই সুলেমানির মৃত্যু নিয়ে ভারত এখনও পর্যন্ত অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে কোনও নিন্দাসূচক বিবৃতি দেয়নি । এটা ওয়াশিংটনকে খুশি করলেও তেহরানকে যে খুশি করেনি তা বলাবাহুল্য । যদিও তেহরান ছাবারে শাহিদ বেহেস্তি বন্দর পরিচালনার জন্য ভারতকে 10 বছরের অনুমতি দিয়েছে । ইরানের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের গদরে বালুচ বন্দরের পরিকাঠামো উন্নতির জন্য চিন প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে । ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শাহিদ বেহেস্তি বন্দরেও চিন বিনিয়োগের চেষ্টা করেছিল । কিন্তু ইরান চিনকে বাদ দিয়ে সেখানে ভারতকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় । এর পিছনে অবশ্য ইরানের নিজস্ব কিছু স্বার্থ রয়েছে । ইরানের ওমান সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এই বন্দরটিতে বিনিয়োগ হল ভারতের প্রথম দেশের বাইরে কোনও বন্দরে বিনিয়োগ । এই বন্দর ভারতকে সাহায্য করবে পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ তৈরি করতে ।

ছাবার উষ্ণ সমুদ্র বন্দর । বিশ্বের অনেক দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি দখল করতে চেয়েছিল । একসময় রাশিয়াও জারের আমল থেকে এই বন্দরটিকে নিজেদের দখলে আনতে চেয়েছিল । আল-বেরুনির লেখাতেও এই বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় । তাই ভারতও স্বাভাবিকভাবেই এই বন্দরে বিনিয়োগের চেষ্টা করছিল দীর্ঘদিন ধরে । এই লেখক একবার ছাবার গিয়েছিলেন । সেখানে তিনি দেখেন অনেকেই হিন্দুস্থানি ভাষায় কথা বলছেন । লেখক এটাও লক্ষ্য করেন যে, স্থানীয় বাসিন্দারা ভারতের এই বিনিয়োগে যথেষ্ট খুশি । ইরানের কূটনীতিকরা বরাবরই স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, ছাবার এলাকার কাছেই পাকিস্তানের সীমান্ত । এই পরিস্থিতিতে ছাবার এলাকায় ভারতের উপস্থিতি তাদের অনেকটা নিশ্চিন্ত করবে । ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য এই ছাবার এলাকা থেকেই কুলভূষণ যাদবকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান ।

ছাবার প্রকল্পের দুটি ভাগ রয়েছে । একটি হল, বন্দর এবং অন্যটি সড়ক ও রেল যোগাযোগ যার সাহায্যে এই বন্দর শহরটি ইরান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যুক্ত । ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোওহিনি এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি 2016 সালে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন । এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই আশা করে যে, P5+1 দেশগুলি তেহরানকে বৈদেশিক বাণিজ্যে সাহায্য করবে । কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই চুক্তি থেকে অ্যামেরিকা সরে এল এবং ইরানের উপর নানা বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ আরোপ করল । বৈদেশিক ব্যাঙ্কগুলি ইরানে কোনও কাজের জন্য ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিল । আর তার জেরে ছাবরা বন্দরে ভারতের বিনিয়োগও আটকে গেল । বন্দরের পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও সেখানে রেলপথ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেল । ভারতকে এখন প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় যে, তেহরানের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অ্যামেরিকা কী চোখে দেখছে । পরবর্তীতে ছাবার বন্দর অ্যামেরিকার বিধিনিষেধের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল । কারণ আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের জন্য এই বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । কিন্তু তাতেও ভারতের সমস্যা মিটল না । সপ্তাহখানেক আগে ওয়াশিংটনে অ্যামেরিকা ও ভারতের মধ্যে টু প্লাস টু বৈঠকে এই বিষয়ে বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর কিছু লিখিত প্রতিশ্রুতি অ্যামেরিকার কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছেন । যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত প্রায় 85 মিলিয়ন ডলারের সরঞ্জাম কিনতে পারবে । ভারতও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আরও কিছু বন্দরকে ছাবারের সঙ্গে যুক্ত করা হবে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য ।

শুক্রবার সকালে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই হামলা হয় । নিহত হন সুলেমানি । তার ফলে প্রতিটি চুক্তি ও সমঝোতা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়ে । ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খামেইনি জানিয়েছেন, সুলেমানির মৃত্যুর উপযুক্ত বদলা নেওয়া হবে । তারপর সুলেমানির মৃত্যুর ঘটনায় ভারত কী প্রতিক্রিয়া দেবে তা কেউ জানে না । সুলেমানি ইরানে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন । তাঁর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে ফলোয়ারের সংখ্যাও যথেষ্ট । ইরাক ও সিরিয়া সহ একাধিক এলাকায় ISIS জঙ্গিদের দমন করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল । ওয়াকিবহাল মহল এটাও বলছে যে, ইরাকে ISIS জঙ্গিদের দমনে ও আফগানিস্তানে তালিবানদের দমনে সুলেইমানি অ্যামেরিকাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন । ভারতের গুপ্তচর সংস্থার একাধিক প্রাক্তন কর্মী জানিয়েছেন, তাঁরা অনেকেই সুলেমানির সঙ্গে একসময় কাজ করেছেন । তাঁরা এটাও জানিয়েছেন যে, আফগানিস্তানে সুলেমানি যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন একসময় । স্মৃতিচারণে তাঁরা বলছেন, সুলেইমানি বেশি কথা বলতেন না, তার বদলে তিনি অপরপক্ষের কথা বেশি শুনতেন । তিনি ভারত সফরেও কয়েকবার এসেছিলেন । কিন্তু এখন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন যে, সুলেইমানি না কি দিল্লিতে নাশকতামূলক কাজে জড়িত ছিলেন । দিল্লিতে এখনও পর্যন্ত যতগুলি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে একটি ক্ষেত্রেই ইরানের বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছিল । সেটা হল দিল্লিতে ইজ়রায়েল দূতাবাসের এক কূটনীতিকের উপর হামলা । সেই ঘটনায় এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । ট্রাম্প চান ভারত ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করুক । তিনি চান ভারত এই ইশুতে কোন দিকে রয়েছে তা স্পষ্ট করুক । আর সুলেমানির মৃত্যুর পর ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যা বলেছেন, তা যদি সত্যি হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তবে ছাবার বন্দর এলাকায় ভারতের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে ।

Last Updated : Jan 5, 2020, 10:10 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details