স্বনির্ভরতা সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধির ভাবনা ছিল সাধারণ জীবনযাপন করা এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে থাকা ৷ এই ধারণার মূল ভিত্তি ছিল যে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করা এবং যতটা সম্ভব স্থানীয় প্রয়োজনের জন্য পণ্য উৎপাদনে স্থানীয় কাজের লোকদের ব্যবহার করা ৷ বাইরের বিশ্বের উপর ন্যূনতম নির্ভর করে এই কাজ করা ৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ (স্বনির্ভর ভারত) গড়ার এই ডাক এই ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না ৷ কারণ, এর সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন (বিশেষ করে মধ্য ও উচ্চবিত্তদের জন্য) এবং স্বয়ং সম্পূর্ণতাকে মেলানো যাচ্ছে না ৷ কোরোনা ভাইরাস (COVID-19) প্যানডেমিকের বিরুদ্ধে সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং কড়া লকডাউনের পর সম্প্রতি যে ছাড় এবং ত্রাণ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা পুরোটা অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করার জন্য ৷ কিন্তু এই পদ্ধতি আমাদের গান্ধিজির স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে বেঁচে থাকার নীতি থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে ৷
গত দুই মাসে COVID-19 আমাদের দেখিয়েছে যে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি কীভাবে একে অপরের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত ৷ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তুলনায় বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক বেশি ভেন্টিলেটর, চিকিৎসক এবং শয্যা রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও প্যানডেমিকের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাই সামলে দিল ৷ অথচ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ঠিক মতো অর্থ সাহায্য পায় না এবং অবহেলিত হয়ে আসছে ৷ এই রকম একটি মানবিক সংকটের সময় বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে হয় তাদের রোগীদের থেকে নিরাপদ ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে দেখা গেল অথবা নিজেদের লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে দেখা গেল ৷
দুই মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে ৷ বিভিন্ন জায়গায় এর মাত্রা ছিল বিভিন্ন রকম ৷ এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করতে সরকারের এই সিদ্ধান্তে কার্যকারিতা সম্পূর্ণ হয়নি সরকারি উদ্যোগের অভাবে ৷ এই ব্যাঘাতের ফলে অর্থনীতি অস্থির পরিস্থিতিতে পৌঁছে গিয়েছে ৷ ব্যবসা এবং শিল্প ব্যর্থ হচ্ছে । বেকারত্ব, খিদের জ্বালা এবং নিঃসঙ্গতা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে ৷ এই সমস্যার মোকাবিলায় যেহেতু এখনও স্পষ্ট কোনও সমাধান আসেনি ৷ তাই অনেকেই এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ৷ এই ঘটনাই বর্ণনা দিল যে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থিতিস্থাপক অর্থনীতির জন্য কতটা শক্তিশালী ও সমান দক্ষ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রয়োজন ৷
এই সংকটের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বাস্তব সম্মত উপায়ে লড়াই করতে গেলে আমাদের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন করা প্রয়োজন ৷ আমাদের এমন একটা আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যেখানে ধন এবং সম্পদ সমানভাবে সকল মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যায় ৷ সব সময় যাতে তাঁরা সুরক্ষিত এবং উন্নত জীবনযাপন করতে পারে ৷ এমনকী, সংকটের সময়ও তা যাতে বজায় থাকে ৷ আমাদের এমন একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সামাজিক এবং আর্থিক ভেদাভেদ সরিয়ে সকলের জন্য উন্নতমানের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যায় ৷ এই দুইটির জন্যই প্রয়োজন আপাত সাম্য-নীতি প্রণয়ন করা এবং পুঁজিবাদী মনোভাবকে দূরে সরিয়ে দেওয়া ৷ কারণ, এগুলি থাকলে মানবতা সংকটেও মানুষের থেকে বেশি লাভের চিন্তা করা হয় ৷
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সরকার 8100 কোটি টাকার পরিকল্পনা করেছে ৷ এর মধ্যে বেসরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগও আছে ৷ যা হাসপাতাল ও স্কুলের মতো সামাজিক পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ হবে ৷ এটা যথেষ্ট বিদ্রূপজনক ৷ প্রতিরক্ষা, শক্তি, মহাকাশ এবং কয়লা ও খননের ক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য দরজা আরও বিস্তৃতভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে । অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকার পরিচালিত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সংস্থা ৷ গত বছর সেখানকার কর্মচারীদের ধর্মঘটের পর ওই সংস্থা বেসরকারি করণের প্রচেষ্টা স্থগিত করেছিল সরকার ৷ কিন্তু সরকার সম্প্রতি অর্থনৈতিক উদ্দীপক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ওই সংস্থাকে কর্পোরেটের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার আরও বিনিয়োগ টানতে এবং লকডাউনের সময় হওয়া লোকসান পুনরুদ্ধার করার আশায় শ্রম অধিকার আইন স্থগিত করার পদক্ষেপ করেছে । স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে NITI আয়োগ রাজ্যগুলিকে PPP মডেলে মেডিকেল কলেজ স্থাপন এবং বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জেলা হাসপাতালগুলির পরিষেবার মান বৃদ্ধি করার কথা বলেছে ৷ এমন একটি পদক্ষেপ যা কয়েক মাস আগে প্রথমবার প্রস্তাব করার পরও সমালোচিত হয়েছিল ।
চারদিকের অযৌক্তিকতা যুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অর্থনৈতিক উদ্দীপক প্যাকেজকে তাঁর "আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের" অংশ হিসাবে বর্ণনা করেছেন । আত্মনির্ভরতার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কী ধরনের কল্পনা শক্তি তাঁকে প্রতিরক্ষা উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (FDI) সীমা 49 শতাংশ থেকে 74 শতাংশে বৃদ্ধি করার অনুমতি দিল, সেটা এখনও স্পষ্ট নয় । প্রাক্তন স্বাস্থ্য সচিব কে সুজাতা রাও, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধাগুলিকে আরও বেসরকারি করণের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য NITI আয়োগকে উদ্দেশ করে একটি টুইট করেছেন ৷ তাতে তিনি প্রশ্ন করেছেন যে আত্মনির্ভর ভারতের সংজ্ঞা সরকারের কাছে ঠিক কী ? কারণ, "আমাদের দেওয়া করের টাকায় সরকারি হাসপাতালগুলিকে বেসরকারি হাতে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে" ৷ আর তাই তাদের "জেগে ওঠা উচিত" এবং "জানালার বাইরে দেখা উচিত" ৷
সরকার এই সংকট থেকে স্পষ্টভাবে কিছুই শিখেনি এবং যথারীতি আগের মতো সব কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা আগ্রহী । প্রকৃতপক্ষে, পুঁজিবাদী লবির পুরোপুরি সমর্থন এবং উৎসাহকে সঙ্গী করে সাধারণ সময়ে যতটা সম্ভব হতে পারত, তার চেয়ে বেশি আপাত-সাম্য অর্থনৈতিক নীতি কার্যকর করা হচ্ছে এই সংকটের সুযোগ নিয়ে ৷
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা আসলে বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনৈতিক নীতির একটি অংশ ৷ সরাসরি ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হলেও এই অব্যবস্থাপনা এবং সংবেদনশীলতাহীন প্রতিক্রিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ৷ এর একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ হল ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকরা কীভাবে রাস্তা ধরে বা আরও খারাপ অবস্থায় রেলপথের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে বেপরোয়াভাবে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন৷ এর কারণ হল, তাঁদের না ছাড়তে সরকারের উপর বেসরকারি শিল্পগুলির তরফ থেকে চাপ ছিল ৷ বিপরীত শক্তি ও প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত এই ধরনের অমানবিক আদর্শ, যা এই বর্তমান সংকটের সময় নির্দয় সত্য হিসেবে প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক সতর্কতার বার্তা দিচ্ছে ৷