পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

বিদ্যুৎ বণ্টনক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তুতি কেন্দ্রের - electricity

আগামী পাঁচ বছরে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, তার অন্তত 40 শতাংশই যাতে পরিবেশবান্ধব এবং পুর্ননবীকরণযোগ্য শক্তিসম্পদের উৎস থেকে হয়, তেমনই পরিকল্পনা করা হচ্ছে ।

electricity distribution in india
বিদ্যুতের বন্টন নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত

By

Published : Mar 17, 2020, 11:25 PM IST

দেশের বিদ্যুৎখাতে বড় সড় সংস্কার সাধনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্র । বণ্টন ব্যবস্থায় লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বাজেটে 22 হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন বিদ্যুৎ এবং বিকল্প শক্তি সম্পদের উৎস খাতে । পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাশা পূরণের জন্য পরিকাঠামো খাতে বিনিয়োগ আনতে হবে । মোদি ঘোষণা করেছিলেন যে, পরবর্তী পাঁচ বছরে 100 লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে পরিকাঠামো উন্নয়নে । সেই দিশায় হেঁটে ওয়ার্কিং কমিটি ইতিমধ্যেই একটি সামগ্রিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ৷ যেখানে পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে 102 লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে । আশা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত তিন লাখ কোটি টাকা চূড়ান্ত ব্যয় তালিকার সঙ্গে যুক্ত হবে । এর মধ্যে 24 শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ।

যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই বিদ্যুৎ অপরিহার্য । ভারত, যেখানে একসময় বিদ্যুতের অপ্রতুলতা বড় সমস্যার কারণ ছিল, বর্তমানে এমন স্থানে এসে পৌঁছেছে যে, আজ এখান থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হয় । রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে যে যখন দেশে ক্ষমতায় এসেছে, এই স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করেছে । এটা মোদি সরকারের অসাধারণ কৃতিত্ব যে, তারা গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে । সৌভাগ্য প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বাড়িতে বিদু্ৎ এসেছে । কিন্তু এখনও এমন অনেক গ্রাম এবং বসতি আছে, যেখানে বিদ্যুতের যোগান পর্যাপ্ত নয় । এই বিষয়ে ভারত বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির থেকে পিছিয়েও আছে । আর এই কারণেই এই খাতকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতেই 25 লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে । পুর্ননবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । আগামী পাঁচ বছরে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, তার অন্তত 40 শতাংশই যাতে পরিবেশবান্ধব এবং পুর্ননবীকরণযোগ্য শক্তিসম্পদের উৎস থেকে হয়, তেমনই পরিকল্পনা করা হচ্ছে । এই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করতে বিদেশি বিনিয়োগকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে । এখনও পর্যন্ত উৎপন্ন বিদ্যুতের 47 শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে আসে । কিন্তু এই খাতে বর্তমানে নানা রকম চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে । বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি সংকটাপন্ন । প্রথমত, কয়লার যোগান ঘিরে সমস্যায় পড়ছে পুরাতন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি । দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থাগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির বকেয়া মেটাচ্ছে না । তৃতীয়ত, সমানুপাতিক হারে যোগানের জন্য কোনও চাহিদা নেই । বিদ্যুতের যোগানে ঘাটতি গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বদল এনেছে ।

বর্তমানে গোটা দেশ একটি একক পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে সংযুক্ত । এটা কিন্তু আগামীর দিকে একটা বিরাট পদক্ষেপ । উৎপাদন এবং যোগান খাতে সংস্কার যেখানে সন্তোষজনক, ঠিক সেখানেই বিদ্যুৎ বণ্টন বিভাগের কাজকর্মে বেশ কিছু খামতি রয়ে গিয়েছে । 2018 সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থাগুলি, উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির কাছে 81 হাজার 85 কোটি টাকা পায় । এই সব ইস্যুগুলি ব্যাঙ্কের উপরও প্রভাব ফেলেছে । বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির এই বাকি থাকা ঋণকে ‘নগদহীন সম্পদ’-এর আওতায় ফেলা হচ্ছে, যা ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক অবস্থানের উপর প্রভাব ফেলছে । ঠিক এই কারণেই সরকার বিদ্যুৎ খাতে কিছু জরুরি বদল আনার পরিকল্পনা করছে । এই সংস্কারগুলিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । প্রথম, গঠনগত । যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেশন কমিশনের প্রতিষ্ঠা করা । দ্বিতীয়, ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সংস্কার । যার মাধ্যমে গ্রাহক যে কারও কাছ থেকে ‘ওপেন অ্যাক্সিস’ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে । আর সর্বশেষ হল অর্থনৈতিক সংস্কার ।

‘উদয় প্রকল্প’-এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ বণ্টনকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে । পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া দেশের বাকি সব রাজ্য এই প্রকল্পের সুফল ভোগ করছে । যদিও বণ্টনকারী সংস্থাগুলি গোড়ার দিকে একটু হলেও লাভের মুখ দেখেছিল, পরে তারা ফের আর্থিক ক্ষতির রাস্তাতেই ফিরে যায় । অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনতে গত বছর কেন্দ্র একটি নয়া প্রকল্পের সূচনা করে । বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি বণ্টনকারী সংস্থাগুলিকে ধারে বিদ্যুতের যোগান দেয় । এই প্রকল্পের ফলে বর্তমানে যে অর্থ বকেয়া থাকছে, তা দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অতীতের বকেয়াগুলি এখনও বাকি আছে । বণ্টনকারীরা বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে দুর্বলতম যোগসূত্র । এই বণ্টনকারী সংস্থাগুলির উপর রাজ্য সরকারগুলির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে । সালিশির অভাব, শুল্কবৈষম্য, বকেয়া মেটাতে বিলম্ব-এই সব সমস্যায় বর্তমানে বিদ্যুৎক্ষেত্র জর্জরিত । তার উপর আবার যোগান এবং বাণিজ্যের ঝুঁকিও রয়েছে । বিদেশি সংস্থাগুলি এই সব সংস্থায় বিনিয়োগ করতে চায় না, কারণ কেনার পর দুই থেকে 15 মাসের মধ্যে বকেয়া মেটানোয় এদের অনীহা রয়েছে ।

সমস্ত বণ্টনকারী সংস্থাগুলিই যে একভাবে কাজ করে, তা নয় । দেশে 41টি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন সংস্থা রয়েছে । তাদের ছ’টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে । এর মধ্যে শুধুমাত্র সাতটি উচ্চস্থান দখল করলেও বাকিরা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে । যারা শীর্ষস্থানে রয়েছে, তার মধ্যে তেলুগু ভাষী রাজ্যগুলির তরফে কোনও বণ্টনকারী সংস্থা নেই । অন্ধ্রপ্রদেশের ইস্ট ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে । আর বাকি সংস্থাগুলি রয়েছে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে । বার্ষিক পার ক্যাপিটা বিদ্যুৎ ব্যবহারের নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নেয় । দেশের গড় পার ক্যাপিটা বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ হল এক হাজার 181 কিলোওয়াট আর পশ্চিম ভারতে পার ক্যাপিটা বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ হল এক হাজার 573 কিলোওয়াট । উত্তরপূর্বে এর পরিমাণ মাত্র 410 কিলোওয়াট এবং তেলাঙ্গানা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে, এক হাজার 727 কিলোওয়াট । অন্ধ্রপ্রদেশে ব্যবহারের পরিমাণ মাত্র এক হাজার 388 কিলোওয়াট । বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থাগুলির আর্থিক দশা দেখে কেন্দ্র উদ্বিগ্ন । এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে গোটা বিদ্যুৎক্ষেত্র ধসে পড়বে । সেই সব ব্যাঙ্কে ‘নগদহীন সম্পদ’-এর পরিমাণ বাড়ছে, যারা বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থাগুলিকে ঋণ দেয় এবং নতুন নতুন বিনিয়োগ খারিজ হয়ে পড়ছে । এমনকী দেরিতে বকেয়া মেটানোর এই প্রবণতা দেখে বিদেশি সংস্থাগুলিও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিধায় পড়েছে ।

বিদ্যুৎক্ষেত্রের প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের মনোভাব দেখে কেন্দ্র হতাশ । উদ্বেগের কারণ হল দুর্নীতির অভিযোগ, যা YSRCP-এর ক্ষমতায় আসার পরই সামনে এসেছে । দেশের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশই হল দ্বিতীয় সবর্বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদক রাজ্য, যেখানে 60 হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করা হয়েছে । এর বায়ুশক্তি উৎপাদনের পরিমাণ চার হাজার 92 মেগাওয়াট এবং সৌরশক্তি উৎপাদনের পরিমাণ তিন হাজার 230 মেগাওয়াট । যে সংস্থা এই সব প্রকল্পে লগ্নি করেছে, তারা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করেছে এবং এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দিয়েছে । অসামরিক কাজকর্ম এবং পুননর্বীকরণযোগ্য শক্তি সংক্রান্ত চুক্তির মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, এটি তার ব্যাখ্যা করেছে । এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের দুর্দশার মোকাবিলা করবে । বেশ কিছু বৈঠক হয়েছে এবং ঋণদানের সাহায্যে কথাও জানানো হয়েছে । NTPC-র মাধ্যমে কিছু পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয় করতে এরা প্রস্তত ছিল । রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এ ধরনের বহু উৎসাহবর্ধক অনুদান দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কোনও কিছুতেই অন্ধ্র সরকার আমল দেয়নি । কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি জারি করেছে । তার পরই এই রাজ্য কিছু পদক্ষেপ করতে রাজি হয়েছে । এই মর্মেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে যে, প্রয়োজনে বড়সড় পদক্ষেপ যেমন ঋণ ছাড় দেওয়া, সরকারি সংস্থা থেকে কয়লার জোগান দেওয়া প্রভৃতি সুবিধাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে । এই হুঁশিয়ারি জারির অন্যতম কারণ হল অন্ধ্রপ্রদেশের ঋণের পরিমাণ 83 হাজার 500 কোটি (সমগ্র ঋণের 25 শতাংশ) । রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের সম্পদ স্টেট ইলেকট্রিসিটি ফাইনান্স কর্পোরেশেনে স্থানান্তর করবে । আধিকারিকরা জানিয়েছেন যে, তাঁরা ব্যাঙ্ক ঋণের মাধ্যমে ধার শোধ করবেন ।

কেন্দ্র বণ্টন বিভাগের সংস্কারে মনোনিবেশ করেছে । এই সব সংস্কারের তালিকায় রয়েছে যোগানখাতে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে 10 শতাংশে নিয়ে আসা, দেশজুড়ে স্মার্ট মিটার তৈরি করা, শুল্ক সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করা, যোগানে দ্রুততা আনা এবং গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা প্রভৃতি । এই প্রকল্প তিন দফায় কার্যকর হবে । প্রথম দফায় 2022 সালের মধ্যে স্মার্ট মিটার ইনস্টল করা হবে । দ্বিতীয় দফায় ইনসুলেটেড প্রোটেকটিভ ওয়্যারিং বসানো হবে, কৃষি এবং গ্রামীণ তথা বাড়িতে ব্যবহারের জন্য বসানো হবে বিশেষ ফিডার । SCADA-এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং নজরদারিমূলক নিয়ন্ত্রণ চলবে । আর তৃতীয় দফায় হবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচী । সরকার জানিয়েছে, লোকসানে চলা সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণও এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ । দিল্লির বণ্টন সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে । যোগান এবং বাণিজ্যে ক্ষতির পরিমাণ আগে 40 শতাংশ ছিল । এখন তা কমিয়ে 16 শতাংশ করা গিয়েছে । ওড়িশা সরকারও একই ধরনের পদক্ষেপ করেছে । এদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু বণ্টন সংস্থা এই দিশায় এগোতে পারে । বিদ্যুতের অবাধ এবং সুলভ যোগান দেওয়া শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন যথাযথ যোগানদাতা মিলবে এবং যথাযথ নজরদারি চলবে । শুধুমাত্র তখনই ভারত সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারবে ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details