পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

বোড়োদের বিভাজন ও সোমবারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে সোমবার ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে ৷ এই চুক্তি আসলে পূর্বতন দু’টি চুক্তির চূড়ান্ত রূপ । প্রতিবেদনটি লিখেছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক সঞ্জীব কুমার বড়ুয়া ৷

বোড়োদের বিভাজন
বোড়োদের বিভাজন

By

Published : Jan 30, 2020, 7:32 AM IST

দিল্লি, 30 জানুয়ারি : সেটা 1988 সাল । অসমে থাকাকালীন এক তরুণ গোয়েন্দাকর্মী আর কে যাদবের এক গভীর উপলব্ধি হল । একটি গোয়েন্দা অপারেশনে গিয়ে যিনি নিজের চোখে যা দেখেছিলেন তা হল, বোড়ো যুবদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে এবং তাদের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে । তিনি সেই সময় ঘটনাটির প্রতিবাদ করেন । পরে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরে তিনি একটি বই লেখেন ৷ যেখানে সেই অপারেশনের খুঁটিনাটির বিশদ ব্যাখ্যা করা হয় ।

বিষয়টি নিয়ে সংসদেও সরব হন অসমের রাজ্যসভা সাংসদ নগেন সইকিয়া । তিনি 1986 থেকে 1992 সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন । এর মধ্যে 1990 থেকে 1992 সাল পর্যন্ত তিনি সংসদের উচ্চকক্ষের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন ।

এই প্রশিক্ষিত বোড়োরাই পরে তৈরি করে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন বোড়ো লিবারেশন টাইগার (BLT), যারা IED বিস্ফোরক তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল । এরপর থেকে বিভিন্ন দাবিকে সামনে রেখে একাধিক সশস্ত্র বোড়ো সংগঠন তৈরি হয় । কখনও তাদের দাবি ছিল বিভিন্ন মাত্রার স্বায়ত্তশাসন ৷ তো কখনও পশ্চিম অসমের স্বাধীনতা।

মঙ্গোলীয় প্রজাতির বোড়োরা, যারা তিব্বতি-বর্মীয় ভাষায় কথা বলে, তারা অসমের সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা ।

সেই সময় বোড়োদের সাহায্য করার এই সরকারি অছিলার কারণও ছিল । অভিযোগ, সেই সময় অসমের প্রাদেশিক রাজনৈতিক ভাব এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী দল হিসাবে অসম গণ পরিষদ (AGP)-এর উত্থান ঠেকাতেই তৎকালীন সরকার এই পদক্ষেপ করেছিল ।

সোমবারের চুক্তি

সোমবার (27 জানুয়ারি, 2020), সেই বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল, যখন শেষ সশস্ত্র বোড়ো সংগঠন ন্যাশনাল ফ্রন্ট অব বোড়োল্যান্ড (NDFB) সরকারের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করল ।

বাস্তবে, সোমবারের চুক্তি আসলে পূর্বতন দু’টি চুক্তির চূড়ান্ত রূপ । 1993 সালে ABSU-এর সঙ্গে চুক্তির ফলে তৈরি হয় বোড়োল্যান্ড অটোনোমাস কাউন্সিল । 2003 সালে BLT-এর সঙ্গে চুক্তির ফলে ক্ষমতার আরও বিকেন্দ্রীকরণের ফলে তৈরি হয় বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল (BTC)।

মনে করা হয়, প্রায় তিন দশকের পুরানো বোড়ো আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ । দেড় হাজারেরও বেশি NDFB উগ্রপন্থী একটি সরকারি অনুষ্ঠানে বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) অস্ত্র-সহ আত্মসমর্পণ করবে।

মাত্র দিন কয়েক আগে বহু সশস্ত্র NDFB ক্যাডার তাদের মায়ানমারের ঘাঁটি ছেড়ে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের দু’টি পূর্ব নির্ধারিত জায়গা মোরে ও লংওয়ায় এসে পৌঁছে গেছে ।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে সোমবারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে যে তিন পক্ষ সই করেছে তারা হল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, অসম সরকার এবং NDFB, দা অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ABSU) এবং ইউনাইটেড বোড়ো পিপলস অরগানাইজেশন (UBPO)-এর বোড়ো প্রতিনিধিরা ।

ABSU যেখানে সত্তরের দশকের প্রথম দিক থেকে বোড়োদের স্বাধীন রাজ্যের দাবি জানিয়ে আসছিল, সেখানে UBPO চাইছিল বোড়োদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সুরক্ষা । এর সঙ্গে ছিল NDFB-এর পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি । ফলে সোমবারের চুক্তিতে বোড়োদের স্বায়ত্তশাসন থেকে সব ধরনের মত ও দিককে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে ।

দাবির আদি ও অন্ত

বহু বছর ধরেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী অসমভাষী মানুষ এবং বাংলাদেশ থেকে আগত বাংলাভাষী মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ ছিল অসমের সবচেয়ে বড় জনজাতি বোড়োদের । বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয় ভুল বোঝা ও বোঝানোর অনুভূতি ।

পশ্চিম অসমের বিস্তীর্ণ ফাঁকা অঞ্চল, যে সব জায়গা আসলে বোড়ো কৃষকদের কৃষিভূমি ছিল, যে সব অঞ্চলে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদ করে এসেছেন বোড়োরা, সেই সব অঞ্চল নজরে পড়ে প্রতিবেশী এলাকা থেকে আসা জমি হাঙরদের ।

এর সঙ্গে যোগ হয় ভৌগোলিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ । নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয় এবং মিজোরাম অসম থেকে স্ব-স্ব উপজাতিদের দ্বারা আলাদা হয়ে যাওয়ায় আলাদা রাজ্য পাওয়ার বাসনা ছিল বোড়োদের মধ্যেও ।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা শুরু হল বোড়োদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা নিয়ে । বোড়োদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাটি "চিকেনস নেক" করিডোর, যা উত্তর পূর্ব ভারতকে দেশের প্রধান ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে, সেখান থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ বোড়োদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম অসমের এলাকাটিকে "গেটওয়ে টু দা নর্থইস্ট" বলা যায় ।

এর উপর, বোড়োদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের ভুটান ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেও খুব একটা দূরে নয় ।

রাজনৈতিক নিহিতার্থ

২০০১ সাল থেকে বোড়োরা সব সময়ই কেন্দ্রের শাসকের সঙ্গে জোট করে এসেছে ৷ এবং এই প্রবণতা আচমকা বদলে যাওয়ার কোনও কারণও নেই ।

এ কথা ভুললে চলবে না যে অসমে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে আগামী 2021 সালে । রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA)-এর বিরোধিতায় সরব এবং পুরো বিষয়টা নিয়ে যখন ক্ষমতাসীন BJP সরকার কিছুটা চাপে, তখন বোড়োল্যান্ডের পরিবেশ শাসকদলকে কিছুটা সাহায্য করতে পারে । এই অবস্থায় বোড়োল্যান্ডের 16 জন বিধায়ক BJP-কে কিছুটা স্বস্তি দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে । অসম বিধানসভায় মোট আসন সংখ্যা 126 ।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোদি সরকারের "অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি"। মোদি সরকারের নীতি হল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা । এই নীতি বাস্তবায়িত করতে হলে বোড়ো নিয়ন্ত্রিত এলাকার সুষ্টু সমাধান করে প্রতিবেশীদের বার্তা দেওয়া আবশ্যিক ছিল ।

কেন্দ্র ও অসম সরকারের কাছে এই চুক্তির মাহাত্ম্য হল, এর মাধ্যমে ABSU-এর অসম ভাগের দাবি আটকানো সম্ভব হল । পাশাপাশি বহু বছরের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকেও চুক্তির আওতায় আনা সম্ভব হল । অন্য দিকে, বহু বছর ধরে চলে আসা বিক্ষোভ, আন্দোলেন ইতি টানা গেল । বোড়োল্যান্ডের দাবিকে ঠেকিয়ে একটা সম্মানজনক চুক্তি ছিল এই সময়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ।

সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটারে বলেন, “বোড়ো চুক্তি অনেক দিক থেকেই ঐতিহাসিক । এটা সব পক্ষকে একটি ছাতার তলায় এনেছে । যারা এত দিন সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তারাই এখন থেকে সাধারণ জীবনে প্রবেশ করবে ৷ এবং দেশের উন্নতিতে বড় ভূমিকা নেবে।”

চুক্তির বিভিন্ন দিক

চুক্তি অনুযায়ী বোড়োদের জন্য একটি ভৌগোলিকভাবে সুসংহত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে । এমনকী যাঁরা অ-বোড়ো অঞ্চলে থাকেন, তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রহের প্রতি যত্ন নেওয়া ও সুরক্ষিত করার কথাও চুক্তিতে বলা হয়েছে । চুক্তি অনুযায়ী নতুন তৈরি হওয়া বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল রিজিয়ন (BTR)-এর আর্থিক স্বাস্থ্য দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রের, রাজ্য কোনওভাবেই এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না । BTR-এ হওয়া সব সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবে বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল । এমনকী সেখানকার কর্মীদের পোস্টিং ও ট্রান্সফারের সিদ্ধান্তও নেবে এই কাউন্সিল । আর সর্বোপরী, জমির অধিকার, বোড়ো সংস্কৃতি রক্ষা করা, বোড়ো ভাষার উন্নতিকে আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে ।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “এই চুক্তির ফলে বোড়োদের এলাকার সার্বিক উন্নতি হবে । অসমের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে বোড়োদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা হবে ।”

অর্থাৎ, বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল রিজিয়ন (BTR)-এর ভবিষ্যতের উন্নতির সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বোড়োদেরই। তবে তা দেখভাল করবে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ এবং অবশ্যই তা করা হবে বোড়োদের সঙ্গে কথা বলেই । চুক্তি অনুযায়ী, কোনওরকম রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসন না দিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা অনেকটাই কমানো হয়েছে ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details