গত কয়েক দশকে ভারতে যেখানে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রবণতা বেড়েছে, সামাজিক স্তরে পরিবেশ আরও উদার হয়েছে এবং কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আরও পরিণত হয়েছে, সেখানেই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও অনেক কিছুই কিন্তু করা বাকি ।
কোরোনা প্যানডেমিকের জেরে স্কুল বন্ধ থাকার বিরূপ প্রভাব লক্ষিত হয়েছে যৌন শিক্ষা প্রদানের সব ধরনের মাধ্যমেই। শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে পড়ুয়ার পারস্পরিক বার্তা আদানপ্রদান এবং শ্রেণিকক্ষে সঙ্ঘবন্ধ বার্তা আদানপ্রদান প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে এবং পড়ুয়ারা বাড়িতে আটকে পড়েছে এবং যে কোনও শিক্ষামূলক পাঠ গ্রহণের জন্য একভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানসিক চাপ আর দুশ্চিন্তার কবলে পড়েছে । সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাতের অভাব এবং নতুন কিছু জানার উদ্যমের ঘাটতি বর্তমানে কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। আরও একটি সমস্যা হল, পড়ুয়ারা বর্তমানে অনলাইনেই বেশি সময় কাটাচ্ছে, যেখানে সাইবার নিগ্রহ তথা অনলাইন নিগ্রহের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে । এর ফলে যৌন শিক্ষাদানের যথাযথ পরিকাঠামো ছাড়া এটি পরবর্তীতে আরও খারাপ দশার দিকে এগোবে ।
অতি সক্রিয় ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্যানডেমিকের জেরে বাড়িতেই পড়াশোনার এই সময়ে যৌন শিক্ষাদানের দৃষ্টিভঙ্গী এবং প্রক্রিয়ায় বদল আনা অত্যন্ত জরুরি । প্রথাগত শিক্ষাদানের প্রক্রিয়ায় যে ত্রুটিগুলি রয়ে গিয়েছে, তা মেটাতেই হবে । কারণ তার ফলেই যৌন শিক্ষাদান বাস্তবিক অর্থেই সর্বব্যপী, উন্নয়নশীল, লিঙ্গ-বৈষম্যহীণ হবে এবং বর্তমান পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নও থাকবে না ।
যৌন শিক্ষাদানের উদ্যোগের দুর্ভাগ্যজনক অভাবের কারণেই দেশের বেশিরভাগ স্থানে যৌন নিগ্রহ তথা শারীরিক নিগ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে খুব কমই সচেতনতার প্রসার ঘটেছে । সম্মতি, নিয়ম লঙ্ঘন এবং ধর্ষণের অর্থের মাঝে থাকা সূক্ষ্ম ব্যবধান অনেকেই বুঝতে পারে না এবং কালিমালিপ্ত করার ভয়ে কেবল একের পর এক ঘটনা গোপন করার প্রচেষ্টাই দেখা যায় । যার ফলে দোষীরা বেঁচে যায় । ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের উদ্যোগে ইউনিসেফ এবং প্রয়াস নামে একটি এনজিও-র করা সমীক্ষা অনুসারে, 5 থেকে 12 বছরের মধ্যে থাকা শিশুরা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে । আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, এই ধরনের ঘটনায় দোষীরা, নিপীড়িত বা নিপীড়িতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় । কাজেই অর্ধেকেরও বেশি ঘটনায় অভিযোগই দায়ের করা হয়নি ।
একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতে যৌন শিক্ষাদানকে কৈশোরকালে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়া এবং এইচআইভি বা এইডসের সঙ্গে সমতুল হিসাবে দেখা হয় । এমনকী, রজঃস্বলা হওয়ার বিষয়টিকেও খুব কমই চর্চা করা হয় । এই বিষয়গুলি নিয়ে আরও বৃহত্তর স্তরে বোঝাপড়া দরকার এবং লিঙ্গভিত্তিক পরিচিতি, উৎপত্তি এবং বৈচিত্র্যের প্রেক্ষিতে পরিমার্জনা করে এই নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা দরকার ।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হল, সূদূরপ্রসারী ঐকমত এবং বিষয় হিসাবে এর অত্যাবশকীয়তা থাকা সত্ত্বেও এখনও অনেক স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানকার পাঠ্যসূচিতে যৌন শিক্ষাদানের কোনও উল্লেখই নেই । ‘ইউথ কোয়ালিশন ফর সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ রাইটস’-এর একটি রিপোর্ট অনুসারে, বেশিরভাগ স্কুল, বেসরকারি এবং জন অনুমোদিত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টেট বোর্ডগুলির পাঠ্যসূচিতে যৌন শিক্ষাপ্রদানের কোনওরকম উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
ভারত সরকার 2007 সালে ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (এনএসিও) এবং ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড (ইউনিসেফ)-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘অ্যাডোলেসেন্ট এডুকেশন প্রোগাম’ (এইপি) চালু করেছিল । সেই বছরেই সমস্ত রাজ্যে এর সূচনাও হয়ে গিয়েছিল । মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের তরফে এই উদ্যোগকে ‘তরুণ প্রজন্ম’-কে যথাযথ, বয়সোপযোগী এবং সংস্কৃতিগতভাবে প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রদান করে স্বাস্থ্যকর স্বভাব,দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে তাদের ‘ইতিবাচক দিক’ দিয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলির সদর্থক সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রে জরুরি বলে গণ্য করা হয়েছিল । কিন্তু আখেরে তা কার্যকর হয়নি এবং পরবর্তীকালে এর বিষয়বস্তুকে ‘যথাযথ নয়’ বলে তকমা দিয়ে 12টিরও বেশি রাজ্যে একে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় ।
সামাজিক এবং সংস্কৃতিগত দায়বদ্ধতার বদল আসা সত্ত্বেও, এখন ‘সেক্স’ তথা ‘যৌন সম্পর্ক’ এবং ‘যৌনতা’ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ছুৎমার্গ রয়েছে । এই বিষয়ে সৎ, যুক্তিশীল, স্বাস্থ্যকর এবং খোলামেলা চর্চার অভাবেই এখনও একে অস্বস্তি এবং চর্চার অযোগ্য বিষয় হিসাবেই দেখা হয় ।
আরও পড়ুন, আইপিএস ডেপুটেশন ইশুতে মমতার পাশে এনসিপি, রাজ্যে আসতে পারেন পাওয়ার
যথার্থ অর্থেই সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচি 2020-তে কৈশোরকালে যৌন শিক্ষাপ্রদানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে । যদিও এতে উল্লেখ রয়েছে শারীরিক স্বাস্থ্যগঠন এবং লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীলতার গুরুত্বের কথা ।