নেপালের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পট পরিবর্তনের দিকে কড়া নজর রাখছে ভারত এবং চিন । বেজিং এবং দিল্লির অনেকেই চোখ কপালে তুলেছিলেন, যখন সে দেশের কেপি শর্মা ওলি সরকার অস্তিত্ত্ব রক্ষার সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন । সমস্যা তখন শিরোনামে আসে, যখন হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই দেশের সুপ্রিম কোর্ট, ওলির 20 ডিসেম্বরের পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ, হাউজ় অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস (প্রতিনিধি সভা), ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছিল ।
পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ নিজেদের রায়ে জানিয়েছিল যে নেপালের সংবিধান (2015) কোনওভাবেই প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেয় না । আরও শাণিত প্রতিক্রিয়া দিয়ে সেই দেশের শীর্ষ আদালত ওলির প্রকাশ্যে সওয়াল নিয়ে একেবারে বিপরীত রায় দেয় । এসব ছিল ওলির সেই বিতর্কিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, যেখানে তিনি মনে করেছিলেন, ‘ওয়েস্টমিনস্টার-আদলের-গণতন্ত্র’-এর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার চূড়ান্ত ক্ষমতা তাঁর আছে এবং যখন তিনি চান, তখনই দেশকে অন্তবর্তীকালীন নির্বাচনের মুখে ঠেলে দিতে পারেন ।
23 ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে এই বিষয়ে ভুল প্রমাণ করেছে । এবং এই রায় বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই উৎফুল্ল হয়েছেন । এই তালিকায় রয়েছেন তাঁর প্রাক্তন এনসিপি (নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি) কমরেডরা, যারা তাঁর অসময়ে সংসদের নিম্ন কক্ষ ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখিয়েছিলেন । আরও রয়েছেন বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস ও নাগরিক সমাজের বহু নেতা ।
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে তারা সকলেই নিম্ন কক্ষের পুর্নবহাল হওয়ার খবরে উৎসব পালনে লেগে পড়েন । আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে 13 দিনের মধ্যে (8 মার্চের আগে) সকল সদস্যকে একজোট হতে হবে । একটা বিষয় স্পষ্ট । যতক্ষণ না কে পি ওলি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে তাঁর প্রাক্তন কমরেড এবং অন্যান্য বিরোধী সাংসদদের ক্ষোভের মুখে পড়বেন ।
ভারতের কাছে এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারত এবং নেপালের মধ্যে অন্তত 1 হাজার 800 কিলোমিটার দীর্ঘ, মুক্ত সীমান্ত এলাকা রয়েছে, যাকে অনেকেই ঝাঁজরা বলে মনে করেন । তারা এটাও মনে করেন যে, যেহেতু ভারত এবং নেপাল, দুই দেশেরই সভ্যতাগত, ইতিহাসগত, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বন্ধন অভিনব, তাই নেপালে যে কোনও ধরনের টানাপোড়েন হলেই, তা সে স্বাভাবিক হোক বা রাজনৈতিক ভারতে অল্পবিস্তর প্রভাব পড়বেই ।
কেপি ওলিকে দিল্লিতে অনেকেই পছন্দ করেন না । কারণ তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে নেপাল গত বছর জুনে একটি নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে । যেখানে কৈলাস পর্বত এবং মানস সরোবরের কাছে ভারত-চিন-নেপাল তিন দেশের সীমান্তের লিপুলেখ-কালাপানি-লিম্পিয়াধুরার পার্বত্য অংশের বিতর্কিত এলাকাকে নেপালে দেখানো হয়েছিল । সেই মানচিত্র নেপালের পার্লামেন্ট প্রচার করে এবং পরে তাকে নেপালের জাতীয় প্রতীক এবং সরকারি ব্যাজেও তুলে ধরা হয় । নেপালের এই পদক্ষেপের নেপথ্যে ছিল ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের 2020 সালের 8 মে’র উদ্যোগ, যেখানে তিনি লিপুলেখ থেকে কালাপানি পর্যন্ত এলাকা জিপ যাওয়ার রাস্তা হিসাবে খুলেছিলেন । লিপুলেখের ওই এলাকার অধিকার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই সরব ছিল নেপাল, তাও আবার 1816 সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত এবং নেপালের মধ্যে হওয়া সুগাউলি চুক্তি অনুসারে । সীমান্ত বিবাদ মেটাতে যেখানে দিল্লি এবং কাঠমাণ্ডু এখনও পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক স্তরে আলোচনা শুরু করে ওঠেনি, তার উপর নতুন চিন্তা ঘনিয়েছে নেপালের রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে । যা পড়শি ভারত এবং চিনের থেকেও বেশি নেপালের নিজেদের অধিবাসীদের জন্য বিপদ বয়ে আনতে সক্ষম ।
আরও পড়ুন, ঐতিহ্য পরিপন্থী সমলিঙ্গ বিবাহে আপত্তি কেন্দ্রের
এক দশকব্যপী রক্তাক্ত মাওবাদী অনুপ্রবেশের দৌরাত্ম্য (1996-2006 পর্যন্ত, যেখানে অন্তত 17 হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল) সহ্য করা নেপাল এখনও তাদের 2015 সালের সংবিধানকে পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি, যা তাদের গণপরিষদের তরফে লেখা হয়েছিল যার জন্য দু’বার নির্বাচনও হয় । নেপাল এখনও পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক আরোগ্য লাভ করে উঠতে পারেনি । এখানকার নবীন প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হারও দীর্ঘ, যার জন্য যুবক-যুবতিরা সীমান্ত পেরিয়ে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে ভারত ও অন্য দেশে যায় ।
চিনের কাছে এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
নেপালের টানাপোড়েন নিয়ে চিনও কম উদ্বিগ্ন নয় । যদিও সুউচ্চ হিমালয় পর্বতের বাধা মাঝপথে রয়েছে, তবু চিন এবং নেপালের মধ্যে অন্তত 1 হাজার 400 কিমি দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা রয়েছে, যা সাধারণত শান্ত এবং নির্বিবাদে থাকে । কিন্তু প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে নিজেদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) তৈরি করা ও তাতে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে চিন, নেপালকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত । আর এই প্রস্তাব নেপালের পছন্দও হয়েছে । সাম্প্রতিক বছরে একাধিকবার বেজিং থেকে কাঠমাণ্ডুতে উচ্চপর্যায়ের সফর হয়েছে আর এই তালিকায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সেই যাত্রাও রয়েছে, যখন চিনা আধিকারিকরা (চাইনিজ় কমিউনিস্ট পার্টি তথা সিপিসি-র নেতারা-সহ) বারবার নেপালের কমিউনিস্ট নেতাদের একজোট থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন ।
নেপালের ক্ষমতাসীন সিপিএন, যারা, যদিও এখন প্রায় বিভাজিত, তৈরি হয়েছিল একটি জোটের ফলে । আর এই জোট হয়েছিল কেপি ওলি এবং প্রাক্তন মাওবাদী নেতা প্রচণ্ডের মধ্যে 2017 সালের অক্টোবর মাসে, যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনের সময়ে । এই জোট বেজিংয়ের কাছে ছিল দারুণ ব্যাপার, কারণ তারা বহু বছর ধরে এমন জোট হওয়ার আশায় ছিল । এই গোটা সময় ধরেই নেপালে চিনা রাষ্ট্রদূত হৌ ইয়ানকি (উচ্চারণ হয় ইয়াংচি) প্রচণ্ড, ওলি এবং অন্য সকলকে একজোট থাকতে বলায় বেশ সক্রিয় ছিলেন ।
সাম্প্রতিক কিছু মাসেও হৌকে বেশ সক্রিয় দেখিয়েছিল, যখন এনসিপির মধ্যে (বিশেষ করে ওলি এবং প্রচণ্ড—মাধব নেপাল অংশের মধ্যে ) বিবাদের সূত্রপাত হয় । কিন্তু তিনি তা মেটাতে ব্যর্থ হন কারণ ওলি আর প্রচণ্ড—নেপাল অংশের মধ্যেকার বিবাদ খারাপ থেকে অতি খারাপ আকার নেয় । কিন্তু স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বেজিং এখন নেপাল নিয়ে দিল্লির মতোই উদ্বিগ্ন কারণ সিপিএন জোটে (যা বেজিং উদ্বুব্ধ করেছিল) ভাঙন দেখা দিয়েছে ।
তাহলে উপায় কী
পুনঃস্থাপিত সংসদের নিম্ন কক্ষে অধিবেশন যখন 8 মার্চ শুরু হবে, সেই মতো নেপালের ক্ষমতাসীন সিপিএন আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের দিকে এগোবে যখন এর দুই নয়া প্রতিদ্বন্দী বহুপ্রতীক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর আসনের জন্য লড়বে । কেপি ওলি যেখানে একটি অংশের নেতৃত্ব দেবেন, যাদের সদস্যরা বতর্মানে সরকারে আছে, বিরোধী শিবিরে থাকতে পারেন প্রচণ্ড, যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপাল এবং ঝালা নাথ খনালের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন নিজেদের শক্তি বাড়াতে । প্রচণ্ড-মাধব নেপালের অংশের দাবি, সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যদের 70 শতাংশই তাদের সঙ্গে আছেন । কিন্তু ওলি এই দাবি খারিজ করেছেন এবং বলেছেন, তার অংশ বৃহত্তর, বেশি শক্তিশালী ।
সিপিএন অংশের একজনও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি যা সাধারণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গড়তে লাগে । সেই কারণেই ওলি এবং প্রচণ্ড-মাধব অংশ বিরোধীদের তুষ্ট করতে ব্যস্ত । নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা উদ্যোগী হয়েছেন একটি জোট গড়তে, যেখানে সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিলবে । নিভর্রযোগ্য জোটসঙ্গীর খোঁজ চলছে, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি যেমন প্রাক্তন মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাইয়ের নেতৃত্বাধীন জনতা সমাজবাদী পার্টিও হঠাৎ করেই গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহ নেপালের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এটা দেখার জন্য যে নেপালের নতুন সরকারের মাথা কে হন, তার আকার কেমন হয় । হতে পারে তিনি প্রচণ্ড বা দেউবা কিংবা আবার ওলি, যার হাত ধরে নেপাল এই কঠিন সময় পার করে যাবে ।