জয়পুর, 23 অক্টোবর: স্বাধীন দেশ হিসেবে 75 বছরে পা রাখতে চলেছে ভারত । কিন্তু রক্তমাখা স্বাধীনতার ইতিহাসে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে বহু স্বনামধন্য নাম । রাজস্থানের বারহঠ পরিবার তাদের মধ্যে অন্যতম । মরুরাজ্যে ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবের বীজবপণ এই পরিবারের হাত ধরেই । সেই তালিকায় রয়েছেন প্রখ্যাত কবি কেশরী সিংহ বারহঠ, তাঁর ভাই জোরাবর সিং বারহঠ এবং ছেলে প্রতাপ সিংহ বারহঠ । হাতের মুঠোয় থাকা বিলাসিতা ত্যাগ করে স্বরাজ্য অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা ।
স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তিতে এমনই বিস্মৃত কিছু নাম ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনতে উদ্যোগী হয়েছে ইটিভি ভারত । তাতে এই সপ্তাহে ঝালিয়ে নেওয়া যাক স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজস্থানের বরাহঠ পরিবারের অবদান । তাদের আত্মত্যাগের কথা আজও মরুরাজ্যের বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফেরে । তবে তার বাইরে ওই পরিবার সম্পর্কে সে ভাবে অবগতই নন একটা বড় অংশের মানুষ । তাঁরা জানেন না যে, ভগৎ সিং, সুখদেব থাপার এবং শিবরাম রাজগুরুর ঢের আগে যে তরুণ হাসিমুখে জেলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তিনি এই বারহঠ পরিবারেরই সদস্য ।
1872 সালের 21 নভেম্বর শাহপুরার সম্ভ্রান্ত বারহঠ পরিবারে জন্ম কেশরী সিংয়ের । কবি এবং দার্শনিক এবং পণ্ডিত হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন তিনি । পাশাপাশি ভিলওয়ারা জেলার খেদা এবং শাহপুরার সামন্তও ছিলেন । তাঁর কলমের আঁচড়েই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের । তাঁর বিখ্যাত ঐতিহাসিক রচনা ‘চেতাবনী রা চুঙ্গাত্যা’ তরুণ বিপ্লবীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ করেছিল ৷ সেই সময় জাতীয়তাবোধ এবং স্বাধীনতার অধিকার নিয়েও বিস্তর লেখালেখি করেন কেশরী ৷ তাতেই ইংরেজদের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি ৷
সেই সময় কেশরী এবং তাঁর অনুগামীরা জোধপুরের মহন্ত প্যায়ারেলালের সংস্পর্শে আসেন ৷ প্যায়ারেলাল আসলে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ইংরেজদের চর হিসেবে কাজ করছেন বলে জানতে পারেন তাঁরা ৷ কেশরীর নির্দেশে তাঁর অনুগামীরা প্যায়ারেলালকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে ৷ তাতে প্যায়ারেলালকে দেশদ্রোহ এবং ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে 20 বছরের সাজা দেয় ইংরেজরা ৷ বিহারের হাজারিবাগের জেলে সাজা কাটাতে পাঠানো হয় ৷ সেখানেই 1941 সালের 14 আগস্ট মৃত্যু হয় কেশরীর ৷
1931 সালে ভগৎসিংহ, সুখদেব এবং রাজগুরুকে ফাঁসিতে ঝোলায় ইংরেজরা ৷ তাতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ ৷ কিন্তু তার এক দশকেরও বেশি আগে, 1918 সালে জেলে মৃত্যু হয় কেশরীর ছেলে প্রতাপের ৷ রাসবিহারি বসুর নেতৃত্বে 1912 সালে দিল্লির চাঁদনি চকে লর্ড হার্ডিংয়ের শোভাযাত্রা লক্ষ্য কর বোমা ছোড়ায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি , যা দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে ইতিহাসে নথিভুক্ত ৷ বরেলী জেলে প্রতাপের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় ৷ আর কে কে তাঁর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, জানতে চাওয়া হয় সকলের নাম ৷
রাজস্থানের বারহঠ পরিবার আজ বিস্মৃত কিন্তু শত অত্যাচার সত্ত্বেও কোনও বিপ্লবীর নাম ফাঁস করেননি প্রতাপ ৷ বাড়িতে মা তাঁর জন্য কেঁদেকেটে সারা হচ্ছেন বলে প্রতাপকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় ইংরেজদের তরফে ৷ কিন্তু তাদের চোখে চোখ রেখে প্রতাপের সাফ জবাব ছিল, ‘‘নিজের মায়ের কান্না বন্ধ করতে হাজার হাজার মাকে আমি কাঁদাতে পারব না ৷’’ সরকারি চাকরি, গোটা পরিবারের মুক্তির প্রলোভনও প্রতাপকে টলাতে পারেনি ৷ এর পর প্রতাপের উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায় ৷ তাতে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যায় ৷ এর পর 1918 সালের 24 মে, জেলে বন্দি থাকাকালীন মাত্র 25 বছর বয়সে মৃত্যু হয় প্রতাপের , তা-ও আবার নিজের জন্মদিনেই । সেই সময় থেকেই ভারত থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলার সময় ঘনিয়ে আসছে বলে ইঙ্গিত পেয়ে যায় ব্রিটেন ৷ প্রতাপের মৃত্যুতে এতটাই শঙ্কিত হয়ে পড়ে তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা যে, বিধি মেনে সৎকার পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি তাঁর দেহের ৷ বরং জেলেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে ৷
উল্লেখ্য, যে লর্ড হার্ডিংয়ের উপর হামলায় দোষী সাব্যস্ত হন প্রতাপ, সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন তাঁর কাকা জোরাবরও ৷ হামলার দিন প্রতাপ এবং বসন্তকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে তিনিই লর্ড হার্ডিংকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন ৷ কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হন তিনি ৷ ফলে হার্ডিং বেঁচে যান ৷ তাঁর পরিবর্তে মৃত্যু হয় তাঁর মাথার উপর ছাতা ধরে থাকা মহাবীর সিংয়ের ৷ বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর নাগাল পায়নি ইংরেজ শাসক ৷ 1939 সালে মন্দসৌরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় জোরাবরের ৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তিনি ৷
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বারহঠ পরিবারের অবদান নিয়ে যোগাযোগ করলে শহিদ প্রতাপ সিং সংস্থানের সচিব কৈলাস সিং জাদাওয়াত রাসবিহারি বসুর প্রসঙ্গ টেনে আনেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাসবিহারি বলেছিলেন, ভারতে এমন কোনও পরিবার নেই বললেই চলে, যারা বংশপরম্পরায় ছেলেদের বিপ্লবের রাস্তা ধরতে উৎসাহ জুগিয়েছে ৷ ’’ কৈলাসের কথায়, ‘‘শুধু প্রতাপ সিংই নন, জোরাবরও সিংও বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ৷ দেশের জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ওঁরা ৷’’
তবে বারহঠ পরিবার সশস্ত্র বিপ্লবে যুক্ত থাকলেও, অহিংস আন্দোলনের পথ প্রদর্শক মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে ওই পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায় ৷ নিজের প্রাসাদোপম বাড়িটিকে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি ৷ সেখানেই যাবতীয় পরিকল্পনা এবং রণকৌশল ঠিক হতো ৷ লবণ সত্যাগ্রহের সময় কেশরীকে নিজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি ৷ অভিজ্ঞ সাংবাদিক মূলচাঁদ পেসওয়ানি ইটিভি ভারতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ডান্ডি যাত্রায় গোটা পরিবার শামিল হয়েছিল ৷ মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে মেওয়ারায় অভিযান সামলানোর দায়িত্ব পড়েছিল কেশরীর কাঁধে ৷ মেওয়ারের মহারাণা দিল্লি যাওয়ার সময় তাঁকে সতর্কতামূলক চিঠি ধরিয়েছিলেন কেশরী ৷ তা পেয়ে ইংরেজ শাসকের সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে আসেন মহারাণা ৷’’
কেশরীর প্রপৌত্রী সরলা কানওয়ারের সঙ্গেও যোগাযোগ করে ইটিভি ভারত ৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশের স্বাধীনতার জন্য শহিদ হয়েছিলেন আমার পূর্বপুরুষরা ৷ এই পরিবারের মেয়ে হিসেবে গর্ববোধ করি আমি ৷’’