কলকাতা, 24 এপ্রিল: ভোট-বাজারে প্রার্থীরা যেন একেক জন ফ্যাশন আইকন ৷ বিশেষত মহিলা প্রার্থীরা ৷ নদিয়ার মহুয়া, হুগলিতে লকেট কিংবা রচনা থেকে কৃষ্ণনগরের রানিমা ৷ তারকা প্রার্থীদের ভোট চাওয়ার সময় প্রথম পছন্দ অবশ্যই শাড়ি ৷ আর এই গরমে ফ্যাশন আর স্বচ্ছন্দ বাড়াচ্ছে যে শাড়ি, সেই শাড়ির আঁতুড়ঘর নদিয়া আর ফুলিয়া, শান্তিপুর অথবা হুগলির ধনেখালিতেও বইছে ভোটের হাওয়া ৷
ভোট আসে, ভোট যায় ৷ প্রার্থীরা জোরহাতে দরজায় এসে দাঁড়ান প্রত্যেক বার ৷ নির্বাচনী বৈতরণী পার করার অনুরোধ নিয়ে ৷ কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কি তাঁতিদের ভাগ্যে কোনও শিকে ছিঁড়েছে আজ পর্যন্ত ? কেমন আছে বাংলার তাঁতিরা এই ভোট মরশুমে ?
রানাঘাটের ফুলিয়া-শান্তিপুর
2019 সালের লোকসভা ভোটে তাঁত শিল্পীরা বিজেপির উপরে আস্থা রেখেছিল ৷ তার আগে 2014 সালের নির্বাচনে রানাঘাট কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের তাপস মণ্ডল ৷ তবে জগন্নাথ সরকারের জয়ের নেপথ্যে শান্তিপুর ও ফুলিয়ার হাজার হাজার তাঁত শিল্পীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ৷ শিল্পীরাও আশায় ছিলেন, হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের শিল্প বাঁচাতে কিছু করবে ৷
প্রায় 60 বছর ধরে তাঁত বুনছেন রতন বসাক ৷ ভোট নিয়ে হতাশ শিল্পী বলেন, "যত রাজনৈতিক নেতারা এসে আশ্বাস দিচ্ছেন, ততই তাঁতশিল্প দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে পৌঁছাচ্ছে ৷ ভোট এলে তাঁদের দেখা পাওয়া যায় ৷ প্রতিশ্রুতি শোনা যায় ৷ কিন্তু, ভোট চলে গেলে তাঁদের আর পাত্তা পাওয়া যায় না ৷" তাঁত শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রৌঢ় জানালেন, এখন তাঁতে 100 টাকা উপার্জন করতে একটা দিন চলে যায় ৷ এদিকে যে রোজগার হয়, তাতে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ছে ৷ শিল্পী বলেন, "রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই ৷ তাই তাঁত শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে ৷ আমরা চাই সরকার অবিলম্বে তাঁত শিল্প বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নিক ৷"
আরেক শিল্পী সমর বসাক ৷ 13 বছর বয়স থেকে তাঁত বুনছেন ৷ তাঁর গলাতেও হতাশা, "বাজার অনুযায়ী যেভাবে উপার্জন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না ৷ জিনিসের দাম আর উপার্জনে দিন-রাতের ফারাক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷" সমরের আক্ষেপ, "অত্যাধুনিক উপায়ে মেশিনে কাপড় তৈরি হচ্ছে ৷ ফলে হস্তচালিত তাঁত শিল্প একেবারে ধ্বংসের মুখে ৷" অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনপ্রতিনিধি বাছাই করলেও তাঁদের কথা কেউই দিল্লিতে তুলে ধরেন না, আক্ষেপ তাঁতশিল্পীর ৷
রানাঘাটের বিদায়ী সাংসদ তথা লোকসভা প্রার্থী জগন্নাথ সরকার কিন্তু এই অভাব-অভিযোগ মানতে নারাজ ৷ বরং ব্যর্থতার দায় রাজ্যের উপরেই চাপিয়েছেন তিনি ৷ বিদায়ী সাংসদ বলেন, "আমি কেন্দ্রে মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে 65 লক্ষ টাকা খরচ করে ফুলিয়াতে কাপড়ের-হাব তৈরি করেছি ৷ সেই কাজ হলেও রাজ্যের কারণে এখনও তা উদ্বোধন হয়নি ৷ তাঁত শিল্পীদের জন্য যে সব কেন্দ্রীয় প্রকল্প রয়েছে, সেগুলি চালু করতে বাধা পেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের জন্য ৷ এখানে ডবল ইঞ্জিন সরকার এলে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন এসে পৌঁছাবে ৷"
তবে জগন্নাথ সরকারের কথা মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূলের শান্তিপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সুব্রত ঘোষ ৷ তিনি বলেন, "গত পাঁচ বছরে এই রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন ৷ তিনি কোনও কাজ করেননি ৷" তাঁর পালটা দাবি তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী জিতলে আগামী দিনে তাঁত শিল্পীদের উন্নতি হবে ৷
হুগলির ধনেখালি
সাংসদের দেখা নেই রে, সাংসদের দেখা নেই ! এমনি ক্ষোভের সুর শোনা গেল হুগলি লোকসভার ধনেখালিতে ৷ অভিযোগ, 2019 সালে সাংসদ নির্বাচিত হলেও পাঁচ বছরে তাঁত শিল্প, শিল্পী এবং সমবায়ের জন্য কিছুই করেননি লকেট চট্টোপাধ্যায় ৷ ফের ভোট এসেছে ৷ তিনিও আসছেন, শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আর ভোট চাইছেন ৷ এই সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ধনেখালিতে আসেন লকেট ৷ কিন্তু সমবায়ের দিকে ঘুরেও তাকান না ৷ এদিকে এবারের বিজেপি প্রার্থী লকেটের দাবি, ধনেখালির তাঁত নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে ৷ ওখানে সাংসদ তহবিলের টাকা খরচ করা যায় না ৷ বাতিল করে দিতে হয় ৷
এখানেও শিল্পীদের দাবি, রাজ্য ও কেন্দ্র মিলে শিল্পীদের জন্য কিছু করুক ৷ সুতো, রং ও অন্য কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা হোক ৷ তাঁতিদের স্বাস্থ্য ও বার্ধক্য ভাতার ব্যাপারে এগিয়ে আসুক সরকার ৷ তাঁতের কাপড় বাজারজাত করার উপর জোর দেওয়া হোক ৷
তাঁতশিল্পী বিশ্বনাথ লাহা বলেন, "তাঁতশিল্পীদের কোনও উন্নতি হয়নি ৷ শিল্পটা নষ্টের মুখে । যে তাঁত শিল্প জিআই তকমা পেয়েছে, আর 15 বছর পর তা নষ্ট হয়ে যাবে ৷ শিল্পীদের জন্য কেউ ভাবেন না ৷" তাঁর আক্ষেপ, একদিকে কাঁচামাল ও রঙের খরচ বেড়েছে, আরেকদিকে কাপড়ের দামও ৷ বাজার ধরেছে সিন্থেটিক সুতো দিয়ে কাপড় ও পাওয়ার লুমের কাপড় ৷ তাতে মার খাচ্ছে ধনেখালির তাঁত ৷
সাংসদ লকেট প্রসঙ্গে শিল্পী বিশ্বনাথ বলেন, "হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় কিছুই করেননি ৷ তাঁকে এর আগে দেখা যায়নি ৷ ভোটের জন্য এখন ধনেখালিতে আসছেন ৷ আগের ভোটে বলেছিলেন তাঁত শিল্পে আমরা গুরুত্ব দেব ৷ করোনার সময় শিল্পীরা কী করছেন, তা দেখতেও আসেননি ৷ তুলনায় এখানকার বিধায়ক অসীমা পাত্র কিছুটা হলেও সহযোগিতা করেন ৷ আমরা সাংসদ করলাম তাঁকে ৷ কিন্তু উপযুক্ত মর্যাদা তিনি দিলেন না ৷"
ধনেখালি সমবায় সমিতির সভাপতি দীনবন্ধু লাহা বলেন, "সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় ধনেখালি সমবায় সমিতি এবং এখানকার গোডাউনে আসেননি ৷ খোঁজখবরও নেননি ৷ এখানকার বিধায়ক এবং আশপাশের বিধায়করা এই সমবায় থেকে কাপড় নিয়ে যান ৷ সাংসদ তো একজন মহিলা, তিনিও তো কাপড় পরেন ৷ এবার যে-ই সাংসদ হোন, তিনি যেন ধনেখালির তাঁত নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন ৷" সোমসপুর তাঁত সমবায় সমিতির বিনয় ভূষণ লাহা বলেন, "বিধায়ক এসে পরামর্শ দেন ৷ কিন্তু সাংসদ সমবায়ে আসেননি ৷ তাহলে তাঁত শিল্প কীভাবে চলবে ? ডিজাইন ভালো না থাকায় সমস্যা হচ্ছে ৷ নতুন প্রজন্মও আসছে না ৷"
আর যে সাংসদকে নিয়ে এত অভিযোগ, সেই লকেট চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, "জিআই ট্যাগ দেওয়া হয়েছে ৷ এটা কেন্দ্রের তরফের ধনেখালির তাঁতের স্বীকৃতি ৷ এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বকর্মা যোজনায় তাঁত শিল্পীরাও সহযোগিতা পাবেন ৷ ধনেখালি তাঁত নিয়ে ভাবনাচিন্তা আছে ৷" তিনিও কিছু না-করতে পারার দায় চাপালেন রাজ্য়ের উপর ৷ লকেটের কথায়, "ওখানে (ধনেখালি) কিছু করা যায় না ৷ ধনেখালিতে সাংসদ তহবিলের টাকা খরচ করা যায় না ৷ ধনেখালির তাঁতের জন্য সাংসদ তহবিলের টাকা বাতিল হয়ে গিয়েছে ৷ আগামী দিনে তাঁতের শাড়ি বিক্রি করার জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করব ৷"
ধনেখালি ব্লকের ধনেখালি সমবায় সমিতি ও সোমসপুর সমবায় সমিতি অন্যতম দু’টি সংস্থা এই শিল্পের ক্ষেত্রে ৷ এখান থেকেই শিল্পীরা সুতো নিয়ে গিয়ে তাঁতের শাড়ি তৈরি করেন ৷ দু’টি সমবায় মিলিয়ে বর্তমানে শিল্পীর সংখ্যা প্রায় 280 জন ৷ তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পীই পঞ্চাশোর্ধ্ব ৷ শিল্পীদের মজুরি কম হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কেউ এই কাজে আসছে না ৷ তাই নতুন কোনও ডিজাইনও তৈরি হচ্ছে না ৷ পুরনো নিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরা ৷ শুধু জিআই ট্যাগ নয়, তাঁত শিল্পীদের কথা তুলে ধরতে চাই জনপ্রতিনিধি ৷ তা কি পাবে শান্তিপুর-ফুলিয়া-ধনেখালি ?
আরও পড়ুন: