মালদা, 7 অক্টোবর: দূর থেকেই কানে আসে গুনগুন শব্দ ৷ সেই আওয়াজ আসে স্কুল থেকে ৷ স্কুলে ক্লাস চলছে ৷ উঁকি দিলেই দেখা যাবে, স্কুলের বারান্দায় গরু-ছাগল ৷ যেন কোনও খাটাল ৷ ক্লাসরুমে গেলে চোখে পড়বে, পড়ুয়ারাই সেখানে শিক্ষক ৷ তারা ক্লাস নিচ্ছে ! একটি ক্লাসে একজন শিক্ষক অবশ্য রয়েছেন ৷ তিনিই একা কুম্ভ হয়ে সবদিক রক্ষা করছেন ৷ আরেকজন শিক্ষিকা অনুপস্থিত, আর পাঁচটা দিনের মতো ৷ 2015 সাল থেকে এমনই হাল হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লকের ভাটোল জুনিয়র হাইস্কুল ৷
তবে, পড়ুয়াদের সংখ্যাও হাতে গোনা ৷ খুব বেশি হলে জনা তিরিশ ৷ যদিও, প্রত্যন্ত এলাকার এই স্কুলে খাতায় কলমে পড়ুয়ার সংখ্যা 367 জন ৷ অথচ স্কুলের নিজস্ব ভবন রয়েছে ৷ রয়েছে চারটি ক্লাসরুম ৷ স্কুলে কোনও পাঁচিল নেই ৷ নির্দ্বিধায় চড়ে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল ৷ অভিযোগ, গ্রামের অনেকে স্কুলের বারান্দাতেই বাড়ির গবাদি পশু বেঁধে রেখে গিয়েছেন ৷ গোবরে ছয়লাপ গোটা বারান্দা ৷
অভিযোগ, অন্ধকার নামলেই স্কুলের মাঠে নাকি মদের আসরও বসছে নিত্যদিন ৷ এই জুনিয়র হাইস্কুলে কোনও স্থায়ী শিক্ষক নেই ৷ রয়েছেন দু’জন পার্শ্বশিক্ষক ৷ তাঁদের মধ্যে একজন স্কুলে অনিয়মিত ৷ ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অবশ্য প্রতিদিনই স্কুলে আসেন ৷ একজন ক্লার্ক থাকলেও, তাঁর দেখা মেলে না ৷ তবে, স্কুলে নিয়মিত মিড ডে মিলের রান্না হয় ৷ সেই খাবার খাওয়ার পরই স্কুল ছুটি ৷ বাড়ি ফিরে যায় সবাই ৷
অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী জানিয়েছে, "স্কুলে শিক্ষকরা আসছেন না ৷ আজ একজন এসেছেন ৷ তাই আমি ক্লাস নিচ্ছি ৷ এভাবেই চলে ৷ এখানে তিনজন রয়েছেন ৷ প্রধান শিক্ষক প্রতিদিন স্কুলে আসেন ৷ তবে, ম্যাডাম রোজ আসেন না ৷ একদিন বাদে একদিন আসেন ৷ ম্যাডামকে এ নিয়ে বলেছিলাম ৷ কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, তাঁর একটা ছোট মেয়ে রয়েছে ৷ তাই তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসতে পারছেন না ৷"
ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক আসরাফুল হক পড়ুয়াদের ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ৷ তিনি বলেন, "2015 সাল থেকেই শিক্ষকের সমস্যা চলছে ৷ সেই সময় ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা 2019 সালে অবসর নেন ৷ তারপর স্কুলে আর শিক্ষক নিয়োগ হয়নি ৷ আমরা দু’জন প্যারাটিচার গোটা স্কুল চালাচ্ছি ৷ 2020 সালে অবশ্য একজন ক্লার্ক নিয়োগ করা হয়েছে ৷ 2024 সালে তাঁর নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয় ৷ তখন থেকে আমরা তিনজনই স্কুল চালাচ্ছি ৷ পার্শ্বশিক্ষিকা শামিমা পারভিন নিয়মিতই স্কুলে আসেন ৷ তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন ৷ তাই এক সপ্তাহ ধরে তিনি স্কুলে আসতে পারেননি ৷ আর ক্লার্ক তো সদ্য কাজে যোগ দিয়েছেন ৷ এই পরিস্থিতিতে স্কুল সামলনোই মুশকিল হয়ে গিয়েছে ৷ সরকারের কাছে অনেকবার শিক্ষক নিয়োগের আবেদন জানানো হয়েছে ৷ কাজ হয়নি ৷ তবে, ছাত্রছাত্রীরা কেউ ক্লাস নেয় না ৷ হয়তো শিক্ষকের অবর্তমানে ক্লাসে শান্তি বজায় রাখতে কেউ কেউ এগিয়ে আসে ৷"
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক কৈলাস চৌধুরীর বক্তব্য, "আমি অনেকদিন থেকেই এই স্কুলের সম্পাদক ৷ আগে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ৷ এখন আর নেই ৷ শিক্ষকের অভাবেই স্কুলটার এই অবস্থা ৷ আর স্কুল নোংরা করে রাখার জন্য দায়ী গ্রামবাসীরা ৷ বারবার বারণ করা সত্ত্বেও তাঁরা স্কুলে গরু-ছাগল বেঁধে আসে ৷ স্কুলটা পরিস্কার রাখার জন্য আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি ৷ আর শিক্ষকরা স্কুলে আসছেন, কি আসছেন না, আমার জানা নেই ৷ স্কুলের সেক্রেটারির প্রয়োজন নেই ৷ আমাকে কেউ ডাকে না, আমিও যাই না ৷" এই বিষয়ে জানানো হলে, জেলা মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শক বাণীব্রত দাস বিষয়টি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন ৷