মালদা, 26 জুলাই: এখনও একতলা আর দোতলার বারান্দায় চাপ চাপ রক্তের দাগ ৷ পুরো বারান্দা জুড়ে রক্তের ফোঁটা ৷ তার মধ্যে দিয়েই শুক্রবার পরীক্ষা দিতে গিয়েছেন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের পরীক্ষার্থীরা ৷ প্রত্যেকের চোখেমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ৷
এদিকে, বৃহস্পতিবারের সেই রোমহর্ষক ঘটনার পর এ দিন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখেন উপাচার্য ৷ সঙ্গে ছিলেন রেজিস্ট্রার-সহ অন্যান্য আধিকারিকরা ৷ এমন ঘটনা আগামীতে যাতে আর কখনও না ঘটে, তার জন্য বেশ কিছু চিন্তাভাবনা করেছেন তাঁরা ৷ অন্যদিকে, মালদা মেডিক্যালে আহত ছাত্র ও ছাত্রীর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ৷ বর্তমানে তাঁদের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে ৷
প্রেমঘটিত কারণে বৃহস্পতিবার রক্তাক্ত হয় গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ৷ 2019 সালে পদার্থবিদ্যার এক প্রাক্তন ছাত্র ধারালো ছুরি দিয়ে প্রকাশ্যে অংক বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের এক ছাত্রীর গলায় একের পর এক কোপ বসাতে থাকেন ৷ কোনোক্রমে তাঁকে নিরস্ত করা হয় ৷ বাধা পেয়ে তিনি ওই ছুরি দিয়ে নিজেও নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ৷ সেই খবর নাড়া দিয়েছে সারা রাজ্য-সহ দেশকেও ৷
আহত ছাত্রীর বাবা ছিলেন রেলকর্মী ৷ কর্মসূত্রে তাঁরা অসমে থাকতেন ৷ অবসরগ্রহণের পর মেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য মালদায় চলে আসেন ৷ বর্তমানে তাঁরা পুরাতন মালদা পৌরসভার মঙ্গলবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন ৷ 2023 সালে ওই যুবতী গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৷ তার আগে মালদারই একটি বেসরকারি বিএড কলেজে দু’বছর পড়াশোনা করেছেন ৷
সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ রতুয়া 2 নম্বর ব্লকের সম্বলপুর গ্রামের অলোক মণ্ডলের সঙ্গে ৷ অলোক এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পদার্থবিদ্যার মেধাবী ছাত্র ৷ 2019 সালে ভালো নম্বর পেয়ে তিনি স্নাতকোত্তর শ্রেণি উত্তীর্ণ হন ৷ তাঁর বাবা সরকারি চাকরিজীবী ৷ দাদা কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী ৷ তেমনটাই জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই যুবতীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী ৷
তিনি আরও জানান, ওই বিএড কলেজেই ওই যুবতীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অলোক ৷ প্রথমে উপেক্ষা করলেও একসময় হার মানতে হয় ওই যুবতীকে ৷ বছর দেড়েক ধরে তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক ৷ কিন্তু অলোক খানিকটা সন্দেহপ্রবণ ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্র কিংবা ছাত্রীর সঙ্গে ওই যুবতী কথা বলুন, তা তিনি চাইতেন না ৷ এসব নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে দু’জনের মধ্যে ঝামেলাও চলছিল ৷ ওই যুবতী অলোকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৷ সেকথা তিনি অলোককে জানিয়ে দিয়েছিলেন ৷ কিন্তু নাছোড়বান্দা অলোক ওই যুবতীর সঙ্গে দেখা করতে প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন ৷ শেষ পর্যন্ত গত পরশু ওই যুবতী নাকি অলোককে হুমকিও দেন, তাঁর পিছন না ছাড়লে তিনি বিষয়টি সবাইকে জানাতে বাধ্য হবেন ৷
এই হুমকিই কি কাল হল ওই যুবতীর ! সেই কারণেই কি গতকাল পরিকল্পনা করে তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালান অলোক ? উত্তর খুঁজছে সবাই৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ভেদ করে অলোক কীভাবে ধারালো ছুরি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকলেন ? তাঁর কাছে তো পরিচয়পত্রও ছিল না ৷ তাহলে কি নিরাপত্তাতেই গলদ ?
এ দিন উপাচার্য পবিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অর্থে নিরাপত্তায় কোনও গাফিলতি নেই ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় সবাইকেই পরিচয়পত্র গলায় ঝোলানো বাধ্যতামূলক ৷ হয়তো পূর্ব পরিচিতির কারণে অনেক সময় আইডি কার্ড দেখা হয় না ৷ অনেক সময় তাড়াহুড়োর জন্যও পড়ুয়ারা গলায় কার্ড ঝোলাতে ভুলে যায় ৷ আর সিসিটিভির ক্যামেরা তো সবসময় 360 ডিগ্রি নজরদারি চালাতে পারে না ৷ ফলে প্রতিটি জায়গায় সিসিটিভির ক্যামেরা থাকলেও একই সময় সব জায়গায় নজরদারি চালানো যায় না ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ছাত্রটি পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ৷ মেয়েটিও অংকের ছাত্রী ৷ ফলে তাদের সিসিটিভি নিয়ে সবই জানা ৷ পড়ুয়াদের বলব, এটা একটা দুর্ঘটনা ৷ আমি তাদের বলব, কেউ যাতে একা একা না ঘোরে ৷ সবসময় যাতে তারা কাউকে সতর্ক করে দেয় ৷ সবাই যেন নিজেদের কথা কারও না কারও সঙ্গে শেয়ার করে ৷ গতকাল যদি মেয়েটির সঙ্গে কেউ থাকত, তবে এমন ঘটনা ঘটত না ৷ আমরা পড়ুয়াদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আছি ৷ তারা আমাদেরও সাহায্য নিতে পারে ৷”
রেজিস্ট্রার বিশ্বজিৎ দাস বলছেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে আজ হাসপাতালে গিয়ে আহত ছাত্রী ও ছাত্রকে দেখে এসেছি ৷ মেডিক্যালের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথাও বলেছি ৷ তিনি জানিয়েছেন, মেয়েটি অনেকটাই বিপন্মুক্ত ৷ তবে ছেলেটির অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক ৷ চিকিৎসকরা সাধ্যমতো তাদের সুস্থ করার চেষ্টা করছেন ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, শিক্ষক, আধিকারিক ও কর্মীরা রক্তের জোগান দিচ্ছেন ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখানে যারা পড়তে আসে, তারা প্রত্যেকেই প্রাপ্তবয়স্ক ৷ নিজের ভালোমন্দ ভালোই জানে ৷ ফলে কারও কতটা স্বাধীনতা, সেটা নিজেদেরই বুঝতে হবে ৷ পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বক্তব্য নেই ৷ ছেলেমেয়েদের হতাশা থেকে বের করে আনতে আমরা একাধিক ওয়ার্কশপ করেছি ৷ হয়তো আরও বেশি সংখ্যায় ওয়ার্কশপ করার প্রয়োজন ছিল ৷ আমরা বিষয়টি দেখছি ৷”
বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সনাতন দাস বলেন, “পুরো ঘটনাটিই অনভিপ্রেত ৷ এমনটা হওয়া উচিত ছিল না ৷ সেই সময় আমাদের পরীক্ষা চলছিল ৷ মেয়েটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কথাবার্তাও হয় ৷ তারপরেও এমন ঘটনায় আমরা বিস্মিত, ভীত ৷ এই ঘটনায় অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন ৷ আমরা সবার ভয় কাটাতে যাবতীয় চেষ্টা চালাচ্ছি ৷”
আতঙ্ক নিয়েই এ দিন পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন সুস্মিতা সাহা ৷ তিনি বলেন, “আমাদের কারও মানসিক অবস্থা ভালো নেই ৷ কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও পরীক্ষা দিতে আসতে হয়েছে ৷ গতকাল ঘটনার সময় এখানেই ছিলাম খুব খারাপ লাগছিল ৷” এর বাইরে আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি সুস্মিতা ৷
তবে তনুশ্রীর আরেক সহপাঠী শুভঙ্কর বর্মন বলেন, “তখন পরীক্ষা চলছিল ৷ তখন স্কলার দাদারা ঘটনাটি আমাদের জানায় ৷ পরীক্ষা শেষ করে বাইরে যাই ৷ আগে জানতে পারলে হয়তো আমরা বিষয়টি আটকাতে পারতাম ৷ তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার কাঙ্খিত নয় ৷ সে যাই হোক না কেন ৷”