আলিপুরদুয়ার, 2 অগস্ট: জঙ্গল থেকে প্রায় দিনই বেরিয়ে আসত হাতির দল । আর গৃহস্থের বাড়ি ঘর যেমন ভাঙচুর করত, তেমনই ফসল খেয়ে চলে যেত তারা । আলিপুরদুয়ার দুই নম্বর ব্লকের বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পূর্ব রাজাভাতখাওয়া রেঞ্জে অবস্থিত গ্রামগুলির এটাই রোজনামচা । হাতির হানার আশঙ্কাতেই দিন শুরু হতো স্থানীয় বাসিন্দাদের ৷ দিন শেষ হতো হাতির হানার আশঙ্কা নিয়েই ৷
সেই আশঙ্কার মেঘ কাটাতে পুরো এলাকাকে পথ দেখাচ্ছে পূর্ব রাজাভাতখাওয়া রেঞ্জেরই একটি গ্রাম ৷ যার নাম পানবাড়ি ৷ সেখানেই হাতির হানা রুখতে সৌর বিদ্যুতের ঝুলন্ত বেড়া লাগানো হয়েছে ৷ সৌর বিদ্যুতের সেই ঝুলন্ত বেড়াই এখন হাতির হানা থেকে বাঁচাচ্ছে পুরো গ্রামকে ।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ফিল্ড ডিরেক্টর অপূর্ব সেন বলেন, ‘‘বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা তাঁদের লভ্যাংশের টাকা দিয়ে এই সৌর বিদ্যুতের বেড়া লাগিয়েছেন । গত মার্চ মাসে পানবাড়ি ও 21 মেইল বস্তি গ্রামে এই কাজ শেষ হয় । তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত গ্রামে হাতি আসার কোনও খবর আমরা পাইনি । চার কিলোমিটার জুড়ে এই ঝুলন্ত বেড়া লাগানো হয়েছে । রাজ্য সরকার পুরস্কৃতও করেছে । বক্সায় ঢোকার গেট ফির টাকা দিয়ে এটা করা হয়েছে । এটা সাধারণ ইলেকট্রিক ফেনসিং নয়, এটা ঝুলন্ত । গত মার্চ মাসে কাজটা শেষ হয়েছে । তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত গ্রামে হাতি ঢোকেনি ।’’
রাজ্যে সম্ভবত প্রথম সৌর বিদ্যুতের বেড়া লাগিয়ে সাফল্য পেল বক্সা টাইগার রিজার্ভের পানবাড়ি গ্রাম । এর ফলস্বরূপ বন মহোৎসবের সময় তাঁদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা পুরস্কারে স্বীকৃত হয় । রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে 75 হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে পানবাড়ি বন সুরক্ষা কমিটিকে ।
বন সুরক্ষা কমিটির সভাপতি সুজিত সরকার বলেন, ‘‘বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের শীর্ষ বন কর্মকর্তাদের কাছে এই ধরনের একটি সুরক্ষা বেড়া তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং অনুমোদনও মেলে । বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা কোনও ঠিকাদারের সহায়তা ছাড়াই তিন মাস আগে প্রকল্পটি শেষ করেন । আমরা গত ছয় বছরে বন সুরক্ষা কমিটির প্রাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করেছি, প্রায় 12 লক্ষ টাকা জমা হয়েছে । এই তহবিল ব্যবহার করে আমরা পানবাড়ি ধামসি বাঁধ থেকে লোয়ারডাঙ্গি পর্যন্ত একটি বেড়া নির্মাণ করেছি ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রায় তিন মাস লেগেছে । বেড়া তৈরির পর গত তিন মাসে গ্রামে একটিও বন্য প্রাণীর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি । এই সাফল্যে আমরা রোমাঞ্চিত । গত তিন মাস ধরে, আমরা হাতিদের বেড়ার কাছে আসতে দেখেছি ও তারপর বনে ফিরেও যেতে দেখেছি । হাতি খুব বুদ্ধিমান আগে সাধারণ ফেনসিংয়ের গাছের ডাল ফেলে ফেসনিং ছিঁড়ে ফেলত । এবার সেটা আর করতে পারছে না ।’’
রাজাভাতখাওয়ার বর্তমান রেঞ্জ অফিসার নুর ইসলাম বলেন, “আমি পানবাড়ির সাফল্যে আনন্দিত । ওই এলাকায় আমার আমলে কাজ শুরু হয় । আশা করি, মানব-হাতি সংঘর্ষ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে ।” নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করা ফসল ও গ্রামবাসীদের প্রাণ বাঁচাতে অভিনব উপায় কাজে লাগিয়ে এই সাফল্যের পর স্বস্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারাও ৷ স্থানীয় বাসিন্দা উজ্জ্বল সরকার, অনিতা সরকার বলেন, ‘‘এই সৌর বিদ্যুতের বেড়া দেওয়ার পর থেকে গ্রামে হাতির হানা হচ্ছে না । আমরা এবার ফসলও ভালো করেছি । এবার লাভের মুখ দেখতে পাব ।’’
ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলোতে নিয়মিত হাতির হানা যেন সেখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের সমস্যা । দিন কিংবা রাত্রি, সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করে ওই সমস্ত গ্রামবাসীদের মনে । একই পদ্ধতি অবলম্বন করে অন্য গ্রামগুলিও সুরক্ষিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে ৷