মালদা, 30 জুলাই: মহিলাদের স্বাবলম্বী করতে নয়া চিন্তাভাবনা রাজ্য সরকারের ৷ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য এবার শহরে শহরে তৈরি করা হবে শপিংমল ৷ একই ছাদের তলায় মহিলাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী পাবেন ক্রেতারা ৷ বহুজাতিক সংস্থার শপিংমলগুলির তুলনায় সামগ্রীর দামও অনেকটা কম থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ এতে ক্রেতারা যেমন একদিকে উপকৃত হবেন, তেমনই উপকৃত হবেন মহিলারা ৷
- স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের সারাবছর রোজগারের রাস্তা খোলা থাকবে ৷ মালদা শহরে ইতিমধ্যে এই মল তৈরির জায়গা চিহ্নিত করে ফেলেছে প্রশাসন ৷ রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরই এই মলগুলি তৈরি করবে ৷ প্রথম পর্যায়ে 10টি শহরে এমন মল তৈরি হবে ৷ খুব দ্রুত সেই মলগুলি চালু করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী ৷ গত 12 জুলাই সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকদের জায়গা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷ মালদা জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে সেই জায়গা চিহ্নিত করে ফেলেছে ৷ মালদা শহরের কেন্দ্রস্থল ফোয়ারা মোড়ে তৈরি হবে সেই শপিংমল ৷
শপিং মল তৈরি নিয়ে বিস্তারিত
এই মুহূর্তে রাজ্যে 12 লাখ 5 হাজার 946টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী রয়েছে ৷ গোষ্ঠীগুলির সদস্য সংখ্যা প্রায় 1 কোটি 23 লাখ ৷ শুধু মহিলা নয়, অনেক গোষ্ঠীতে পুরুষ সদস্যও রয়েছে ৷ তবে শুধুমাত্র মহিলাদের কথা মাথায় রেখেই শপিংমল তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ জানা যাচ্ছে, প্রতিটি মলই হবে পাঁচতারা ৷ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় এমন একটি মল আগেই খোলা হয়েছে ৷ এবার মালদা, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, বহরমপুর, আসানসোল, দুর্গাপুর, বর্ধমান, চন্দননগর, পূর্ব মেদিনীপুর ও দিঘাতেও এমন মল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন ৷
শপিং মল তৈরির সুবিধা-
- রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মহিলাদের সামনে বছরভর রোজগারের একটি পথ খুলে যাবে ৷ বর্তমানে তাঁরা বিভিন্ন সরকারি মেলা এবং উৎসবে স্টল দিতে পারেন ৷ কিন্তু সারা বছর রোজগার করতে তাঁদের নিজেদেরই রাস্তা খুঁজে নিতে হয় ৷ মার্কেটিং করতে না-পারায় অনেকে সারাবছর কাজও করতে পারেন না ৷
- কিন্তু রাজ্যের এই সিদ্ধান্তে তাঁরা সারাবছর কাজ করতে পারবেন ৷ নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী প্রতিদিন নিজেরাই বিক্রি করতে পারবেন ৷ এতে বাংলার হস্তশিল্পের প্রসার ঘটবে ৷ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলার মহিলাদের হাতে তৈরি সামগ্রী ছড়িয়ে পড়বে ৷ বাজার তৈরি হতে পারে বিশ্বজুড়ে ৷ বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, মালদা জেলায় শীতের সময় পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়ে ৷ জলপাইগুড়ি, দিঘা তো রাজ্যের অন্যতম দু'টি পর্যটন কেন্দ্র ৷ শুধু দেশ থেকে নয়, বিদেশি পর্যটকরাও এসব জায়গায় আসেন ৷ তাঁদের হাত ধরে বাংলার নারীদের উৎকর্ষতা পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা দেশজুড়ে ৷
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই শপিংমলগুলি করছে রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দফতর ৷ তারা জেলা প্রশাসনের কাছে জমি চেয়েছে ৷ এর জন্য শহরে দু'তিনটি জায়গা দেখা হয়েছে ৷ তবে ফোয়ারা মোড়ের কাছে 1 নম্বর খতিয়ানের প্রায় 44 শতক সরকারি জমিতেই এই মল তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন ৷
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি মালদার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা ৷ ইংরেজবাজারের কল্যাণপুর এলাকার একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী আনন্দময়ী মূলত আমসত্ত্ব তৈরি করে ৷ আমের বিভিন্ন উপজাত খাদ্যসামগ্রীও তৈরি হয় ৷ ওই গোষ্ঠীর সভানেত্রী যোগমায়া দাস বলেন, "রাজ্যের এই সিদ্ধান্তে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের খুব সুবিধা হবে ৷ তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রীর মার্কেটিং আরও ভালোভাবে হবে ৷ আমাদের মার্কেটিং সংঘ ৷ আমরা জানি কোন ব্লকে, কোন জিনিস ভালো তৈরি হয় ৷"
এই জেলার বিখ্য়াত কী কী- গোষ্ঠীর সভানেত্রী আরও বলেন, "মালদা আমের জন্য বিখ্যাত ৷ আমের প্রচুর উপজাত খাদ্যসামগ্রী তৈরি হয় ৷ হরিশ্চন্দ্রপুরে মাখনা খুব ভালো ৷ এছাড়াও ভূতনির কলাই ডাল, গাজোলের বাঁশের সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে ৷ এমন একটি শপিংমল হলে একই ছাদের তলায় জেলার বিভিন্ন জায়গার হস্তশিল্প কিংবা খাদ্যসামগ্রী মানুষ পেয়ে যাবে ৷ মহিলারাও সঠিক দাম পাবেন ৷ গ্রাহকদের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ হবে ৷ তাঁরা বড় অর্ডার পেতে পারেন ৷ পর্যটকরা সেই মলে আসলে মালদার জিনিস অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে যেতে পারে ৷ তেমন হলে গ্রাম আরও এগিয়ে যাবে ৷"
26 বছর ধরে বাঁশের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করছেন পুরাতন মালদার দীপ্তি মজুমদার ৷ তিনি বলেন, "1998 সালে এই কাজে হাত দিয়েছি ৷ 2022 সালে বিভিন্ন মেলা আর উৎসবে স্টল দিয়েছি ৷ ফুলদানি, ঝাড়বাতি, হেয়ার ক্লিপ-সহ মোট 20 ধরনের জিনিস তৈরি করি ৷ আমাদের জন্য কোনও শপিংমল তৈরি হলে খুব ভালো হবে ৷ এতে বিক্রি যেমন বাড়বে, তেমনই বাইরের লোকজনও এই জেলায় হস্তশিল্প সম্পর্কে জানতে পারবে ৷ শুধু আমি নই, আমার মতো স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রতিটি মহিলা এতে উপকৃত হবেন ৷"
জামাকাপড় সেলাই, শাড়ির উপর বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য নীতু ত্রিপাঠী ৷ তাঁর মতে, "এখন বিভিন্ন সরকারি মেলা, শিলিগুড়ির স্টল কিংবা উৎসবের দিনগুলিতে স্টল দিয়ে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করি ৷ কিন্তু বাড়ি থেকে কিছু বিক্রি হয় না ৷ তাই আমরা সবসময় এসব জিনিস বানাই না ৷ বছরে মাস-দুয়েক এই কাজ করি ৷ বাকি সময়টা অন্য কাজ ৷ রাজ্য সরকার আমাদের জন্য শপিংমল করলে আমরা সারা বছর এই কাজ করে যেতে পারব ৷ উৎপাদিত জিনিস বছরভর বিক্রিও করতে পারব ৷ রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ সফল হলে গোষ্ঠীর প্রতিটি মহিলার উপার্জন বাড়বে ৷
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী তজমুল হোসেন বলেন, "যেসব জায়গায় ব্যবসা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই জায়গাগুলিতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য শপিংমল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে ৷ এককথায় মহিলাদের স্বাবলম্বী করতে রাজ্য সরকার এবার বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চলেছে ৷"