রায়গঞ্জ, 23 এপ্রিল: উপরে চা, নিচে ধান ৷ দুই চাষে ভরপুর উত্তর দিনাজপুর জেলা ৷ একটিই লোকসভা কেন্দ্র, রায়গঞ্জ ৷ এবারের নির্বাচনে মানুষের সবচেয়ে বেশি চর্চা এই কেন্দ্রের তিন প্রার্থীকে নিয়ে ৷ সব সমস্যা ছাপিয়ে এখন আলোচনায় দলবদলু তিন প্রার্থী ৷ তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণী, বিজেপির কার্তিকচন্দ্র পাল কিংবা কংগ্রেসের আলি ইমরান রমজ ওরফে ভিক্টর, তিন জনই নিজেদের দল ছেড়ে অন্য শিবিরে এসে এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৷
ঊনিশের ভোটে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী ৷ বালুরঘাটের বাসিন্দা দেবশ্রী কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীও হয়েছিলেন ৷ এবার তিনি দক্ষিণবঙ্গে দলের ঝান্ডা তুলে ধরার দায়িত্ব পেয়েছেন ৷ তাঁকে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা আসনে প্রার্থী করা হয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতে এই কেন্দ্রে এবার কিন্তু মূল ফ্যাক্টর হতে চলেছেন ভিক্টর ৷ তেমনটাই বলছে জেলার রাজনৈতিক মহল ৷
উত্তর দিনাজপুরের নাম উঠলেই সবার আগে চলে আসে আইনশৃঙ্খলার বিষয় ৷ বাংলাদেশ সীমান্ত, দারিদ্রতা, বালি-জমির মাফিয়ারাজ, জলাভূমি বুজিয়ে দেওয়া, একের পর এক খুন, রাজনৈতিক সংঘর্ষ এই জেলায় নিত্যদিনের বিষয়৷ কিডনি বিক্রির দালাল চক্রও এই জেলায় অত্যন্ত সক্রিয়৷ দুর্বল রেল যোগাযোগ, মেডিক্যালে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা, বাংলাদেশ সীমান্তে পাচারের মতো আরও বহু সমস্যা রয়েছে ৷ এসব সমস্যা নিয়েই আগামী 26 এপ্রিল নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবেন এই কেন্দ্রের প্রায় 15 লাখ ভোটার ৷
রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করণদিঘি, হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র ৷ ঊনিশের লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী, তৃণমূলের কানাইয়ালাল আগরওয়াল, সিপিএমের মহম্মদ সেলিম ও কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি ৷ 5 লাখ 11 হাজার 652 ভোট (40.1 শতাংশ) পেয়ে জয়ী হন দেবশ্রী ৷ তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কানাইয়ালাল আগরওয়াল পান 4 লাখ 51 হাজার 78 (35.3 শতাংশ) ভোট ৷ মহম্মদ সেলিম 1 লাখ 82 হাজার 35 ভোট (14.3 শতাংশ) পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন ৷ সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয় দীপার ৷ তিনি পান মাত্র 83 হাজার 662 ভোট (6.6 শতাংশ) ৷
একসময় রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্র ছিল প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির খাসতালুক ৷ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে মালদার চাঁচল ও হরিশ্চন্দ্রপুর বিধানসভা কেন্দ্র এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৷ এখান থেকে জিতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করেছিলেন প্রিয় ৷ সেই সময় এই জেলায় এক অদ্ভুত বিষয় দেখা যেত ৷ লোকসভা আর বিধানসভা ভোটে মানুষের রায় অনেকটাই পালটে যেত ৷ এগারোর বিধানসভা নির্বাচনেও সেই ছবি দেখা গিয়েছে ৷ ওই ভোটে ইসলামপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী আবদুল করিম চৌধুরী হারিয়ে দেন সিপিএমের সায়েদা ফারহাদ আফরোজকে ৷
গোয়ালপোখরে জয়ী হন কংগ্রেসের গোলাম রব্বানি৷ হারান ফরওয়ার্ড ব্লকের সাইফুর রহমানকে ৷ চাকুলিয়াতে জয়ী হন ফরওয়ার্ড ব্লকের আলি ইমরান রমজ ওরফে ভিক্টর ৷ পরাজিত হন কংগ্রেসের সেরাজুল ইসলাম ৷ করণদিঘিতেও ফরওয়ার্ড ব্লকের গোকুলবিহারী রায় জয়ী হন ৷ পরাজিত হন কংগ্রেসের সুভাষ গোস্বামী ৷ হেমতাবাদে জয়ী হন সিপিএমের খগেন্দ্রনাথ সিনহা ৷ পরাজিত হন তৃণমূলের শেখরচন্দ্র রায় ৷ কালিয়াগঞ্জ আসন থেকে জয়ী হন কংগ্রেসের প্রমথনাথ রায় ৷ তিনি সিপিএমের ননীগোপাল রায়কে পরাজিত করেন৷ রায়গঞ্জ আসনে কংগ্রেসের মোহিত সেনগুপ্ত সমাজবাদী পার্টির কিরণময় নন্দকে পরাজিত করেন ৷
ষোলোর বিধানসভা নির্বাচনে ইসলামপুর কেন্দ্রে জয়ী হন কংগ্রেসের কানাইয়ালাল আগরওয়াল ৷ হারিয়ে দেন তৃণমূলের আবদুল করিম চৌধুরীকে ৷ গোয়ালপোখরে তৃণমূল প্রার্থী গোলাম রব্বানি কংগ্রেসের আফজল হোসেনকে পরাজিত করেন ৷ চাকুলিয়া কেন্দ্রে ফের জয়ী হন ফরওয়ার্ড ব্লকের ভিক্টর ৷ পরাজিত করেন বিজেপির অসীমকুমার মৃধাকে ৷ করণদিঘিতে তৃণমূল প্রার্থী মনোদেব সিংহের কাছে পরাজিত হন ফরওয়ার্ড ব্লকের গোকুলবিহারী রায় ৷ হেমতাবাদে জয়ী হন সিপিএমের দেবেন্দ্রনাথ রায় ৷ পরাজিত হন তৃণমূলের সবিতা ক্ষেত্রী ৷ কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের বসন্ত রায়কে হারিয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন কংগ্রেসের প্রমথনাথ রায় ৷ রায়গঞ্জ কেন্দ্রে জয়ী হন কংগ্রেসের মোহিত সেনগুপ্ত ৷ তিনি তৃণমূলের পূর্ণেন্দু দে-কে পরাজিত করেন ৷
ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে ইসলামপুর ও কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৷ সেই উপনির্বাচনে ইসলামপুরে তৃণমূলের আবদুল করিম চৌধুরী হারিয়েছিলেন বিজেপির ড. সৌম্যরূপ মণ্ডলকে ৷ কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলেরই তপন দেব সিংহ পরাজিত করেছিলেন বিজেপির কমলচন্দ্র সরকারকে ৷
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর দিনাজপুর জেলায় বড়সড় জয় পেয়েছে ঘাসফুল ৷ ইসলামপুরে জিতেছেন আবদুল করিম চৌধুরী৷ হারিয়েছেন বিজেপির ড. সৌম্যরূপ মণ্ডলকে ৷ গোয়ালপোখরে তৃণমূল প্রার্থী গোলাম রব্বানি বিজেপির গোলাম সারওয়ারকে পরাজিত করেন ৷ চাকুলিয়ায় জয় পান তৃণমূলের মিনহাজুল আরফিন আজাদ ৷ পরাজিত হন বিজেপির শচীন প্রসাদ ৷ করণদিঘিতে বিজেপির সুভাষচন্দ্র সিনহাকে পরাজিত করেন তৃণমূলের গৌতম পাল ৷ হেমতাবাদে জয়ী হন তৃণমূলের সত্যজিৎ বর্মন ৷ পরাজিত হন বিজেপির চাঁদিমা রায় ৷ কালিয়াগঞ্জে বিজেপির সৌমেন রায়ের কাছে পরাজিত হন তৃণমূলের তপন দেব সিংহ ৷ রায়গঞ্জ কেন্দ্রে জয়ী হন বিজেপির কৃষ্ণ কল্যাণী ৷ পরাজিত হন তৃণমূল প্রার্থী কানাইয়ালাল আগরওয়াল ৷
এবারের নির্বাচনে মানুষের রায় কোন দিকে যাবে, তা কোটি টাকার প্রশ্ন ৷ তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় মিত্র বলছেন, “রায়গঞ্জ কেন্দ্রে শুভ মনোভাবাপন্ন মানুষের বসবাস ৷ তাঁরা শান্তিপ্রিয় ৷ সারা বাংলার সঙ্গে এখানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নয়নের স্রোত বইয়ে দিয়েছেন ৷ উন্নয়ন হয়েছে শহর থেকে গ্রামে ৷ তার সঙ্গে রয়েছে তাঁর একাধিক সামাজিক প্রকল্প৷ তাই মানুষ বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভরসা ৷ এবার আমরা দু’লাখের বেশি ভোটে জিতব ৷”
বিজেপির জেলা সভাপতি বাসুদেব সরকার আবার নিজেদের সংগঠনের উপর ভরসা করেই ভোটে জিততে চান ৷ তিনি বলেন, “ঊনিশের ভোটে মানুষ আমাদের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল ৷ আমাদের প্রার্থী সাংসদ নির্বাচিত হয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন ৷ এই পাঁচ বছরে আরও কয়েকটি ভোট হয়েছে ৷ এই সময়কালে আমাদের সাংগঠনিক শক্তিও অনেক বেড়েছে ৷ এখন বুথস্তরেও আমাদের সংগঠন অনেক শক্তিশালী ৷ মানুষের আশীর্বাদ আর নিজেদের শক্তিশালী সংগঠনের উপর ভর করে আমাদের প্রার্থী এবারও এই কেন্দ্রে জিতছেন ৷ এতে রায়গঞ্জে মোদিজির উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে ৷”
তবে কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক তুষার গুহর দাবি, “এই লোকসভা কেন্দ্রের গণতন্ত্র সচেতন মানুষ সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ৷ তাই 1998 সালে প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়ে প্রিয়দা হেরে গিয়েছিলেন ৷ মানুষ প্রথমে তাঁকে বিশ্বাস করেনি, ভরসা করেনি ৷ 1999 সালে তিনি নির্বাচিত হন ৷ ঊনিশের ভোটে বিজেপিকে জিতিয়ে মানুষ ফল দেখে নিয়েছে ৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকলেও এখানে কোনও উন্নয়ন হয়নি ৷ তাই এবার বিজেপি আগের সাংসদকে সরিয়ে দিয়েছে ৷ এটাই আমাদের বড় জয় ৷ আমরা আশাবাদী, একসময় কংগ্রেসের গড়কে মানুষ ফের কংগ্রেসের হাতে ফিরিয়ে দেবে ৷”
আরও পড়ুন: