কলকাতা, 22 জুলাই: বর্তমান সমাজ ও রাজনীতিতে গঙ্গা-যমুনী তেহজিব কথাটি প্রায়ই শোনা যায় । আন্তর্ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের ইতিহাসের শিকড় খুঁজতে গেলে আমরা পৌঁছে যাব একেবারে মধ্যযুগে, যখন আফজল, সৈয়দ আলায়ল, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মার্তুজা, আলি রেজার মতো কবিরা রচনা করেছিলেন অনবদ্য রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ । আর এযুগে জগন্নাথ নিয়ে চর্চা এবং গবেষণা করে চলেছেন সেন্ট পলস কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শেখ মকবুল ইসলাম ।
শেখ মকবুল ইসলাম জানান যে, আগেও বহু মানুষ জগন্নাথ ও শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন । তবে তিনি শ্রীজগন্নাথ দেবকে নিয়ে প্রথমবার সুমারিভিত্তিক কাজ শুরু করেন । শুধু দেশের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরেও যেখানে যেখানে শ্রীজগন্নাথের প্রভাব রয়েছে, সেই সব জায়গার মন্দিরগুলিতে ঘুরে ঘুরে সুমারি করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি । এছাড়াও জগন্নাথ মন্দিরগুলির ইতিহাস, তথ্য, সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিতে তার প্রভাব খুঁজে বের করেছেন এই অধ্যাপক । মন্দিরগুলির চিত্র, শিল্পী, মূর্তি শিল্প, মন্দির শিল্প এবং পূজার্চনা বিধিতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যে পার্থক্য রয়েছে তাও তাঁর অন্বেষণের বিষয় ।
তবে গোড়ার দিকে তিনি কাজ শুরু করেন সনাতন ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের তুলনামূলক বিষয় নিয়ে ৷ বিশেষত গীতা ও কোরানের তুলনামূলক চর্চা ছিল তাঁর গবেষণার প্রথম ধাপ । তারপর চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণ ও ইসলাম নিয়ে কাজ করেন । এরপর জগন্নাথদেবের ও ইসলামের তুলনাধর্মী কাজ করেন তিনি ।
অনেক ছোটবেলায় হাওড়া জেলার বাগনানে জন্ম হলেও পরে তিনি শহরে চলে আসেন । তবে তিনি জানান, "সেই গ্রামে কয়েক ঘর বৈষ্ণব ছিলেন ৷ তাই ছোটবেলা থেকেই তাঁদের কাছে আমরা বড় হয়ে উঠি । এরপর কলকাতায় যেখানে থাকতাম সেখানেও অনেক ওড়িশার মানুষজন থাকতেন, যাঁরা ছিলেন উৎকলীয় বৈষ্ণব । তাঁদের কাছে জগন্নাথদেবের অনেক গল্প শুনতাম । তাঁদের ঘরেও জগন্নাথ বিগ্রহ ছিল । তাই সেই গল্প শুনতে শুনতে এবং জগন্নাথ দেবকে দেখতে দেখতে শ্রীজগন্নাথের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় । আর সেই আগ্রহ আর ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি ।"
তুলনামূলক ধর্ম চর্চার একটা অঙ্গ হল শ্রীজগন্নাথ চর্চা । আর সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে, শ্রীচৈতন্য বা জগন্নাথদেব শুধুমাত্র ওড়িশার পুরী বা পশ্চিমবঙ্গেই সীমাবদ্ধ নন । তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে রয়েছে থাইল্যান্ড, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো বিশ্বের একাধিক জায়গায় ।
প্রায় তিন শতক ধরে তিনি জগন্নাথ চর্চায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন । দেশে বিদেশে স্বীকৃত হয়েছে তাঁর কাজ । এমনকি পুরীর জগন্নাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর এই নিরলস কাজের জন্য 'নবকলেবর পুরস্কারে' ভূষিত করেছে । জগন্নাথের উপর গবেষণার ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ সম্মান ৷ পুরী ধামের শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ 2015 সালে অধ্যাপকের হাতে এই সম্মান তুলে দেন । কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ ফেলো হিসাবে তিনি তাঁর গবেষণা জীবন শুরু করেছিলেন ।
বর্তমানে হাওড়ার কদমতলার বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাসিন্দা শেখ মকবুল ইসলামের বাড়িতে প্রতি রথযাত্রার দিন স্থানীয় শিশুদের নিয়ে হয় বিরাট উৎসব । নিজের ধর্মের প্রতিও তিনি সমান নিষ্ঠাবান । শ্রীজগন্নাথ নিয়ে গবেষণার জন্য উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডিলিট সম্মান দেওয়া হয় । তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কমপারেটিভ ফোকলোর - অ্যাপ্রিসিয়েটিং বেঙ্গল - ওড়িশা কালচারাল রিলেশন ৷ এছাড়াও তাঁর গবেষণার একটা বড় অংশে রয়েছে বাংলার লোকসংস্কৃতি ।
57 বছর বয়সি অধ্যাপক ইসলাম তাঁর গবেষণার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে । বাংলায় তিনি 300টিরও বেশি মন্দিরে ঘুরেছেন, বাংলাদেশে 40টি জেলার প্রায় 150র উপর মন্দিরে গিয়েছেন ৷ এছাড়াও নেপাল, কলম্বো, মায়ানমার থাইল্যান্ডেও একাধিক মন্দিরে গিয়েছেন তিনি ।
তবে এখানেই শেষ নয়, তিনি জানান যে, ভবিষ্যতে বাংলা ভাষায় শ্রীজগন্নাথকে নিয়ে যত কাজ হয়েছে সেগুলিকে একত্রিত করে এবং আর্কাইভ তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর । এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশে, যেখানে যেখানে বাঙালিরা বিশেষ করে বৈষ্ণবরা বসবাস শুরু করেছিলেন, সেই সব জায়গায় জগন্নাথ চর্চার কী স্থিতি, এই বিষয়টি নিয়ে সবে কাজ শুরু করেছেন তিনি ৷
তবে তাঁর আক্ষেপ, বাংলায় জগন্নাথ চর্চা বাংলা সাহিত্যের পরিসরে উপেক্ষিত ৷ জগন্নাথ সাহিত্য পড়ানো হয় না । তাই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এই কাজ শুরু হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন শেখ মকবুল ইসলাম ৷