বোলপুর, 23 ডিসেম্বর: শুরু হল পৌষ উৎসব ও ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলা । বৈতালিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের পাঠ, বাউল গানের মধ্যে দিয়ে 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ' শান্তিনিকেতনে শুরু হল পৌষমেলা ৷ 28 ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই মেলা । 2019 সালের পর ফের পূর্বপল্লির মাঠে প্রথা মেনে হচ্ছে পৌষমেলা ৷ তাই বাড়তি উন্মাদনা রয়েছে সকলের মধ্যে ৷
2019 সালে শেষবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলা করেছিল ৷ 2020 সালে কোভিড পরিস্থিতির জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল মেলা ৷ এরপর বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত চরমে পৌঁছয় । এর ফলে 2021, 22 ও 23 সালে মেলার আয়োজন করেনি ট্রাস্ট ও বিশ্বভারতী ৷ তবে এবার ফের পূর্বপল্লির মাঠে ফিরল পৌষমেলা ।
সোমবার সকালে গৌরপ্রাঙ্গণে বৈতালিক, ছাতিমতলায় বৈদিক মন্ত্রপাঠ, রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বিনয়কুমার সরেনের পাঠের মধ্যে দিয়ে শুরু হল পৌষ উৎসব । ছিল বাউল গানও ৷ 28 ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই মেলা ৷ মেলার দিনগুলিতে মেলাপ্রাঙ্গণ ও বিশ্বভারতীর নানান জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, বই প্রকাশের অনুষ্ঠান থাকছে ৷ চার বছর পর মেলা ফেরায় উচ্ছ্বাসিত সকলেই ৷
বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বিনয়কুমার সরেন বলেন, "সবাই উৎসবে অংশ নিক, আনন্দে মাতুক ৷ সকাল থেকে প্রথা মেনে শুরু হয়েছে পৌষ উৎসব ও পৌষমেলা ।" বিশ্বভারতীর ছাত্রীদের মধ্যে কোয়েল মুখোপাধ্যায়, শুশ্বেতা দাশগুপ্ত, পারমিতা ভট্টাচার্য, চিরশ্রী রায় বলেন, "সকাল থেকে ছাতিমতলায় সুন্দর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পৌষ উৎসব ও মেলা উৎসব শুরু হয়েছে । 2019-এর পর সেই চেনা ছন্দে মেলা হচ্ছে, এটা খুবই আনন্দের ৷ সবাই এটাই চেয়েছিলাম । মেলার কয়েক দিন শুধু ঘোরাঘুরি ও খাওয়া-দাওয়া ৷"
কীভাবে, কখন এই পৌষমেলার সূচনা হয়েছিল ?
1843 সালে 21 ডিসেম্বর (7 পৌষ) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রহ্মধর্মে দীক্ষিত হন । এরপরেই ব্রহ্মধর্মের প্রসার ও প্রচার বৃদ্ধি পায় । দীক্ষিত হওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ও ব্রহ্মধর্মের প্রসারের স্বার্থে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1845 সালে কলকাতার গোরিটির বাগানে উপাসনা, ব্রহ্ম মন্ত্রপাঠের ব্যবস্থা করেন । এটিই পৌষমেলার সূচনা বলে ধরা হয় ।
পরবর্তীকালে 1862 সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আবিষ্কার করে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু করেন । 1891 সালে (7 পৌষ) ব্রহ্ম মন্দির বা উপাসনা গৃহ প্রতিষ্ঠা হয় । এটিকে শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসব সূচনার সময় হিসাবে ধরা হয় । 1894 সালে এই পৌষ উৎসবের পাশাপাশি মন্দির সংলগ্ন মাঠে শুরু হয় পৌষমেলা ।
অন্যদিকে, 1888 সালের আট মার্চ মহর্ষি ন্যাস বা ট্রাস্ট ডিডে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌষমেলা সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ করে যান যে, শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট প্রতি বছর একটি মেলা বসাবে । এই মেলা মূলত, সকল ধর্মের মানুষের মিলন ক্ষেত্র হবে, কোনও প্রকার মূর্তি পুজো হবে না, কুৎসিত আমোদ উল্লাস হবে না, মদ্য, মাংস ব্যতীত এই মেলায় সকল প্রকার খাদ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হবে । এই ডিডে আরও বলা রয়েছে, যদি এই মেলা থেকে কোনও প্রকার আয় হয়, সেই টাকা আশ্রমের উন্নতি কল্পে ব্যয় করা হবে ।
1941 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণে মেলা বসলেও তা প্রাণহীন ছিল । 1943 সালে দেশে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের জন্য পৌষমেলা বন্ধ ছিল । 1944 সাল থেকে মেলার সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হয় । 1950 সালে মেলার পরিসর বাড়তে থাকায় ব্রহ্ম মন্দিরের পরিবর্তে ছাতিমতলায় উপাসনা শুরু হয় । এরপরে 1961 সালে এই পৌষমেলার স্থান পরিবর্তন হয় । মন্দির সংলগ্ন মাঠ থেকে মেলা পূর্বপল্লির মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় । সেই থেকে এই মাঠেই চলে আসছে মেলা ।