কলকাতা, 16 জুলাই: গত মাসে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে বাংলা ৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রশ্নের মুখে যাত্রী সুরক্ষা ৷ রেলের চালকের বিনা ছুটিতে দিনের পর দিন কাজের অভিযোগ সামনে আসছে ৷ এরপরেই এবার প্রশ্ন উঠছে মেট্রো রেলে কতটা সুরক্ষিত যাত্রীরা ? কারণ এখানে চালকদের হাতেই রয়েছে যাত্রীদের নিরাপত্তা ৷
শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের অভিযোগ, স্মার্ট হচ্ছে মেট্রো পরিষেবা ৷ অথচ বর্তমানে মেট্রোর অন্যান্য বিভাগের মতই চালকের অভাব রয়েছে কলকাতাতেও । তাই এক একজন চালককে বাড়তি চাপ নিয়ে মেট্রো চালাতে হচ্ছে । পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত ছুটিও ৷ অথচ কলকাতার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে নির্ঝঞ্ঝাতে অনেক অল্প সময় পৌঁছতে মেট্রোই যাত্রীদের একমাত্র ভরসা। তবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাত্রীদের পৌঁছে দিচ্ছেন যাঁরা অর্থাৎ মেট্রো চালকরা, তাঁরা কেমন আছেন, কেউ জানতে চায় কি ?
আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত মেট্রো রেলওয়ে প্রগতিশীল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শুভাশিস সেনগুপ্ত বলেন, "মেট্রো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ হচ্ছে ৷ তবে এভাবে সম্প্রসারণ করে পুরো ব্যবস্থাকে সুগমভাবে পরিচালনা করতে হলে যে পরিকাঠামো এবং কর্মী সংখ্যার প্রয়োজন পরে, তা বর্তমানে মেট্রোর কাছে নেই। যারা অবসর নিচ্ছেন সেই শূন্যপদে নতুন করে আর নিয়োগ করা হচ্ছে না। তাই বর্তমানে যেই চালকরা রয়েছেন তাঁদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে । আর অনেক আগে থেকেই দমদম ও কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনে মোটর ম্যানদের জন্য বিশ্রামকক্ষের ব্যবস্থা ছিল ৷ তাই এটা নতুন কোনও বিষয় নয়।"
বর্তমানে কলকাতা এবং শহরতলিতে মেট্রোর চারটি করিডোর চালু রয়েছে। নর্থ-সাউথ করিডোর বা ব্লু লাইন (দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ), ইস্ট-ওয়েস্ট করিডোর বা গ্রিন লাইন (শিয়ালদা থেকে সেক্টর ফাইভ ও এসপ্লানেড থেকে হাওড়া ময়দান) অরেঞ্জ লাইন (কবি সুভাষ থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা রুবি) ও পার্পেল লাইন (জোকা থেকে মাঝেরহাট)। এই বছরেই ইয়োলো লাইন অর্থাৎ নোয়াপাড়া থেকে কলকাতা বিমানবন্দর পর্যন্ত পরিষেবা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। চালক এবং মেট্রো কর্মী সংগঠনগুলির দাবি, বর্তমানের চারটি রুট চালাতে হলে বহু সংখ্যক চালকের প্রয়োজন ৷ তবে তার থেকে অনেকটাই কম সংখ্যক চালক দিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিষেবা।
পাশাপাশি বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে মেট্রোয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। এছাড়াও অবসর নিচ্ছেন চালকরা। তাই যত দিন যাচ্ছে চালকদের অভাব আরও বেশি করে প্রকট হচ্ছে । নতুন রুট চালু হলে স্বাভাবিকভাবেই যে কর্মরত চালকদের উপরে আরও বাড়তি চাপ বাড়বে এবং এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে পরিষেবা সেটা একপ্রকার স্পষ্ট। বর্তমান মেট্রো নেটওয়ার্ক এবং অদূর ভবিষ্যতে নেটওয়ার্ক চালিয়ে যেতে প্রয়োজন 310 জন মেট্রো কর্মীর। তবে বর্তমানে এই সংখ্যাটি হল 260 জন। এছাড়াও অভাব রয়েছে ক্রু কন্ট্রোলার, লোকো ইন্সপেক্টর, শান্টার ও চিফ লোকো ইন্সপেক্টরের।
সূত্রের খবর, সুগম পরিষেবা দিতে যত সংখক মেট্রো চালকদের প্রয়োজন তত সংখক চালকও নেই বর্তমানে। এমনকী মেট্রোর সবকটি বিভাগেই কর্মী সংখ্যা অপ্রতুল । তবে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে এই অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়েই । জানা গিয়েছে, শুধুমাত্র সাপ্তাহিক ছুটি পাচ্ছেন চালকরা ৷ কিছুদিনের জন্য একসঙ্গে ছুটির প্রয়োজন থাকলে সেটা তাঁরা পাচ্ছেন না । তাই অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক চাপের মধ্যে গাড়ি চালাতে হচ্ছে চালকদের। মেট্রো পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চালক এবং অন্যান্য কর্মীদের মানসিক স্থিরতা বাড়াতেই তাঁদের জন্য যোগব্যয়াম এবং মেডিটেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
নিয়োগ বন্ধ থাকায় চালক বা অন্য বিভাগে কর্মী প্রয়োজন হলে পূর্ব রেল বা দক্ষিণ পূর্ব রেল থেকে কর্মীদের বেশ কিছু বছর ধরে কলকাতা মেট্রোয় বদলি করা হচ্ছে । তবে সেই প্রক্রিয়াও নিয়মিত নয়, অন্যান্য বিভাগে অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী দিয়ে কাজ চালানো হলেও চালকরা অস্থায়ী নন । চালকরা যদি পর্যাপ্ত ছুটি বা বিশ্রাম না পান, সেই ক্ষেত্রে কতটা মাথা ঠান্ডা রেখে তাঁরা তাঁদের দ্বায়িত্ব পালন করতে পারবেন সেই বিষয় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ।
অল ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট ভারতীয় মজদুর সংঘ অনুমোদিত ক্যালকাটা মেট্রো রেলওয়ে কর্মচারী সংঘের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ সাহা জানান, মেট্রোরেল উন্নত হচ্ছে। মেট্রো যাত্রী বান্ধব করে তুলতে ইউপিআই পরিষেবার থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক পরিষেবা চালু করা হচ্ছে। পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বাইরের সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে । এতদিন যাত্রীরা কাউন্টারে এসে টিকিট কাটতেন বা নিজের স্মার্ট কার্ড রিচার্জ করতেন ৷ তাঁকে এখন কিন্তু আর সেভাবে কাউন্টারে আসতে হচ্ছে না।
তাঁর কথায়, মেশিনের সাহায্যে নিজেই নিজের টোকেন নিতে পারছেন বা স্মার্ট কার্ড রিচার্জ করে নিতে পারছেন যাত্রীরা। এর ফলে ধীরে ধীরে কর্মী সংখ্যার উপরেও কোপ পড়তে চলেছে । মেট্রোয় নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে থাকায় বিভিন্ন বিভাগে কর্মী সংখ্যা সংকুচিত হচ্ছে । যেই চালকদের হাতেই যাত্রীদের নিরাপত্তা সেই চালকদের সংখ্যাও অনেক কম ৷ তাই একজনকে বাড়তি চাপ নিয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে । এর ফলে প্রশ্নের মুখে পড়ছে যাত্রী পরিষেবা ও সুরক্ষা । তার সঙ্গে সঙ্গে রেল কর্মচারীর সুরক্ষা প্রশ্ন চলে আসছে এবং সবরকম বেসরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে ।
কলকাতা মেট্রোর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্রর অবশ্য এ বিষয়ে সাফাই, "রাস্তাঘাটেও তো মানুষজন ইউপিআইর মাধ্যমে টাকা মেটান ৷ তাহলে কি দোকানদার উঠে গিয়েছে? মেট্রোয় কর্মী সংখ্যা কমেনি এবং কমবেও না ।"