মালদা, 2 মে: একদিকে বাংলাদেশ, একদিকে বিহার, আরেকদিকে ঝাড়খণ্ড ৷ গোটা দেশের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ৷ চোরাকারবারি এবং দুষ্কৃতীদের ‘গোল্ডেন করিডর’ ৷ সেই কারণেই দেশের জাল টাকা কারবারে কুখ্যাত মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র ৷ কারবারের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাদক, এমনকি নানাবিধ অস্ত্রও ৷ রয়েছে বিস্তীর্ণ আম-লিচুর বাগান, রেশম চাষ ৷
2009 সালে আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে ও পরে এই কেন্দ্র কংগ্রেসের মৃগয়াভূমি ৷ গত চারটি নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন প্রয়াত গনি খানের ছোট ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী ৷ শারীরিক সমস্যায় এবার তিনি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছেন ৷ পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও এই জেলায় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা মাথায় রেখে এই কেন্দ্রে এবার আবু হাসেমের ছেলে ইশা খান চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে এআইসিসি ৷
আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাজ্য সীমান্ত ঘেরা এই কেন্দ্রে শুধুমাত্র চোরা কারবারই সমস্যা নয় ৷ গঙ্গা ভাঙন এই এলাকার প্রধান সমস্যা ৷ প্রায় প্রতি বছরই গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ৷ খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিতে হচ্ছে মানুষকে ৷ একসময়ের জমিদার লহমায় পরিণত হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিকে ৷ অথচ ভাঙন রুখতে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ৷ রেশম উৎপাদনের হাব বলে জেলায় পরিচিত এই এলাকা ৷ অথচ এখানে সঠিক বাজার গড়ে ওঠেনি ৷ তৈরি হয়নি রেশমি বস্ত্র উৎপাদনের পরিকাঠামো ৷ অনেক রেশমচাষি ইতিমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন ৷ ধুঁকছে এই শিল্প৷ বিড়ি উৎপাদনেও রাজ্যে উপরের দিকে রয়েছে এই এলাকা ৷ কিন্তু শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পান না ৷ তাঁরা মধ্যবর্তীদের শিকার ৷ রয়েছে কালিয়াচক পৌরসভা গঠনের দাবি ৷ মালদায় উড়ান চালুর দাবি ৷ এসব নিয়েই আগামী 7 মে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন এই কেন্দ্রের 17 লাখ 81 হাজার 451 জন ভোটার ৷
মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে ইংরেজবাজার, মানিকচক, মোথাবাড়ি, বৈষ্ণবনগর, সুজাপুর, ফরাক্কা ও সামশেরগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র ৷ এর মধ্যে ফরাক্কা আর সামশেরগঞ্জ মুর্শিদাবাদ জেলায় ৷ ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল মূল তিন দলের মধ্যে৷ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী, তৃণমূলের মোয়াজ্জেম হোসেন ও কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী ৷ শ্রীরূপা পেয়েছিলেন 4 লাখ 36 হাজার 48টি ভোট (34.07 শতাংশ), মোয়াজ্জেম পান 3 লাখ 51 হাজার 353 ভোট (27.45 শতাংশ), 4 লাখ 44 হাজার 270টি ভোট (34.71 শতাংশ) পেয়ে এই কেন্দ্রে জয় পান আবু হাসেম৷ আট হাজার 222 ভোটে জেতেন তিনি ৷
2009 সালের সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে মালদা জেলায় একটিমাত্র লোকসভা কেন্দ্র ছিল ৷ এই কেন্দ্রের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন বরকত গনি খান চৌধুরী ৷ আটবার এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তিনি ৷ তাঁর মৃত্যুর পর আবু হাসেম চারবার এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন ৷
এদিকে 2021 সালের বিধানসভা ভোটে ইংরেজবাজারে ফের পরাজিত হন তৃণমূল প্রার্থী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ৷ এবার হেরে যান বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীর কাছে ৷ মানিকচকে তৃণমূলের সাবিত্রী মিত্র হারিয়ে দেন বিজেপির গৌরচন্দ্র মণ্ডলকে ৷ মোথাবাড়িতে জয়ী হন তৃণমূলের সাবিনা ইয়াসমিন, পরাজিত বিজেপির শ্যামচাঁদ ঘোষ ৷ বৈষ্ণবনগর কেন্দ্রে তৃণমূলের চন্দনা সরকার বিজেপির স্বাধীনকুমার সরকারকে পরাজিত করেন ৷ সুজাপুরে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আবদুল গনি ৷ হারিয়ে দেন কংগ্রেসের ইশা খান চৌধুরীকে ৷ ফরাক্কা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী মনিরুল ইসলাম বিজেপির হেমন্ত ঘোষকে পরাজিত করেন ৷ সামশেরগঞ্জ কেন্দ্রে ফের জয় পান তৃণমূলের আমিরুল ইসলাম ৷ তাঁর কাছে হেরে যান কংগ্রেসের জায়দুর রহমান ৷
চব্বিশে কী হবে ? তৃণমূলের জেলা সহসভাপতি দুলাল সরকার বলছেন, “এদেশের রাজনীতিতে কাউকে রাজনীতির পড়াশোনা করে আসতে হবে, সেটা নেই ৷ বিজেপিও এমন অনেককে প্রার্থী করেছে, যাঁরা রাজনীতিতে নতুন ৷ মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থী শাহনওয়াজ আলি রায়হান রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে ৷ তাঁর বাবা 18 বছর বামপন্থী রাজনীতি করেছেন ৷ শাহনওয়াজ বিদেশে থাকতেন ৷ বরকত সাহেব, ডালুবাবু, ইশা খান চৌধুরী, সবাই বিদেশে পড়াশোনা করেছেন ৷ রুবি নুরও বিদেশে থাকতেন ৷ বরকত সাহেব বিদেশের পড়াশোনা ছেড়ে মালদার মানুষের কাজ করবেন বলে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ৷ শাহনওয়াজের মধ্যেও বরকতদার ছায়া দেখা যাচ্ছে ৷ তার সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ক্লাস আছে ৷ আমরাও তাঁর সঙ্গে রয়েছি ৷ তাছাড়া একুশের ভোটের নিরিখে এই কেন্দ্রে থাকা সাতটির মধ্যে ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রেই আমরা তিন লাখ ভোটে এগিয়ে রয়েছি ৷ ফলে এবার মালদার দুই কেন্দ্রে তৃণমূলের জয় কেউ আটকাতে পারবে না ৷”
কংগ্রেসের কার্যকরী জেলা সভাপতি কালীসাধন রায়ের বক্তব্য, “এবার ভোটে যত প্রার্থী হয়েছেন, যত নেতা রয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলার আছে ৷ কিন্তু মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারবে না ৷ তাঁর যা অ্যাপিয়ারেন্স, কারও নেই ৷ তিনি 10 বছর দু’টি কেন্দ্রে বিধায়ক ছিলেন ৷ ওই দুই কেন্দ্রের কোনও মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে এখনও কোনও অভিযোগ করতে পারবে না ৷ গনি খান চৌধুরীর পরিবারের প্রতি ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মালদার মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা রয়েছে ৷ কারণ, এই পরিবার সম্প্রীতির প্রতীক ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘একুশে রাজ্যে রাজনৈতিক নির্বাচনই হয়নি ৷ আর ঊনিশের নির্বাচনের আগে তৎকালীন জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী দলত্যাগ করে তৃণমূলে চলে যান ৷ সেই ভোটে উত্তর মালদা কেন্দ্রের প্রার্থী হয়েছিলেন ইশা ৷ দলের বিপর্যয় রুখতে আমরা তাঁকে উত্তর মালদায় এগিয়ে দিয়েছিলাম ৷ সমস্ত কঠিন লড়াইয়ে ইশা খান চৌধুরী সামনে থেকে দলকে পরিচালনা করেছেন ৷ কংগ্রেস কাজে বিশ্বাসী, প্রচারে নয় ৷ আবু হাসেম খান চৌধুরী চুপচাপই থাকেন ৷ গঙ্গা ভাঙন রোধে তিনি যে কাজ করেছেন, কেউ করেনি ৷ প্রিয়রঞ্জনের আমলে ভাঙন রোধের কাজ শুরু হয়েছিল ৷ কিন্তু মনমোহন সরকারের পতনের পর বিজেপি এসে সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ৷ আমরা বলে দিচ্ছি, দক্ষিণ মালদায় কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ বলে কেউ নেই ৷”
বিজেপির দক্ষিণ মালদা সাংগঠনিক জেলার সভাপতি পার্থসারথি ঘোষের বক্তব্য, “এই কেন্দ্রের মানুষ এবার কোনও ব্যক্তিকে ভোট দেবে না ৷ এতদিন বিজেপি যেভাবে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্র পরিচালনা করেছে, গত 10 বছর যেভাবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার চলছে, তা উপলব্ধি করেই মানুষ ভোট দেবে ৷ আমরা গোটা দেশেই এবার পজিটিভ ভোট আশা করছি ৷ তবে পশ্চিমবঙ্গের ইস্যু খানিকটা ভিন্ন ৷ এখানকার রাজ্য সরকার আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ৷ এখানে আইনের শাসন চলে না ৷ চলে সমাজবিরোধীদের শাসন ৷ বিশ্বে শ্রেষ্ঠ করার জন্য যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই প্রশংসিত ৷ প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা ক’দিন আগে মালদার মানুষও দেখেছে ৷ মানুষ আবারও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার দেখতে চায় ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘বিরোধীরা সংখ্যালঘুদের কানে কানে বলেই চলেছে, বিজেপি সংখ্যাগুরুদের দল ৷ কিন্তু গত 10 বছরে একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পও ধর্মের ভিত্তিতে পাওয়া বা না পাওয়া নির্ভর করেনি ৷ কিন্তু এখনও এরাজ্যে সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশ মিথ্যাচারে প্রভাবিত ৷ সিএএ-এনআরসির অপব্যাখ্যা চলছে ৷ এসব কারণে আমরা এবারও সংখ্যালঘুদের একটা অংশের ভোটের আশা করছি না ৷ আমাদের দলের প্রার্থী হল পদ্ম ৷ কিন্তু বিজেপি কোনও পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি ৷ যা বাকিদের থেকে আলাদা ৷ বিজেপির কাছে প্রার্থী নয়, কাজ বড় ৷ এতেই বিজেপির জনপ্রিয়তা ৷ এর ভিত্তিতেই ভোট হবে ৷ এখনও পর্যন্ত এই কেন্দ্রে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস ৷ তৃণমূল নয় ৷ মানুষ এদের ভোট দেবে না ৷ বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের চাকরি নিয়ে ছেলেখেলার পর তো নয়ই ৷”
আরও পড়ুন: