জলপাইগুড়ি, 1 জুলাই: যে তিন নতুন কেন্দ্রীয় আইন নিয়ে বিতর্ক, তা নিয়ে একেক আইনজীবীর একেক মত ৷ কারও মতে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রিটিশ আমলের আইন পরিবর্তন করে তাকে আধুনিক করা হয়েছে ৷ এর কিছু ভালো দিক রয়েছে ৷ তবে আইনজীবীদের একাংশের মতে, নয়া আইন দেশকে পুলিশরাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷ এই আইন হবে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী ৷
কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চের আইনজীবী সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের মতে, "সব কিছুরই ভালো মন্দ দুটো দিক থাকে । যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আইনের মধ্যে ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে । এটা ভালো দিক । তবে কোনও সরকারি অফিসার কাজ করার সময় তাঁর কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে কেউ অভিযোগ করলেই তাঁকে অভিযুক্ত করা যাবে না । সেক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে বিষয়টি শোনা হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রিপোর্টে যদি প্রমাণিত হয় তাহলেই তাঁকে অভিযুক্ত করা যাবে । এক্ষেত্রে অফিসারদের প্রোটেক্ট করা হয়েছে । এই আইন মানুষের থেকে মনে হচ্ছে সরকারের কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে । তদন্তে জটিলটা করা হয়েছে ।"
আইনজীবী সৈকত চট্টোপাধ্যায় বলেন, "আগে যেখানে আইনে বলা ছিল, থানায় গিয়ে অভিযোগ করলেই এফআইআর রেজিস্টার করতে হত । কিন্তু এখন পুলিশের কাছে অভিযোগ এলে পুলিশ আগে তদন্ত করে তারপর অভিযোগ নেবে । এখন পুলিশ স্টেটের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । পুরনো মামলা অর্থাৎ 30 জুন পর্যন্ত মামলাগুলি আইপিসি হিসেবেই চলবে । 1 জুলাই থেকে আইপিসি-এর ধারায় মামলাগুলি বিএনএস ধারায় করতে হবে ।"
কলকাতা হাইকোর্টের জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চের সরকারি আইনজীবীর সহকারী আইনজীবী অদিতিশঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, "আইন সব সময় মানুষের জন্য । মানুষের সুবিধার্থে হবে এটাই কাম্য । মানুষ কোথাও যদি রিলিফ না-পায় কোর্ট তাকে ন্যায় দেবে এটাই ভেবে নেয় । এক্ষেত্রে খুব অ্যালার্মিং ।কারণ ক্রিমিনাল কেসে পুলিশ আগে তদন্ত করে দেখবে সেটা অভিযোগ হিসেবে নেওয়া যাবে কি না, পুলিশ মনে করলে তবেই অভিযোগ হিসেবে এফআইআর শুরু করবে ৷ পুলিশের উপর বিরাট একটা ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হল । পুলিশ কখনওই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না । পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে । পুলিশ অনেক সময় ভুল করে ৷ নতুন আইনে তাদের ব্যাখ্যা দেওয়ার জায়গা দেওয়া হয়নি ।"
বার কাউন্সিলের সদস্য তথা জলপাইগুড়ি আদালতের সরকারি আইনজীবী গৌতম দাস বলেন, "এই আইন ন্যায় বিচারের পরিপন্থী । আইনের বিচারকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে । পুলিশরাজ যাকে বলে সেই পুলিশ রাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । প্রত্যেক বার কাউন্সিলের মত নেওয়া যেত ৷ জ্যুরিস্টদের মত নেওয়া যেত । পুলিশ কীভাবে কী কাজ করবে সেটার তথ্য নেই । ইলেকট্রনিক প্রমাণের বিষয়টি রাখা হয়েছে। পুলিশের সামনে জবানবন্দি শেষ কথা, এটা হতে পারে না ।"
যদিও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরী জানালেন, "যে আইনের সংশোধন করা হয়েছে তা ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা আইন ।ব্রিটিশ সরকার নিজের সুবিধার জন্য এই আইন প্রণয়ন করেছিল । এখন নেচার অফ ক্রাইম অর্থাৎ অপরাধের ধরনে বদল ঘটেছে । পাশাপাশি বিচারের যে দীর্ঘসুত্রিতা, সেটা কমবে । মানুষ দ্রুত বিচার পাবে বলে আমার মনে হয় । ফলে এই আইন সংশোধন সাধুবাদ যোগ্য ।"
এতো গেল আদালত ও ওকালতি পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষদের বক্তব্য ৷ এদিকে, নতুন আইন নিয়ে পুলিশ মহলেই বিভ্রান্তি পুরোপুরি কাটেনি ৷ এই নিয়ে প্রথম দিনেই কাজে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হল কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের একাধিক থানার পুলিশকর্মীকে । এদিন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ কলকাতার এক থানার ওসি বলেন, "এতদিন ধরে আমরা আইপিসি-র উপর ভিত্তি করে কাজ করতাম । আচমকাই পরিবর্তনের ফলে কাজে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পুলিশকর্মীদের । থানায় আসছে একের পর এক অভিযোগ । কিন্তু নতুন ধারা না-থাকায় কোন মামলায় কোন ধারা প্রয়োগ করা হবে, তা বুঝতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে ।"
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের উত্তর কলকাতার এক ট্রাফিক গার্ডের ইনচার্জ বলেন, "প্রথমদিকে আমাদের ভারতীয় ন্যায় সংহিতা শেখানোর জন্য কলকাতা পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে বেশ কিছুদিন ক্লাস হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই ক্লাস কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে । ফলে এখনও পর্যন্ত ভালোভাবে বলতে পারব না যে, ভারতীয় ন্যায়সংহিতায় কোন ধারায় কোন মামলা রুজু হবে ।"
এ বিষয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর থানার ইন্সপেক্টর ইনচার্জ দাবি করেন যে, "এই আইন নিয়ে রাজ্য পুলিশের অবস্থা আরও বেহাল। কারণ পুলিশকর্মীদের নিয়ে বড় কোনও প্রশিক্ষণ হয়নি । এছাড়াও রাজ্যের একাধিক থানায় এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে নির্দেশিকা এবং কাগজপত্র পুরোপুরি আসেনি । ফলে কাজ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে ।"
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতা এ বিষয়ে বলেন, "নতুন আইন আমাদের মেনে নিতেই হবে । পাশাপাশি এই নতুন আইনের সঙ্গে আগের আইনের অনেক জায়গায় ফারাক আছে । আমার মনে হয় পুলিশকেও এই বিষয় আরও সচেতন হয়ে ভালোভাবে কাজ জেনে আইন প্রয়োগ করতে হবে ।