আসানসোল, 30 অগস্ট: পুরুলিয়ার শুখা মাটিতে সবুজায়ন করে অসাধ্যসাধন করেছিলেন এই আজন্ম প্রকৃতি তপস্বী মানুষটি। স্বপ্নদ্রষ্টা, লেখক মানুষটি আদিবাসী পিছিয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের পুষ্টি যোগাতে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন 'ভালো পাহাড়' সোসাইটি। 1996 সালের 1 সেপ্টেম্বর ভালো পাহাড় পথ চলা শুরু করেছিল।
বর্ষপূর্তির ঠিক দু'দিন আগেই চলে গেলেন ভালো পাহাড়ের প্রাণ পুরুষ কমল চক্রবর্তী। জামশেদপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল 78 বছর। তাঁর মৃত্যুতে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পুরুলিয়া শহর থেকে অনেক দূরে ঝাড়খন্ড-বাংলা সীমান্তে প্রচারের আলোর বাইরে কমল চক্রবর্তী শুরু করেছিলেন তাঁর ভালো পাহাড়ের স্বপ্ন দেখা।
জামশেদপুরের মানুষ ছিলেন তিনি। 'কৌরব পত্রিকা'র সহযোগী ছিলেন। নিজে ছিলেন লেখক, কবি। 1990-95 সাল থেকেই কলকাতা বইমেলায় বন্ধু কবিদের বলতেন স্বপ্নের কথা। তারপর শুরু হয় স্কুটার নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় জমির খোঁজ। কবি বন্ধুদের পাঠানো টাকায় মস্ত এক জমি কিনে শুরু করেছিলেন বনাঞ্চল বানানোর কাজ। প্রথমে সকলেই ভেবেছিলেন সাহিত্যপাগল কমল তৈরি করছেন কবিদের বাসভূমি। কিন্তু ক্রমেই তা বিরাট আকার নিতে শুরু করে। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থেকে দুয়ারসিনি যাওয়ার পথেই কমল চক্রবর্তীর এই ভালো পাহাড়। পাথুড়ে জমিতে সবুজের বিপ্লব করে দিয়ে গেলেন।
20 একর জায়গা নিয়ে 1996 সালে যে স্বপ্ন দেখ শুরু হয়েছিল, বর্তমানে তা জমি অধিগ্রহন করে 30 একর ছাড়িয়েছে। প্রায় 20 লক্ষ গাছ তৈরি করেছেন কমল চক্রবর্তী। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ জন। গাছগুলির মধ্যে 500-600 রকমের ভেষজ ও গুল্ম রয়েছে। পিছিয়ে পড়া আদিবাসী, দরিদ্র কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা দিতে কমল চক্রবর্তীর দূরদর্শিতাতেই 2008 সালে ভালো পাহাড়ে তৈরি হয় স্কুল। প্রথমে দু'জন শিক্ষক ছিলেন এবং 65 জন ছাত্রছাত্রী। বর্তমানে 200-র অধিক ছাত্রছাত্রী পড়াশুনো করে সেখানে৷ স্কুলটি সরকারি মান্যতা পেয়েছে। স্কুলের ভবন, নলকূপ, পার্ক, স্কুল বাস থেকে শুরু করে স্কুলের খোলা মঞ্চ, ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাস পরিষেবা ও দুপুরে আহার দেওয়া হয়।
ভালো পাহাড়ে তৈরি হয়েছে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রতিদিন গড়ে 50 জন রোগী আসেন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করাতে। এছাড়াও চোখের ছানি থেকে শুরু করে আরও না-না অস্ত্রপচারও হয়। কমল চক্রবর্তীর দূরদর্শিতায় পুরুলিয়ার পাথুড়ে জমিতেও কৃষি এসেছে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে সেচের জন্য নিজেরাই পুকুর কেটে, জৈব সার তৈরি করে কৃষিতেও বিপ্লব এনেছিলেন তিনি। 32 রকমের ধানের বীজ-সহ, গম, সরিষা, তিল বীজ ও বিভিন্ন ধরনের ডাল উৎপাদন হয় সেই কৃষিজমিতে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফুল,ফল ও শাক সবজী তো আছেই। ভালো পাহাড়ে তৈরি হয়েছে পশু পালন কেন্দ্র। সেখানে নিজস্ব পুকুরে হয় মাছ চাষও।
কমল চক্রবর্তী ছিলেন কবি, লেখক, সমাজ ও পরিবেশ সংস্কারক । তাঁকে কথার জাদুকর বলা হতো। তাঁর বেশ কয়েকটি বই রয়েছে যেগুলি বিরাট সাড়া ফেলেছিল। তাঁর কবিতায় লোকগান হয়েছে । স্থানীয় লোক সংস্কৃতির উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাঁর মৃত্যুতে গোটা বাংলার শুভ বুদ্ধিসম্মন্ন মানুষের মনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ।