বারুইপুর, 6 ডিসেম্বর: চার মাস কেটে গেলেও আরজি করের চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার এখনও অধরাই ৷ এদিকে শুক্রবার 62 দিনের মাথায় দক্ষিণ 24 পরগনার জয়নগরের নাবালিকা ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনে দোষী সাব্যস্ত মুস্তাকিনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করলেন বারুইপুর মহকুমা আদালতের বিচারক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় ৷ এই মামলার তদন্তে ছিল রাজ্য় পুলিশ ৷
বিচারক এই মামলাটিকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে উল্লেখ করেছেন, জানিয়েছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় ৷ তিনি বলেন, "এই ধরনের মানুষের বেঁচে থাকাটা সমাজের পক্ষে খারাপ ৷ আমি সওয়াল জবাবে বলেছিলাম এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম ৷ মহামান্য আদালত এটা মেনে নিয়েছেন ৷ তিনটি ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ৷"
কী হয়েছিল 4 অক্টোবর ?
আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, "কোচিং থেকে ফেরার সময় মেয়েটিকে তার বাবা বলেছিল রাস্তার ধার দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাও ৷ কিন্তু ও (মুস্তাকিন) মেয়েটিকে সাইকেলে তোলে ৷ মিথ্যা কথা বলে যে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে ৷ দু'জন সাক্ষী ঘটনাটি দেখতে পায় ৷ একজন গিয়ে জিজ্ঞেস করে কেন সাইকেলে তোলা হচ্ছে ৷ তখন বলে যে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে ৷ পুরোটাই মিথ্যা কথা ৷ এরপর ওকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ওর উপর নৃশংস শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করে ৷ তারপর ওকে খুন করে ৷"
কীসের ভিত্তিতে ফাঁসির সাজা ?
তিনি আরও জানান, নাবালিকার শরীরে 42 টিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন ছিল ৷ ছাত্রীকে মাথা থেঁতলে হত্যা করা হয়েছে ৷ বিজ্ঞান এই মামলায় প্রচুর সাহায্য করেছে ৷ নির্যাতিতার রক্তের ডিএনএ-র সঙ্গে মুস্তাকিনের রক্তের ডিএনএ মিলে গিয়েছে ৷ আইনজীবী বলেন, "সিসি ফুটেজে মেয়েটিকে ও ছেলেটিক দেখা গিয়েছে ৷ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিটি সিসি ফুটেজ ফ্রেম ধরে ধরে ওদের পরিচয় দাঁড় করিয়েছে ৷ এরকম প্রচুর প্রমাণ আছে, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ আছে ৷ যার মাধ্যমে আমরা মামলাটিকে প্রমাণ করতে পেরেছি ৷"
দোষী মুস্তাকিনের প্রতিক্রিয়া
অভিযুক্ত মুস্তাকিন এই সাজা পাওয়ার পরেও কোনওভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করেনি বলে জানান সরকারি কৌঁসুলী বিভাস চট্টোপাধ্যায় ৷ তাঁর কথায়, "যখন দেহ উদ্ধার হয়, তখন সে বলেছিল আমি মেয়েটিকে প্রেম করব বলে নিয়ে গিয়েছিলাম ৷ আর আজ সে বলল, আমি নির্দোষ আমায় ফাঁসানো হয়েছে ৷ তার মধ্যে অনুশোচনা দেখতে পাইনি ৷ কোর্টে আমি এই পয়েন্টটাই তুলেছিলাম ৷"
বিরলের মধ্যে বিরতলম
আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, "এই মামলাটি সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে ৷ এই নৃশংস অপরাধ ইদানীংকালে খুব কম দেখা গিয়েছে ৷ আসামীকে সংশোধনের কথা বলায় তার যে প্রতিক্রিয়া মিলেছে তাতে মনে হয় না যে সংশোধনের কোনও সুযোগ আছে ৷"
অভিযুক্ত মুস্তাকিনের বিরুদ্ধে পকসো আইনে মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত শুরু হয় ৷ 7 অক্টোবর সিট গঠন করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ ৷ ঘটনার 25 দিনের মাথায় 30 অক্টোবর চার্জশিট জমা দেওয়া হয় বারুইপুর আদালতে ৷ ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে শুরু হয় বিচার ৷ মামলায় সাক্ষ্য দেন 36 জন ৷ শেষ পর্যন্ত সব পক্ষের বক্তব্য শুনে ও তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে বৃহস্পতিবার, 5 ডিসেম্বর, বারুইপুর পকসো আদালত মুস্তাকিনকে দোষী সাব্যস্ত করে ৷ অভিযুক্তের ফাঁসি সাজা হওয়ায় খুশি নির্যাতিকার পরিবারের সদস্যরা ৷
দোষী মুস্তাকিনের আইনজীবী দেবশ্রী রায় বলেন, "এই রায়কে আমরা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাব ৷ আশা করি আমার মক্কেল সেখানে সুবিচার পাবে বা খালাস পেতে পারে ৷"
4 অক্টোবর টিউশন পড়তে গিয়েছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ৷ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও সে বাড়ি না-ফেরায় চিন্তায় পড়ে পরিবার ৷ প্রাথমিক খোঁজখবরের পর তাঁরা জয়নগর থানায় নিখোঁজের সম্পর্কে জানাতে গেলে, তাঁদের পুলিশ কুলতলি থানায় পাঠিয়ে দেয় ৷ পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ ওঠে ৷ অভিযোগ জানাতে গেলেও পুলিশ তা শুনতে চায়নি ৷ এফআইআর করতে চাইলেও পুলিশ নিতে চায়নি ৷ নিখোঁজ নাবালিকাকে তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হয় ৷ শেষে ভোররাতে নাবালিকার বাড়ির পাশে একটি জলাজমি থেকে ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয় ৷ দেখা যায়, ছাত্রীর দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে ৷
সেই সময় নাবালিকার পরিবার অভিযোগ করেছিল, ছাত্রীটিকে ধর্ষণের পর খুন করে ফেলে দেওয়া হয় পুকুরে ৷ পরে মৃতের পরিবারের তরফে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয় জয়নগর থানায় ৷ অভিযোগ, প্রথমে মহিষমারি পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল পরিবার ৷ সেখানে অভিযোগ না নিয়ে তাদের জয়নগর থানায় যেতে বলা হয়েছিল ৷ জয়নগর থানা আবার তাদের কুলতলি থানায় পাঠায় ৷ পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ প্রথমেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখলে মেয়েটিকে হয়তো বাঁচানো যেত ৷ এরপর ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধে জয়নগর ও কুলতলিতে ৷
জয়নগরের নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত, শুক্রবার সাজা ঘোষণা