ETV Bharat / state

জয়নগরের পর ফরাক্কা, নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে দোষীদের ফাঁসি-আমৃত্যু কারাদণ্ড - FARAKKA MINOR RAPE MURDER CASE

কুলতলির মতোই ফরাক্কায় নাবালিকাকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাতেও দু'মাসের মধ্যে বিচারপর্ব শেষে সাজা ঘোষণা হল ৷ পকসো মামলায় যাবজ্জীবন, ফাঁসির সাজা হয়েছে দোষীদের ৷

Farakka Minor girl rape and murder case
ফরাক্কায় নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে দোষীদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 13, 2024, 7:40 PM IST

ফরাক্কা, 13 ডিসেম্বর: জয়নগরের পর ফরাক্কাতেও নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় মূল অপরাধীকে ফাঁসির সাজা দিল জঙ্গিপুর মহকুমা আদালত ৷ বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় নাবালিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার 59 দিনের মাথায় দুই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ৷ শুক্রবার জঙ্গিপুর মহকুমা আদালতের দায়রা বিচারক অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে রায় দান হয় ৷

দোষী সাব্যস্ত হওয়া দীনবন্ধু হালদারকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। শুভজিৎ হালদারকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেন বিচারক ৷ এই নৃশংস ঘটনাতেও দু'মাসের মধ্যে বিচার পর্ব সম্পূর্ণ হয়েছে ৷ স্বভাবত এমন ঘোষণায় সন্তুষ্ট পরিবার ও এলাকাবাসী ৷ দোষীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার 65, 66, 103, 137, 140-সহ সাতটি ধারায় মামলা রুজু হয়েছিল ৷ প্রমাণ ও সাক্ষ্য গ্রহণের পর দু'জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ৷

ফরাক্কায় নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে দোষীদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন (ইটিভি ভারত)
দোষীদের সাজা প্রসঙ্গে সরকারি আইনজীবী বিভাস চক্রবর্তী বলেন, "রাজ্য সরকারের তরফে আমি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলাম ৷ সবদিক বিচার করে মাননীয় আদালত দীনবন্ধু হালদারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। শুভজিৎ হালদারের যাবজ্জীবনেরর সাজা হয়েছে ৷ এই যাবজ্জীবন খুনের মামলার যাবজ্জীবনের থেকে পৃথক ৷ পকসো আইনে যাবজ্জীবনের অর্থ দোষী যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কারাবাসেই থাকতে হবে ৷ দোষী জেল থেকে বেরতে পারবে না ৷"

কী হয়েছিল ?

পুজোয় নাবালিকা মামার বাড়িতে এসেছিল ৷ 13 অক্টোবর সেখানে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলায় সময় হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায় ৷ পরে অভিযোগ ওঠে, এক ব্যক্তি তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায় ৷ নাবালিকাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিল তার বন্ধুরা ৷

এরপর অভিযুক্তর বাড়ি থেকে নাবালিকার বস্তাবন্দি দেহ উদ্ধার হয় ৷ সেদিনই মূল অভিযুক্ত দীনবন্ধুকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৷ পরে 19 অক্টোবর শুভজিৎ হালদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ পুলিশের দাবি, নাবালিকাকে খুন ও তার উপর যৌন নির্যাতন চালাতে দীনবন্ধুকে সাহায্য করেছিল এই শুভজিৎ ।

আইনজীবীর বক্তব্য, মেয়েটির পরিবার সম্প্রতি দিল্লি থেকে ফিরেছে ৷ মেয়েটি ফুল ভালোবাসত ৷ ফুল দেওয়ার নাম করে তাকে সকাল 10টা- 10.30 নাগাদ তুলে নিয়ে যায় দোষীরা ৷ নাবালিকা তখন আরও ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে খেলছিল ৷ তখন দীনবন্ধু হালদার তাকে নিয়ে যায় ৷ এর কিছুক্ষণ পরই শুভ হালদার বাড়িতে ঢোকে ৷

এরপরই কাপড় দিয়ে মুখ চেপে নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয় ৷ মাথাটা পর্যন্ত মাটিতে বারবার ঠুকেছে দোষীরা ৷ আমরা সেই ক্ষতের প্রমাণ পেয়েছি ৷ দোষীদের পরিকল্পনা ছিল, রাতে নাবালিকার দেহ ফরাক্কার জঙ্গলে ফেলে দেবে ৷ এর আগে ওরা দু'জন সিগারেটের মধ্যে গাঁজা পুরে খেয়েছিল ৷ সিগারেটের বাটে শুভজিৎ হালদারের ডিএনএ ম্যাচ করেছে ৷ এরকম বিভিন্ন প্রমাণ আছে ৷ নাবালিকার জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয় ৷ মেয়েটির সঙ্গে যতরকমভাবে নৃশংস শারীরিক অত্যাচার করা যায়, সে সবই তারা করেছে ৷ আমি আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ ৷

রায় ঘোষণার পর সাংবাদিক বৈঠক করেন এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুপ্রতিম সরকার ৷ তিনি বলেন, "জয়নগরের ক্ষেত্রে 62 দিনে রায় ঘোষণা হয়েছে ৷ ফরাক্কার ঘটনায় 61 দিন, অর্থাৎ একদিন কম লেগেছে রায় ঘোষণা করতে ৷ এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দু'টি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় বিরল রায় ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ৷"

নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য

মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে দিল্লিতে থাকত ৷ পুজোর সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামে এসেছিল ৷ বিজয়া দশমীতে শিশুদের সঙ্গে খেলছিল ৷ কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটি ফিরছে না কেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে থাকে মা-দিদা ৷ দুপুর 1টা নাগাদ আইসি'র কাছে ফোন আসে যে, স্থানীয়রা এক ব্যক্তিকে দলবদ্ধ ভাবে মারধর করছে ৷ পুলিশ গিয়ে যাকে মারধর করা হচ্ছিল, তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে ৷

এরপর খোঁজ করা হয়, কেন লোকজন মারছিল ৷ তখনই জানা যায়, মা ও দিদিমা যে মেয়েটির খোঁজ করছিল, সেই নাবালিকাকে দীনবন্ধু হালদার নামে একজন তার বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল ৷ মেয়েটির বন্ধুরা এবং কয়েকজন প্রতিবেশীও তা দেখেছে ৷

মেয়েটির মা-দিদিমা দীনবন্ধুর বাড়িতে যান ৷ খোঁজ করেন তাঁদের মেয়ে সেখানে এসেছে কি না ৷ দীনবন্ধু দরজা খোলেনি ৷ দরজার ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ ছিল । ভিতর থেকে সে বলে মেয়েটি এখানে আসেনি ৷ মেয়েটির মা-দিদিমা আবার খোঁজাখুঁজি করে দীনবন্ধুর কাছেই ফিরে যান ৷ এবার দীনবন্ধু দরজা খুলতে অস্বীকার করে ৷ সে বলে যে মেয়েটি এসেছিল, কিন্তু চলে গিয়েছে ৷ দীনবন্ধুর কথায় অসঙ্গতি, আচরণ সন্দেহজনক হয় ৷ মা-দিদিমা চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে ৷ তাঁরা দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন ৷ প্রবল চাপের মুখে দীনবন্ধু দরজা খুলতে বাধ্য হয় ৷

তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায়, ঘরের আলনার নীচে এককোণে হলুদ প্লাস্টিকের মধ্যে নাবালিকার প্রাণহীন দেহ রয়েছে ৷ তার মুখে কাপড় গোঁজা, শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ৷ স্থানীয়রা দীনবন্ধু হালদারকে গণধোলাই দিতে শুরু করে ৷ পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় ৷

প্রথামাফিক দেহের ময়নাতদন্ত, সুরতহাল ও ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ইনকোয়েস্ট হয় ৷ সব পদ্ধতির ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছে ৷ রিপোর্টে জানা যায়, নাবালিকার উপর চরমতম যৌন নির্যাতন হয়েছে ৷ এডিজি সুপ্রতিম সরকার বলেন, "তার বিশদ ব্যাখ্যায় আমরা যাচ্ছি না ৷ নির্মমতম নির্যাতনের শিকার হয়েছে নাবালিকা ৷ এই অত্যাচার দীনবন্ধু একা করেনি ৷ তাকে জেরা করে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আরও একজনের নাম জানতে পারি ৷ তার নাম শুভজিৎ হালদার ৷ দীনবন্ধু ও শুভজিৎ- দু'জনেই মাছ বিক্রেতা ৷"

নাবালিকা প্রাণ হারানোর পরেও মৃতদেহের উপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল দীনবন্ধু ও শুভজিৎ ৷ মেডিক্যাল পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'নেক্রোফিলিয়া' ৷ এই ঘটনার তদন্তে জঙ্গিপুরের পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ের নেতৃত্বে সিট গঠন হয় ৷ ঘটনার 3 সপ্তাহ অর্থাৎ 21 দিনের মধ্য়ে চার্জশিট পেশ করা হয় আদালতে ৷

চার্জশিটে প্রমাণ

  • দীনবন্ধু ও শুভজিতের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন ৷ তার উপর ভিত্তি করে গুগল ম্যাপ অ্যাপ্লিকেশন করে দু'জনের গতিবিধির ডিজিটাল প্লটিং পাওয়া যায় ৷ ড্রোন ও ড্রোন ম্যাপিং সফ্টওয়্যারের সাহায্য নেওয়া হয় ৷ একটা নির্দিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তাদের ল্যাটিচিউড ও লংগিচিউড কী ছিল, তা জানা যায় ৷ প্রযুক্তির সাহায্যে এটা প্রমাণ করা যায় যে ঘটনার সময় দুই অভিযুক্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল ৷
  • অভিযুক্তের জামাকাপড়ে রক্তের ছিটের জেনেটিক প্রোফাইল ও ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা যায় যে, তা নাবালিকার শরীরেরই ৷
  • মেয়েটির পোশাকে বীর্য পাওয়া গিয়েছিল ৷ সেই বীর্য দীনবন্ধু হালদারের তা ডিএনএ পরীক্ষায় সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৷
  • মেয়েটি যাদের সঙ্গে খেলছিল তাদের কয়েকজন দেখেছিল ঘটনার দিন মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৷ এক মহিলা প্রতিবেশী, যার বাড়ি দীনবন্ধুর বাড়ির উল্টোদিকে তিনি দেখেছিলেন মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে তারা ৷
  • ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আধপোড়া সিগারেটের টুকরোয় লেগে থাকা লালারস, যা পরে প্রমাণিত হয় যে, দীনবন্ধু ও শুভজিতের ৷

সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশের উচ্চস্তরীয় আধিকারিক সুপ্রতিম সরকার এসপি আনন্দ রায়ের নেতৃত্বে গঠিত তদন্তকারী পুলিশের দলকে শুভেচ্ছা জানান ৷ তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করেন ৷ এছাড়া তিনি আরও জানান, এত অল্প সময়ের মধ্যে জয়নগর ও ফরাক্কায় নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে ৷ এরপর অন্য রাজ্যের পুলিশ দফতর থেকে ব্যক্তিগত স্তরে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্ত প্রক্রিয়া বিশদে জানতে চাওয়া হয়েছে ৷ এডিজি সুপ্রতিম সরকার আরও বলেন, "আমরা ব্যুরো অফ পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এই দু'টি ঘটনার কেস স্টাডি পাঠাব ।"

ফরাক্কা, 13 ডিসেম্বর: জয়নগরের পর ফরাক্কাতেও নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় মূল অপরাধীকে ফাঁসির সাজা দিল জঙ্গিপুর মহকুমা আদালত ৷ বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় নাবালিকার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার 59 দিনের মাথায় দুই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ৷ শুক্রবার জঙ্গিপুর মহকুমা আদালতের দায়রা বিচারক অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে রায় দান হয় ৷

দোষী সাব্যস্ত হওয়া দীনবন্ধু হালদারকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। শুভজিৎ হালদারকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেন বিচারক ৷ এই নৃশংস ঘটনাতেও দু'মাসের মধ্যে বিচার পর্ব সম্পূর্ণ হয়েছে ৷ স্বভাবত এমন ঘোষণায় সন্তুষ্ট পরিবার ও এলাকাবাসী ৷ দোষীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার 65, 66, 103, 137, 140-সহ সাতটি ধারায় মামলা রুজু হয়েছিল ৷ প্রমাণ ও সাক্ষ্য গ্রহণের পর দু'জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ৷

ফরাক্কায় নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে দোষীদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন (ইটিভি ভারত)
দোষীদের সাজা প্রসঙ্গে সরকারি আইনজীবী বিভাস চক্রবর্তী বলেন, "রাজ্য সরকারের তরফে আমি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলাম ৷ সবদিক বিচার করে মাননীয় আদালত দীনবন্ধু হালদারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। শুভজিৎ হালদারের যাবজ্জীবনেরর সাজা হয়েছে ৷ এই যাবজ্জীবন খুনের মামলার যাবজ্জীবনের থেকে পৃথক ৷ পকসো আইনে যাবজ্জীবনের অর্থ দোষী যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কারাবাসেই থাকতে হবে ৷ দোষী জেল থেকে বেরতে পারবে না ৷"

কী হয়েছিল ?

পুজোয় নাবালিকা মামার বাড়িতে এসেছিল ৷ 13 অক্টোবর সেখানে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলায় সময় হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায় ৷ পরে অভিযোগ ওঠে, এক ব্যক্তি তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায় ৷ নাবালিকাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিল তার বন্ধুরা ৷

এরপর অভিযুক্তর বাড়ি থেকে নাবালিকার বস্তাবন্দি দেহ উদ্ধার হয় ৷ সেদিনই মূল অভিযুক্ত দীনবন্ধুকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৷ পরে 19 অক্টোবর শুভজিৎ হালদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ পুলিশের দাবি, নাবালিকাকে খুন ও তার উপর যৌন নির্যাতন চালাতে দীনবন্ধুকে সাহায্য করেছিল এই শুভজিৎ ।

আইনজীবীর বক্তব্য, মেয়েটির পরিবার সম্প্রতি দিল্লি থেকে ফিরেছে ৷ মেয়েটি ফুল ভালোবাসত ৷ ফুল দেওয়ার নাম করে তাকে সকাল 10টা- 10.30 নাগাদ তুলে নিয়ে যায় দোষীরা ৷ নাবালিকা তখন আরও ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে খেলছিল ৷ তখন দীনবন্ধু হালদার তাকে নিয়ে যায় ৷ এর কিছুক্ষণ পরই শুভ হালদার বাড়িতে ঢোকে ৷

এরপরই কাপড় দিয়ে মুখ চেপে নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয় ৷ মাথাটা পর্যন্ত মাটিতে বারবার ঠুকেছে দোষীরা ৷ আমরা সেই ক্ষতের প্রমাণ পেয়েছি ৷ দোষীদের পরিকল্পনা ছিল, রাতে নাবালিকার দেহ ফরাক্কার জঙ্গলে ফেলে দেবে ৷ এর আগে ওরা দু'জন সিগারেটের মধ্যে গাঁজা পুরে খেয়েছিল ৷ সিগারেটের বাটে শুভজিৎ হালদারের ডিএনএ ম্যাচ করেছে ৷ এরকম বিভিন্ন প্রমাণ আছে ৷ নাবালিকার জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয় ৷ মেয়েটির সঙ্গে যতরকমভাবে নৃশংস শারীরিক অত্যাচার করা যায়, সে সবই তারা করেছে ৷ আমি আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ ৷

রায় ঘোষণার পর সাংবাদিক বৈঠক করেন এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুপ্রতিম সরকার ৷ তিনি বলেন, "জয়নগরের ক্ষেত্রে 62 দিনে রায় ঘোষণা হয়েছে ৷ ফরাক্কার ঘটনায় 61 দিন, অর্থাৎ একদিন কম লেগেছে রায় ঘোষণা করতে ৷ এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দু'টি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় বিরল রায় ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ৷"

নাবালিকা ধর্ষণ-খুনে পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য

মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে দিল্লিতে থাকত ৷ পুজোর সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামে এসেছিল ৷ বিজয়া দশমীতে শিশুদের সঙ্গে খেলছিল ৷ কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটি ফিরছে না কেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে থাকে মা-দিদা ৷ দুপুর 1টা নাগাদ আইসি'র কাছে ফোন আসে যে, স্থানীয়রা এক ব্যক্তিকে দলবদ্ধ ভাবে মারধর করছে ৷ পুলিশ গিয়ে যাকে মারধর করা হচ্ছিল, তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে ৷

এরপর খোঁজ করা হয়, কেন লোকজন মারছিল ৷ তখনই জানা যায়, মা ও দিদিমা যে মেয়েটির খোঁজ করছিল, সেই নাবালিকাকে দীনবন্ধু হালদার নামে একজন তার বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল ৷ মেয়েটির বন্ধুরা এবং কয়েকজন প্রতিবেশীও তা দেখেছে ৷

মেয়েটির মা-দিদিমা দীনবন্ধুর বাড়িতে যান ৷ খোঁজ করেন তাঁদের মেয়ে সেখানে এসেছে কি না ৷ দীনবন্ধু দরজা খোলেনি ৷ দরজার ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ ছিল । ভিতর থেকে সে বলে মেয়েটি এখানে আসেনি ৷ মেয়েটির মা-দিদিমা আবার খোঁজাখুঁজি করে দীনবন্ধুর কাছেই ফিরে যান ৷ এবার দীনবন্ধু দরজা খুলতে অস্বীকার করে ৷ সে বলে যে মেয়েটি এসেছিল, কিন্তু চলে গিয়েছে ৷ দীনবন্ধুর কথায় অসঙ্গতি, আচরণ সন্দেহজনক হয় ৷ মা-দিদিমা চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে ৷ তাঁরা দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন ৷ প্রবল চাপের মুখে দীনবন্ধু দরজা খুলতে বাধ্য হয় ৷

তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায়, ঘরের আলনার নীচে এককোণে হলুদ প্লাস্টিকের মধ্যে নাবালিকার প্রাণহীন দেহ রয়েছে ৷ তার মুখে কাপড় গোঁজা, শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ৷ স্থানীয়রা দীনবন্ধু হালদারকে গণধোলাই দিতে শুরু করে ৷ পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় ৷

প্রথামাফিক দেহের ময়নাতদন্ত, সুরতহাল ও ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ইনকোয়েস্ট হয় ৷ সব পদ্ধতির ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছে ৷ রিপোর্টে জানা যায়, নাবালিকার উপর চরমতম যৌন নির্যাতন হয়েছে ৷ এডিজি সুপ্রতিম সরকার বলেন, "তার বিশদ ব্যাখ্যায় আমরা যাচ্ছি না ৷ নির্মমতম নির্যাতনের শিকার হয়েছে নাবালিকা ৷ এই অত্যাচার দীনবন্ধু একা করেনি ৷ তাকে জেরা করে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আরও একজনের নাম জানতে পারি ৷ তার নাম শুভজিৎ হালদার ৷ দীনবন্ধু ও শুভজিৎ- দু'জনেই মাছ বিক্রেতা ৷"

নাবালিকা প্রাণ হারানোর পরেও মৃতদেহের উপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল দীনবন্ধু ও শুভজিৎ ৷ মেডিক্যাল পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'নেক্রোফিলিয়া' ৷ এই ঘটনার তদন্তে জঙ্গিপুরের পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ের নেতৃত্বে সিট গঠন হয় ৷ ঘটনার 3 সপ্তাহ অর্থাৎ 21 দিনের মধ্য়ে চার্জশিট পেশ করা হয় আদালতে ৷

চার্জশিটে প্রমাণ

  • দীনবন্ধু ও শুভজিতের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন ৷ তার উপর ভিত্তি করে গুগল ম্যাপ অ্যাপ্লিকেশন করে দু'জনের গতিবিধির ডিজিটাল প্লটিং পাওয়া যায় ৷ ড্রোন ও ড্রোন ম্যাপিং সফ্টওয়্যারের সাহায্য নেওয়া হয় ৷ একটা নির্দিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তাদের ল্যাটিচিউড ও লংগিচিউড কী ছিল, তা জানা যায় ৷ প্রযুক্তির সাহায্যে এটা প্রমাণ করা যায় যে ঘটনার সময় দুই অভিযুক্ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল ৷
  • অভিযুক্তের জামাকাপড়ে রক্তের ছিটের জেনেটিক প্রোফাইল ও ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা যায় যে, তা নাবালিকার শরীরেরই ৷
  • মেয়েটির পোশাকে বীর্য পাওয়া গিয়েছিল ৷ সেই বীর্য দীনবন্ধু হালদারের তা ডিএনএ পরীক্ষায় সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৷
  • মেয়েটি যাদের সঙ্গে খেলছিল তাদের কয়েকজন দেখেছিল ঘটনার দিন মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৷ এক মহিলা প্রতিবেশী, যার বাড়ি দীনবন্ধুর বাড়ির উল্টোদিকে তিনি দেখেছিলেন মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে তারা ৷
  • ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আধপোড়া সিগারেটের টুকরোয় লেগে থাকা লালারস, যা পরে প্রমাণিত হয় যে, দীনবন্ধু ও শুভজিতের ৷

সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশের উচ্চস্তরীয় আধিকারিক সুপ্রতিম সরকার এসপি আনন্দ রায়ের নেতৃত্বে গঠিত তদন্তকারী পুলিশের দলকে শুভেচ্ছা জানান ৷ তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করেন ৷ এছাড়া তিনি আরও জানান, এত অল্প সময়ের মধ্যে জয়নগর ও ফরাক্কায় নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে ৷ এরপর অন্য রাজ্যের পুলিশ দফতর থেকে ব্যক্তিগত স্তরে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্ত প্রক্রিয়া বিশদে জানতে চাওয়া হয়েছে ৷ এডিজি সুপ্রতিম সরকার আরও বলেন, "আমরা ব্যুরো অফ পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এই দু'টি ঘটনার কেস স্টাডি পাঠাব ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.