কলকাতা, 26 মে: দক্ষিণ 24 পরগনার যাদবপুর লোকসভায় এবার চতুর্মুখী লড়াই । সেখানে একাধিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এবারের নির্বাচন হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ । তবে, সেই অনেকগুলি পয়েন্টের মধ্যে ভাঙড় বিধানসভা শেষ পর্যন্ত যাদবপুর লোকসভার ভাগ্য নির্ধারণ করবে, তা কার্যত অস্বীকার করতে পারছে না কোনও রাজনৈতিক দলই ।
কারণ, 2018 সালের পাওয়ার গ্রিড বিরোধী নকশাল আন্দোলন ঘিরে সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেয় ভাঙড় । যদিও ওই বছরই নকশাল নেতা অলীক চক্রবর্তীর গ্রেফতারের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয় । কিন্তু, 2021 সালের বিধানসভা ভোটের সময় ভাঙড় তার পুরনো স্বরূপে ফিরে আসে । হিংসা-দলাদলিতে বিধ্বস্ত হয়ে ওঠে ওই এলাকা । লাগাতার সংবাদ শিরোনামে জায়গা পায় ভাঙড় । শাসক দলের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয় ।
জন্ম নেয় নতুন রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ । বহু বিতর্ককে সঙ্গী করে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট সংযুক্ত মোর্চা তৈরি হয় । 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দলের হাত থেকে ভাঙড় বিধানসভা আসন ছিনিয়ে নেয় আইএসএফ । মূলত, বাম-কংগ্রেসের সহযোগিতায় সংখ্যালঘু ভোটে সংযুক্ত মোর্চার একমাত্র বিধায়ক হন নওশাদ সিদ্দিকী ।
তাঁকে ঘিরেও রাজনৈতিক জলঘোলা কম হয়নি । যার রেশ এবারের লোকসভা নির্বাচনেও পড়েছে । তিনি শত চেষ্টা করেও এবারের নির্বাচনে দলীয় নেতাদের বামেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ করাতে পারেননি । যা যাদবপুরে বামেদের কাছে চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
অন্যদিকে, 2009 সাল থেকে যাদবপুরে তৃণমূল জয়ী হয়ে আসছে । 2019 সালে তৃণমূলের মিমি চক্রবর্তী 2 লক্ষ 95 হাজার 239 ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ৷ তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল 6 লক্ষ 88 হাজার 472 ৷ বিজেপি প্রার্থী অনুপম হাজরা 3 লক্ষ 93 হাজার 233 ভোট পেয়েছিলেন ৷ সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য 3 লক্ষ 2 হাজার 264 ৷
তৃণমূল পেয়েছিল মোট ভোটের প্রায় 48 শতাংশ। যার এক তৃতীয়াংশ ভাঙড় থেকে এসেছিল । কিন্তু, কোনও সাংসদকে দ্বিতীয়বার প্রার্থী করতে পারেনি তৃণমূল । যা শাসক তৃণমূলের কাছে অস্বস্তিকর বিষয় ।
আরও পড়ুন:
একই ভাবে 2019 সালে, যাদবপুরে বিজেপি 27 শতাংশ ভোট পায়। আর সিপিএম 21 শতাংশ ভোট পেয়েছিল । 2021 এর বিধানসভা নির্বাচন ধরলে এই যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের ছ’টি বিধানসভা বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, সোনারপুর উত্তর, সোনারপুর দক্ষিণ, টালিগঞ্জ ও যাদবপুরে সহজ জয় পেয়েছিল তৃণমূল । একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ভাঙ্গড়, যেখানে প্রবল ঘাসফুলের ঝড়ের মধ্যেও একমাত্র বাম সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী জয় পান ।
ফলে, আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতেই পারে এবারের নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের জয় এক প্রকার নিশ্চিত । কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে নিয়োগ দুর্নীতি । যাদবপুরের শিক্ষিত মানুষজনের উপর এই দুর্নীতির প্রভাব কী ! শিক্ষা, সংস্কৃতি, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাম চিন্তনপ্রিয় মানুষ কী ভাবছে, তা এখনও অজানা । এখনও অজানা এই যাদবপুরের একদা বামদুর্গ বলে পরিচিত মাটিতে কতটা পদ্মের চাষ হয়েছে !
ভুলে গেলে চলবে না 77 পরবর্তী সময় এই যাদবপুর কেন্দ্র থেকেই সাংসদ হয়েছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মালিনী ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী, কবীর সুমন, কৃষ্ণা বসু, সুগত বসুদের মতো একের পর এক হেভিওয়েট নেতা । গত পাঁচ বছর এখানে সাংসদ ছিলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীও । বরাবরই রাজনৈতিক দর্শন মতাদর্শের লড়াইয়ে অবস্থান বদলাতে দেখা গিয়েছে যাদবপুরকে । কিন্তু এবার কী হবে !
সিপিএম বলছে, তাদের প্রার্থী তথা প্রাক্তন ছাত্রনেতা সৃজন ভট্টাচার্যর পরিচিতি ও যুক্তিবাদী বক্তব্য তৃণমূলের সায়নীকে অনেকটাই ব্যাকফুটে ফেলছে । তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, যুবনেত্রী হিসাবে সায়নীর জয় একপ্রকার নিশ্চিত । তবে একসময় তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক এবার প্রার্থী সায়নীর জয়ের পথে আদৌও বাধা তৈরি করতে পারে কি না, অথবা সিপিএমের আইএসএফ জোট ভেস্তে যাওয়া যাদবপুরে তাকে বাড়তি সুবিধা করে দেয় কি না, তা বলবে সময় । এসবের মাঝে ক্রসভোটিংয়ে লক্ষ্মীলাভের আশায় বিজেপি ।
আরও পড়ুন:
যদিও বিজেপির বারুইপুর ও সোনারপুরের গ্রামীণ অঞ্চল ছাড়া যাদবপুর ও টালিগঞ্জ বিধানসভার শহর এলাকায় অবাঙালি হিন্দিভাষী ভোটব্যাংক রয়েছে কিছুটা । ফলে, বিজেপির পক্ষে জয় হাসিল করা চাপের । তাই, তৃণমূল জয়ী হলে দ্বিতীয়স্থানে কে থাকবে, তা নিয়েই বিজেপি-সিপিএমের মধ্যে লড়াই চলবে । একই ভাবে একটা বিধানসভা আসনে জয়ী হয়ে একা লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে আইএসএফ শেষের দিকে থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । যদিও এই চারটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার বিষয়ে একবাক্যে আশাবাদী, তা বলা যায় । যে কারণে তাঁরা জয়ী হলে কে কী করবেন, তা ভোট প্রচারে আগাম জানাচ্ছেন ।
সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যর বক্তব্য, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব সব চেয়ে বড় সমস্যা । যাদবপুরের জন্য 15টির বেশি কর্মসূচি রয়েছে সোনারপুর আইটি পার্ক থেকে রেললাইনের সমস্যা সমাধান । বারুইপুরে মেট্রো ট্র্যাকের সম্প্রসারণ, মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতাল ইত্যাদি কাজ করবেন ।
বিজেপি প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আবার, মেট্রোর সম্প্রসারণ, জলাভূমি সংরক্ষণ, এইমস নির্মাণ, পানীয় জলের সমস্যা সমাধান করার কথা বলছেন । অন্যদিকে, তৃণমূলের সায়নী ঘোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে আরও বেশি উন্নয়ন, বেশি বেশি প্রকল্প তত্ত্ব খাড়া করছেন ।
1977 সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল । প্রথমবার এই কেন্দ্রে জয় পেয়েছিলেন তৎকালীন দাপুটে নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় । আশি সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনিই আবার পুনর্নির্বাচিত হন । তবে 84-তে এই যাদবপুর কেন্দ্র থেকে হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে দিল্লিতে নিজেকে জায়েন্ট কিলার বলে চিনিয়েছিলেন তৎকালীন যুবনেত্রী তথা আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তারপর বাকিটা ইতিহাস ।
বামপন্থীদের মধ্যে যুবনেতা হিসাবে যথেষ্ট জনপ্রিয় সৃজন শেষ পর্যন্ত তৃণমূল বিজেপিকে পিছনে ফেলে তিনি কি শেষ হাসি হাসতে পারবেন ? হতে পারবেন কি জয়েন্ট কিলার । তবে যাদবপুর লোকসভার ভোটাররা কাকে বেছে নেন, তা জানতে 4 জুন অপেক্ষা করতে হবে ।
আরও পড়ুন: