গঙ্গারামপুর, 14 অগস্ট: প্রতিদিন লাগত পাঁচ কিলো চালের ভাত ৷ সঙ্গে আনুষঙ্গিক ডাল-তরকারি ৷ তার ওজনও নেহাত কম ছিল না ৷ কিলোখানেক তো হয়েই যেত৷ শুনলে অবাক লাগলেও সিদ্দিকা পারভিনের এটাই ছিল প্রতিদিনের মেনু ৷
বাবা নিতান্তই প্রান্তিক কৃষক ৷ তাঁর পক্ষে মেয়ের এই খোরাক জোগাড় করা কঠিন হয়ে উঠেছিল ৷ কিন্তু মেয়েরও কিছু করার ছিল না ৷ সাত ফুট আট ইঞ্চি লম্বা আর 160 কিলো ওজনের শরীরটার জন্য অতটা খাবার তো লাগবেই ৷ অবশ্য এগিয়ে এসেছিল ব্লক প্রশাসন, এলাকার মানুষজনও ৷ বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতাবিশিষ্ট মহিলা হিসাবে সিদ্দিকার নাম 2013 সালে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নথিভুক্ত রয়েছে ৷ বুধবার দুপুরে গঙ্গারামপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে মাত্র 36 বছর বয়সে সেই সিদ্দিকার জীবনাবসান ঘটল ৷
1988 সালে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বংশীহারী ব্লকের শ্রীরামপুর গ্রামে সিদ্দিকা পারভিনের জন্ম ৷ বাবা আফাজুদ্দিন আহমেদ পেশায় কৃষক ৷ মা মানসুরা বিবি সাধারণ গৃহবধূ ৷ জন্মের পর সিদ্দিকা কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই ছিলেন ৷ যখন তাঁর 23 বছর বয়স, তখন থেকে সমস্যার শুরু ৷ হঠাৎ করেই তাঁর শরীর বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ৷ আফাজুদ্দিন সাহেব এলাকায় বহু চিকিৎসা করালেও মেয়েকে সুস্থ করতে পারেননি ৷ শেষ পর্যন্ত তিনি মেয়েকে কলকাতা নিয়ে যান ৷ সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, সিদ্দিকার পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে একটি টিউমার রয়েছে ৷ তার জন্যই তাঁর শরীরের এই পরিবর্তন ৷ ওই টিউমার অপারেশনে প্রচুর টাকার প্রয়োজন ৷
চিন্তায় পড়ে যান আফাজুদ্দিন সাহেব৷ ততদিনে সিদ্দিকার শরীর বিশাল আকার ধারণ করেছে ৷ ঠিক সেই সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সিদ্দিকার খবর প্রকাশিত হয়৷ শোরগোল পড়ে যায় দেশ জুড়ে ৷ শেষ পর্যন্ত 2014 সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় দিল্লি এইমসে সিদ্দিকার পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের টিউমার অপারেশন হয় ৷ সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর কিছুদিন সুস্থই ছিলেন তিনি ৷ কিন্তু বছরখানেক পর ফের সমস্যা দেখা দেয় তাঁর ৷ ওই টিউমার আবার দেখা দেয় ৷ এবার রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কলকাতার পিজি হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয় ৷ তারপর খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি ৷ তবে প্রতি মাসে একটি করে দামি ইনজেকশন দিতে হত তাঁকে ৷
কী হয়েছিল সিদ্দিকার ? তাঁর মামা মোক্তারুল ইসলাম বলেন, “মাসখানেক ধরেই খানিকটা অসুস্থ ছিল সিদ্দিকা ৷ এক সপ্তাহ ধরে ওর মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷ আর্থিক সংকটে বাবা-মা চিকিৎসা করাতে পারেনি ৷ আজ সকালে ওর শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে যায় ৷ প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ৷ ওকে প্রথমে স্থানীয় রশিদপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ সেখানকার চিকিৎসকরা সিদ্দিকাকে গঙ্গারামপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে রেফার করে দেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে ওকে গঙ্গারামপুরে নিয়ে যাই ৷ সেখানকার চিকিৎসকরা ওর কোনও পরীক্ষা না করেই জানিয়ে দেন, সিদ্দিকার শরীরের পরিস্থিতি ভালো নয় ৷ তাঁকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেন সুপার স্পেশালিটির চিকিৎসকরাও ৷ কিন্তু আর ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়নি ৷ বেলা সোওয়া 12টা নাগাদ সেখানেই মারা যায় ভাগ্নি ৷”
সিদ্দিকার মৃত্যুতে শোকাহত গোটা জেলা ৷ শোকাহত বংশীহারীর বিডিও সুব্রত বলও ৷ তিনি বলেন, “শ্বাসকষ্টজনিত কারণে আজ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হোল্ডার সিদ্দিকা পারভিন গঙ্গারামপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৷ খুবই দুঃখজনক ঘটনা৷ তাঁর জন্য আমরা এতদিন পাঁচ কিলো করে চাল দিতাম ৷ আমরা তাঁর পরিবারের সঙ্গে আছি ৷ যে কোনও সমস্যায় সিদ্দিকার পরিবারকে সাহায্য করা হবে ৷”