কলকাতা, 27 ডিসেম্বর: একটানা দশ বছর জোট সরকার সামলেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং ৷ এই সময় তাঁর নীরবতা নিয়ে কটাক্ষ করে বিরোধীদের কেউ কেউ তাঁকে 'মৌনী-মোহন' বলতেন ৷ দলে ছিলেন উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদিও ৷
ডঃ মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এনডিএ- দুই সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারে কাজ করেছেন প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার ৷ 'নীরব প্রধানমন্ত্রী' মনমোহন সিংয়ের এই নীরবতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি ৷ দেখেছেন বিরোধীদের আক্রমণের মুখেও প্রতিক্রিয়াহীন একজনকে ৷ আর এটাও দেখেছেন অন্যজনের হাতিয়ার ইডি-সিবিআই তল্লাশি ৷ এই দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তফাৎ কোথায়, ইটিভি ভারতকে তা জানালেন প্রাক্তন আমলা জহর সরকার ৷
দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় 2009 থেকে 2011 সাল পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রকটি নিজের কাছে রেখেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ৷ সেই সময় মন্ত্রকের সচিব ছিলেন জহর ৷ অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত ডঃ মনমোহন সিংয়ের বিভিন্ন অভিব্যক্তির সাক্ষী থেকেছেন প্রাক্তন আমলা জহর সরকার ৷
যে নীরবতা নিয়ে বিরোধীরা বারবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ব্যক্তিগত সমালোচনা করতেন, তা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য, জোট সরকার সামলানোর গোপন চাবিকাঠি ৷ এই প্রসঙ্গে ইটিভি ভারতকে প্রাক্তন আমলা বলেন, "তিনি (ডঃ মনমোহন সিং) কখনও চেঁচামেচি করে বিরোধিতা করেননি ৷ সেটা তাঁর স্বভাবেই ছিল না ৷ এই সরকারের (ইউপিএ) একটা মরাল কম্পাস ছিল ৷ মরাল কম্পাস কথাটাই ব্যবহার করতে হয় ৷ অর্থনৈতিক বিষয়ে বেশি গণ্ডগোল হলে, তিনি কয়েকটি সাংবাদিক বৈঠক করে বিবৃতি দিতেন ৷ কিন্তু সাধারণভাবে, ডলারের কাছে আমাদের রুপি কেন পড়ে গেল, তা নিয়ে হুটহাট কোনও মন্তব্য করতেন না ৷ তাঁর অর্থনীতিবিদ হিসাবে যে ভূমিকা, তা নিয়ে তো কোনও প্রশ্ন নেই, তর্ক নেই ৷ অর্থনীতি বোঝেন, শিক্ষিত মানুষ ৷ দেশ চালিয়েছেন দশ বছর ৷ ফোটো অপস করতেন না ৷ পাবলিসিটি করতেন না ৷ লোককে গালাগাল দিতেন না ৷"
প্রধানমন্ত্রী ডঃ মহমোহন সিং
রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার বলেন, "তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরতেন মানুষের কাছে ৷ বুঝিয়ে দিতেন, কথায় কথায় প্রতিক্রিয়া না দিয়েও দেশ চালানো যায় ৷ আমার মাঝেমধ্যে খারাপ লাগত, কোনও প্রতিক্রিয়া দিলেন না কেন ? কিন্তু বুঝতাম, কারণ আছে ৷ ওরকম একটা কোয়ালিশন, যেখানে বাইরে থেকে কোনও ফাটল দেখা যেত না বটে কিন্তু ভিতরে নিজেদের মধ্যে কত অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল, সেটা আমরা যাঁরা কাজ করেছি, তাঁরাই জানি ৷ কংগ্রেসের নিজের মধ্যেই তো অনেকরকম বিভাজন রয়েছে ৷ অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও যে যার মতো যখন যা ইচ্ছে বলছে ৷ মোদিকে তো আর কখনও জোট সরকার চালাতে হয়নি ৷ হালে এই ছ'মাস ধরে চালাচ্ছেন ৷ তাতেই হাঁফিয়ে যাচ্ছেন ৷ এটা করতে পারছেন না, ওটা পারছেন না ৷ আর ক্রমাগত সেই হতাশা সারা ভারতকে জানিয়ে যাচ্ছেন ৷ সেই জোট সরকার দশ বছর ধরে চালিয়েছেন ডঃ মনমোহন সিং ৷ বামেরা কীভাবে তাঁকে তীব্র আক্রমণ করত, তা তো আমি দেখেছি ৷ তাদের রুচিবোধও ভালো ছিল না ৷ লালুপ্রসাদ যাদবকেও দেখেছি ৷ কিন্তু এরই মধ্যে তিনি (ডঃ মনমোহন সিং) মিশরের স্ফিংক্স-এর মতো বসে থাকতেন ৷ এই অবস্থাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা যায় ৷ তিনি সেই জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন ৷ প্রতিক্রিয়া দিতেন না, তর্ক করতেন না ৷ কারণ সেটা করলেই সরকার পড়ে যাবে ৷"
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে পার্থক্য
এই জায়গাতেই উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর পার্থক্যের দিকগুলি উল্লেখ করলেন সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব জহর ৷ তাঁর কথায়, "প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কখনও তাঁর সমালোচককে 'ইডি তল্লাশির' হুমকি দিতেন না ৷ অথবা তাঁকে নিয়ে পরদিন কাগজে বা মিটিংয়ে খুব কুরুচিকর কথা বলতেন না ৷ এটা তাঁর মধ্যে ছিলই না ৷ তিনি এভাবে চিন্তাই করতেন না ৷ কারণ শিক্ষা এবং বড় হওয়ার সংস্কৃতি, পারিবারিক সংস্কৃতির একটা মূল্য রয়েছে ৷ সেটা তাঁর মধ্যে দেখা যেত, যা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আমরা কখনওই দেখতে পাইনি ৷ কথায় কথায় লোকের পিছনে কুরুচিকর মন্তব্য করা, মিথ্যা কথা বলা ৷ ওগুলো তাঁর মধ্যে কোনও দিন দেখিনি ৷"
বাংলা সংস্কৃতিতে উদারহস্ত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন
প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার স্মৃতিচারণ করেন, "ওই দু'টি (2009-11) বছরে আমরা রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ এবং স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ পালনের কর্মসূচি শুরু করেছিলাম ৷ একটি শুরু করে শেষ করলাম ৷ আরেকটি 2011 সালে শুরু করলাম ৷ তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বাংলার মানুষের কাছে আসতে চেয়েছিল ৷ সেটা সাংস্কৃতিক কারণে না রাজনৈতিক কারণে তা আমি বলতে পারব না ৷ আমাদের উজাড় করে অর্থ দেওয়া হয়েছিল এবং সমর্থনও জানানো হয়েছিল ৷ এর একটা কারণ হতে পারে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷ এক্ষেত্রে তাঁর বাংলা প্রীতি সকলেই জানেন ৷ মনমোহন সিং সংস্কৃতি বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ৷ কিন্তু আসল কাজটি তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন ৷ প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন কমিটির ওয়ার্কিং চেয়ারম্যান ৷ সেই তাঁদের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছি ৷ তখন অনেক কিছু দেখেছি সামনে থেকে ৷"
প্রণব-মনমোহন সিংয়ের শীতল সম্পর্ক ?
প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া'র গভর্নর হয়েছিলেন ডঃ মনমোহন সিং ৷ তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে 'স্যর' বলে সম্বোধন করতেন ৷ এরপর নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হয়ে অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিংকে অর্থমন্ত্রী করেন ৷ পরে যিনি হয়ে ওঠেন ভারতের 'অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইমিনিস্টার' ৷ রাজনৈতিক মহলে কথিত, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের একটা ঠান্ডা লড়াই ছিল ৷ এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ খারিজ করলেন ডঃ মনমোহনের মন্ত্রকের কর্মী জহর সরকার ৷
দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "লোকে বলত, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে ৷ আমি কিন্তু এর কোনও পরিচয় পাইনি ৷ আমি বোকা-আমলা হতে পারি। অনেকবার দু'জনের মধ্যে ফাইল নিয়ে চালাচালি করেছি ৷ দুজনকেই দেখেছি, তাঁরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যেখানে একে অপরের সঙ্গে বোঝাপড়াটা তৈরি করে নিয়েছিলেন ৷ ডঃ মনমোহন সিংয়ের কাছে কোনও ফাইল নিয়ে গেলে তিনি বলতেন, 'আগে প্রণববাবুকে দেখিয়ে নিন ৷ তাঁকে না দেখিয়ে আমার কাছে কোনও ফাইল দেখাবেন না ৷' আর প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে গেলে তিনি বলতেন, 'এটা নিয়ে কি আপনি মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন ?' তাঁদের সম্পর্কটা এমন ছিল যে, একজন আরেকজনকে কখনও টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করতেন না ৷ অন্তত সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় ৷ তাঁদের দু'জনের সমর্থনের ফলে মিটিংগুলো খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত ৷ অনেক রকম কাজ এবং কোটি কোটি টাকা অর্থ ব্যয় সত্ত্বেও কোনও দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠেনি ৷"
মানুষ ডঃ মনমোহন সিং
অন্তর্মুখী কর্তার নানা মুহূর্তের অভিব্যক্তিরও সাক্ষী থেকেছেন সচিব জহর ৷ তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে ডঃ মনমোহন সিংয়ের ছবিতে অবাক হয়েছেন অনেকেই ৷ আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক সেরে গম্ভীর মুখে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকেও দেখেছেন তিনি ৷
জহর সরকারের স্মৃতিচারণ, "আমি একদিন পেন ফেলে চলে গিয়েছি ৷ তিনি পিছন পিছন দৌড়াচ্ছেন ৷ আমাকে ডেকে বললেন, 'জহর আপনি পেনটা ফেলে গিয়েছেন ৷' ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী যে এভাবে একটা পেন নিয়ে ছুটবেন, আমি কোনও দিন কল্পনাও করতে পারি না ৷"
তিনি বলেন, "যাঁকে স্নেহ করতেন, তাঁকে স্নেহ করতেন ৷ যাঁকে সন্দেহ করতেন, তাঁর বিষয় চুপ করে থাকতেন ৷ কথা কম বলতেন, পাবলিসিটি একেবারেই পছন্দ করতেন না ৷ এর জন্য পার্টি এবং সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৷ কিন্তু তাঁর স্বভাবটাই এরকম ছিল ৷ অনেক ধরনের কথাবার্তা, সমালোচনা তিনি সহ্য করে নিতে পারতেন ৷ মুখে ছাপ পড়ত ঠিকই, কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করতেন না ৷ কারও সঙ্গে তর্ক করতেন না ৷ কাউকে হেয় করতেন না ৷ নাম দেখে কখনও কিছু বিচার করতেন না ৷"
মিতবাক প্রতিক্রিয়াহীন প্রধানমন্ত্রী কি কখনও বিষাদগ্রস্ত হয়েছেন ? এমন একটি ঘটনার কথা মনে করলেন প্রাক্তন সচিব জহর সরকার, "এ ধরনের ঘটনা তো দেখেছি। কখনও কখনও দেখেছি ক্যাবিনেট মিটিং থেকে বেরিয়ে বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৷ বছরের পর বছর কাজ করেছি ৷ কখনও দেখেছি, আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ৷ আমি তাঁর সচিবকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে ? তখন তিনি বললেন, ক্যাবিনেটে চেঁচামেচি হয়েছে ৷ ওই দলের নেতা তাঁকে (ডঃ মনমোহন সিংকে) ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন ৷ তিনি তো কিছু বলেননি ৷ তাঁর হয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদাম্বরমও চেঁচিয়েছেন ৷ এর কিছুক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন, 'চলো কাজ শুরু করা যাক', কাজ শুরু করলাম ৷"
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাস্যরস
গুরুগম্ভীর প্রধানমন্ত্রীকে হাসতে দেখেছে দেখেছেন জহর সরকার ৷ তাও আবার তাঁরই সঙ্গে ৷ এমন একটি ছবি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন প্রাক্তন আমলা ৷ সেই ছবির নেপথ্যে রয়েছে একটি গল্প ৷
প্রাক্তন আমলা বলে চলেন, "আমার ও মনমোহন সিংয়ের একটি ছবি আমি পোস্ট করেছি ৷ ওই ছবি দেখে আমায় সবাই জিজ্ঞাসা করেছিল, তাঁকে তুমি কীভাবে হাসালে ? এই ছবির পিছনে একটি ঘটনা আছে ৷ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ভারতের একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে ৷ আমি ডঃ মনমোহন সিংয়ের পাশেই বসেছিলাম ৷ তাঁর পাশে বসেছিলেন মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ৷ তাঁর বাঁপাশে বসেছিলেন মঙ্গোলিয়ার সাংস্কৃতিক সচিব ৷"
"দুই দেশের সাংস্কৃতিক সচিব ফাইল স্বাক্ষরের পর ফিরে গিয়ে তাঁর (ডঃ মনমোহন সিং) পাশে বসেছি ৷ তাঁর মুখ সেই স্ফিংক্সের মতো ৷ কোনও রূপরেখা নেই ৷ তিনি আমাকে বিড়বিড় করে জিজ্ঞাসা করলেন, 'জহর, এতে আমাদের কী লাভ হবে ? আমি বললাম, স্যর আমরা শত শতাব্দী ধরে হুনেদের দূরে রাখতে চেষ্টা করেছি ৷ সেই হুনেদের সঙ্গেই আমরা এখন ঘর করব। সেটা শুনেই উনি হাসতে আরম্ভ করলেন ৷" প্রাক্তন আমলা জহর সরকার তিন বছর রাজ্যসভার সাংসদ পদে ছিলেন ৷ সম্প্রতি আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তিনি ইস্তফা দেন ৷