দুর্গাপুর, 15 ডিসেম্বর: পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর । এরপর 12 বছরের দীর্ঘ লড়াই বাবা-মা ও স্ত্রীর ৷ অবশেষে ঘাতক গাড়ির বিমা কোম্পানি থেকে আড়াই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পেল মৃতের পরিবার ৷ শনিবার দুর্গাপুরে জাতীয় লোক আদালত ওই পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় ৷ সম্ভাব্য এত বিপুল পরিমাণ টাকার ক্ষতিপূরণ রাজ্যে প্রথম ।
মৃতের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির নাম আশিসকুমার বড়াল ৷ তিনি ওড়িশার ভুষণ স্টিল লিমিটেডে একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন ৷ ঘটনার সূত্রপাত 2012 সালে ৷ 17 জানুয়ারি তিনি কোম্পানির কাজে বাইরে গিয়েছিলেন ৷ অন্যদের সঙ্গে কোম্পানির গাড়ি করেই ফিরছিলেন আশিস ৷
পথে ওড়িশার ঢেঙ্কানল জেলার বালিমি থানার অন্তর্গত 55 নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আশিসের গাড়িটি ৷ আশিসকুমার বড়াল আদতে দুর্গাপুরের বাসিন্দা ৷ তিনি ঘটনায় গুরুতর আহত হন ৷ পরে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপরেই ঘাতক গাড়ির ইন্সুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেন আশিসের পরিবার ।
ওই মামলায় নিষ্পত্তি হতে 12 বছর লেগে গেল ৷ এর কারণ, একদিকে ভুষণ স্টিল লিমিটেডে হাত বদল হয়ে অধিগ্রহণ করেন টাটা স্টিল লিমিটেড ৷ যার ফলে মামলায় প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র অমিল হয়ে পড়ে । কিন্তু মামলাকারীদের আইনজীবী আয়ুব আনসারী পরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করে আদালতে দাখিল করেন ৷
তবে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় আগেই আশিসের বাবা বয়সজনিত কারণে মারা যান । ভবিষ্যতে মামলাটি নিষ্পত্তিতে আরও বেশি সময় লাগার আশঙ্কা করেন আইনজীবী ৷ এরপরেই তিনি দুর্গাপুরে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (মোটর) টিপি হাবের ইনচার্জ অভিনব ও তাঁর টিমের কাছে বারবার দরবার করেন ৷
দুর্গাপুর মহকুমা আদালতের বিচারক মহম্মদ রফিক আলম সাহেবকে নিয়ে গঠিত হওয়া জাতীয় লোক আদালতের বেঞ্চে আশিসের পরিবারের কথা বিবেচনা করে উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে মামলাটির নিষ্পত্তি হয় ৷ জাতীয় লোক আদালতের বিচারক আড়াই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন মৃতের পরিবারকে । ওই টাকা আগামী একমাসের মধ্যে দিতে হবে বিমা কোম্পানিকে ৷ অনাদায়ে 6 শতাংশ হারে সুদ প্রদান করার আদেশ দিয়েছে আদালত ।
শনিবার সারা দেশ জুড়ে জাতীয় লোক আদালত অনুষ্ঠিত হয় । যার মাধ্যমে বহুদিন জমে থাকা বিভিন্ন ধরনের মামলার নিষ্পত্তি হয় । সেসময় দুর্গাপুর মহকুমা আদালতেও জাতীয় লোক আদালত অনুষ্ঠিত হয় । সেখানে নজীরবিহীনভাবে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত জমে থাকা মামলায় আদালত আড়াই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয় ।
আশিসের পরিবারের আইনজীবী আয়ুব আনসারী বলেন, "একসময় মামলায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে না পারায় খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই ৷ কিন্তু আরটিআই করে শেষমেশ মামলায় নতুন করে জট খুলে যায় ৷ আর তারই মাঝে আশিসবাবুর বাবার মৃত্যু হয় এবং মাও অনেক অসুস্থ ৷ সেকারণে দেরি না করে আদালতের সাহায্য নিয়ে ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছে দরবার করা হয় ৷ শেষে লোক আদালতের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করা হয় ৷ ওই পরিবার আর্থিক সাহায্য পাবে তাতে ভালো লাগছে ৷ তবে আশিসবাবুর বাবা বেঁচে থাকলে এই রায় দেখতে পারতেন । অর্থ কোনোদিন কোনও ক্ষেত্রে মানুষের পরিপূরক হতে পারে না ৷ তবে একমাত্র অসহায় সম্বলহীন পরিবারের কিছুটা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ।"
অপরদিকে ন্যাশানাল ইন্সুরেন্স কোম্পানির টিপি হাব (মোটর) দুর্গাপুরের ইনচার্জ অভিনব ও কলকাতা হেড অফিসের ইনচার্জ বিকে সত্যপ্রকাশের কথায়, "ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স কোম্পানি সব সময় অসহায় সম্বলহীন পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে ৷ ভারতে প্রথম এত বেশি পরিমাণ অর্থ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি মোটর দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিল । আজকের লোক আদালতের নির্দেশের পর দুর্গাপুর টিপি হাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আশিসবাবুর পরিবারের হাতে চেক তুলে দেওয়া হয় ৷"
আশিসের স্ত্রী সুশ্বেতা বড়াল বলেন, "2012 সালে দুর্ঘটনায় আমার স্বামীর মৃত্যু হয় ৷ সেসময় আমরা দিল্লিতে থাকতাম ৷ আজ আমরা কোম্পানির থেকে ক্ষতিপূরণ পেলাম ৷ কিন্তু আমি স্বামীকে হারিয়েছি ৷ আমার মেয়ে 5 বছর বয়সে বাবাকে হারায় ৷ সেই ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবে না ৷ টাকা দিয়ে তো নয়ই ৷ তাই ক্ষতিপূরণের কথা ভাবিনি ৷ তাই যে টাকা পেয়েছি, সেটা নিয়ে লোভ ছিল না ৷ আমার স্বামীর মতো ভালো মানুষ হয় না ৷ ও অনেক কিছু করতে পারত ৷ কিন্তু সেটা আর হল না ৷"