কলকাতা, 12 সেপ্টেম্বর: আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করতে তিন দিন অপেক্ষা করেছেন বলে কার্যত ক্ষোভ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাও চিকিৎসকরা এলেন না এবং সমস্যার সমাধান হল না ৷ এই অবস্থায় মানুষের স্বার্থে তিনি ইস্তফা দিতেও রাজি, জানালেন তৃণমূল সুপ্রিমো ৷ নবান্নের কনফারেন্স রুম থেকে একটি সাংবাদিক বৈঠক করে এই কথা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় ৷
এদিকে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ও বিক্ষোভের ফলে যে চিকিৎসা বিভ্রাট তৈরি হয়েছে, তাতে আমজনতা চিকিৎসা পাচ্ছে না ৷ আন্দোলনের 32 দিনে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে 27 জনের ৷ তাই সাধারণ মানুষকে কৈফিয়ত দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার, স্পষ্ট বার্তা দিলেন প্রশাসনিক প্রধান ৷
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নবান্ন সভাঘরে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকের সব বন্দোবস্ত করা থাকলেও লাইভ স্ট্রিমিং নিয়ে টানাপড়েনের জেরে তা হল না ৷ আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা যখন স্বচ্ছতার স্বার্থে বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সিদ্ধান্তে অনড় ৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, এই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন ৷ তাই এর লাইভ স্ট্রিমিং করা সম্ভব নয় ৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভিডিয়ো রেকর্ডিং করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ৷ কিন্তু সরকারের এই দাবি মেনে নিল না জুনিয়র চিকিৎসকরা ৷
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বারবার 'খোলা মনে আলোচনার' প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এসেছে ৷ এছাড়া তিনি নিজে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হয়েও মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চিকিৎসকদের জন্য নবান্নে অপেক্ষা করে থেকেছেন, তাও মনে করিয়ে দিলেন ৷
হাত জোড় করে মমতা বলেন, "জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বসে আলোচনার জন্য আমি সব দিক দিয়ে চেষ্টা করেছি ৷ সুপ্রিম কোর্ট কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে ৷ তা জুনিয়র ডাক্তাররা মানেননি ৷ তারপরেও আমি তিনদিন আমার সরকারি উচ্চাধিকারিকদের নিয়ে অপেক্ষা করেছি ৷"
এই সুপ্রিম নির্দেশ প্রসঙ্গ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, সুপ্রিম কোর্টের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজ্য সরকার যা করবে, আমরা তাকে সমর্থন করব ৷ তারপর ডেকেছি তাঁদের ৷ তাঁরা আসেননি ৷"
সাংবাদিক বৈঠকে প্রথম দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান তিনি এই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ক্ষমা করে দিয়েছেন ৷ কারণ তাঁরা তাঁর ভাই-বোন ৷ আর ছোটদের ক্ষমা করাই সৌজন্যতা ৷ তাছাড়া বিক্ষুব্ধ চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চেয়ারের নয় ৷ তাও তাঁর বক্তব্যের শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেই ফেললেন, 'ওরা বিচার চায় না, চেয়ার চায়' ৷
এই সমস্যার সমাধান না-হওয়ায় বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমা চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, "আমি দু'ঘণ্টা বসে আছি ৷ তিনদন ধরে বসে আছি ৷ আমার সর্বোচ্চ সরকারি আধিকারিকদের নিয়ে বসে আছি ৷" এমনকী যাঁদের নিয়ে ডাক্তারদের অভিযোগ, বিক্ষোভ তাঁদের কাউকে এই বৈঠকে রাখেননি মমতা ৷
9 অগস্ট সুপ্রিম কোর্টে এই আরজি করের নির্যাতিতার ধর্ষণ ও খুনের মামলার শুনানি ছিল ৷ সেদিন শীর্ষ আদালত পরদিন অর্থাৎ 10 অগস্ট বিকেল 5টার মধ্যে জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে ফেরার নির্দেশ দিয়েছিল ৷ এদিকে 10 অগস্ট থেকে স্বাস্থ্যসচিবের পদত্যাগ-সহ 5 দফা দাবি নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান করে আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা ৷
এদিনও যে চিকিৎসকরা এলেন না বৈঠকে তাঁদের তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "মিটিং ডেকে নবান্নের গেট থেকেও যাঁরা এলেন না, তাঁদের আমি আবার ক্ষমা করে দিলাম ৷ আমার আবেদন, আপনারা কাজে যোগদান করুন ৷ আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম ৷" বরং, ডাক্তারদের আন্দোলনের বিপরীতে তিনি এখন ধৈর্য ধরার পরীক্ষা দিচ্ছেন, বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মধ্যে কয়েকজন লাইভ স্ট্রিমিংয়ের শর্ত বাদ দিয়েও এই বৈঠকে যোগ দিতে চেয়েছিলেন ৷ সংবাদমাধ্যমের তোলা ছবি, ভিডিয়োতে তা দেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ কিন্তু বাইরে থেকে নির্দেশ এসেছে যেন লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়া এই বৈঠকে যোগ না দেন জুনিয়র ডাক্তাররা ৷ এই দৃশ্য খেয়াল করেছে প্রশাসন, জানিয়ে দিলে মুখ্যমন্ত্রী ৷
পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অন্য রাজ্যের পরিসংখ্যান দিতে উত্তরপ্রদেশের নাম প্রায়শ নেন তৃণমূল নেতা, মন্ত্রীরা ৷ এই অচলাবস্থার তুলনাতেও সেই যোগী রাজ্যের কথা উঠল ৷ জুনিয়র চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতি ও আন্দোলন এবং তার ফলে রাজ্যজুড়ে চলতে থাকা অচলাবস্থা আর কোথাও হয় না, বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি বললেন, "ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরপ্রদেশে মিছিল, বনধ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ৷ আমাদের হাতেও এসমা (ইমারজেন্সি সার্ভিস অফ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) প্রয়োগের ক্ষমতা আছে ৷ কিন্তু আমি করব না ৷ কারণ আমি ইমারজেন্সির সাপোর্টার নই ৷"
এই আন্দোলনের নেপথ্যে রং দেখতে পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারছেন না ৷ তিনি বলেন, "সোশাল মিডিয়ায় অনেক কুৎসা রটনা, ভুল প্রচার হয়েছে ৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না যে এর মধ্যে একটা কালার আছে ৷ মানুষ এসেছিলেন বিচার চাইতে ৷ আশা করি, মানুষ বুঝতে পারছেন যে ওরা বিচার চায় না, চেয়ার চায় ৷"
রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতেও রাজি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাঁর কথায়, "মানুষের স্বার্থে আমি পদত্যাগ করতেও রাজি আছি ৷ আমার মুখ্যমন্ত্রীর পদ চাই না ৷ শুধু চাই, মানুষ বিচার পাক ৷ তিলোত্তমা বিচার পাক ৷ আর সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পাক ৷"