কলকাতা, 24 জুন: লোকসভা ভোটে ভালো ফলের পর এ যেন রাজধর্ম পালন। গত কয়েকদিন প্রশাসনিক বৈঠকে টুকরো টুকরো যে অসন্তোষের কথা শোনা যাচ্ছিল মুখমন্ত্রীর মুখে সোমবার নবান্ন সভাঘরে পুরসভাগুলির সঙ্গে বৈঠকে রীতিমতো ক্ষোভের উদগীরণ হল। প্রোমোটার রাজ, প্রশাসনের একাংশের কাটমানি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গা-ছাড়া মনোভাব কোনও কিছুই বাদ গেল না এদিন। রাজ্যের তাবড় মন্ত্রীর নাম করেও ভর্ৎসনা করতে শোনা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে ৷ বৈঠকের একটি অংশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, 'রাজারহাটে সল্টলেকে ইচ্ছামতো বাইরের লোক বসাচ্ছে সুজিত'৷
বিধায়ক, মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ এবং পুরসভা নিয়ে পর্যালোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে সকলেই। একটা সময় তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমনটাও বলতে শোনা গেল, "তাহলে কি ঝাঁটা হাতে এবার নামতে হবে আমাকে ?" পুরসভাগুলোকে নিয়ে আলোচনা উঠতেই এদিন পুকুর ভরাট, প্রমোটার রাজ, সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাওয়া, ফুটপাত দখল একের পর এক অভিযোগ এসেছে মমতার মুখে। আর অগ্নি শর্মা হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, অনেক হয়েছে। কাজকর্মে আগামিদিনে কোনও অস্বচ্ছতাই বরদাস্ত করবেন না তিনি।
এদিন পুরসভাগুলিকে নিয়ে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী রোষের মুখে পড়ে একাধিক পুরসভা। বিধাননগর, নিউটাউন, কলকাতা কর্পোরেশন সকলকেই এদিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মধ্যে পড়তে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কড়া আক্রমণের মুখে পড়েন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। সরাসরি তাঁর নাম করে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, "কারও কারও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, থানার আইসি, জেলাশাসক, এসডিও হলে ইনকাম করা ৷ অনুগ্রহ করে আর এসব করবেন না ৷ এবার খুব চোখে লাগছে ৷ রাজারহাটে সল্টলেকে ইচ্ছামতো বাইরের লোক বসাচ্ছে সুজিত বসু ৷"
যখন তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ করছেন তখন সুজিত বসুর মুখে রীতিমতো চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ৷ মমতার কথায়, "প্রতিযোগিতা করে সুজিত লোক এনে বসাচ্ছে।" হঠাত এহেন অভিযোগ শুনে কিছুটা হকচকিয়ে যান রাজ্যের দমকলমন্ত্রী। তাঁকে বলতে শোনা যায়, "আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না।" সে সব কার্যত উপেক্ষা করেই মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, "কত টাকার বিনিময়ে সল্টলেকে জবরদখল হচ্ছে ? কেন কর্পোরেশন কাজ করছে না ? আমি কোনও অবহেলা বরদাস্ত করব না ৷ একটা চক্র কাজ করছে ৷ কোনওভাবেই এসব চলবে না ৷ সব ভেঙে দেব ৷" এদিন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিধান নগরের মেয়র কৃষ্ণ চক্রবর্তীও। মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, "বিধান নগরের সাফাইয়ের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় ময়লা জমে আছে।"
পুরপ্রধান এবং প্রশাসকদের টেন্ডার নিয়েও এদিন রীতিমতো অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর গলায় উঠে এসেছে পুকুর ভরাট প্রসঙ্গও ৷ মুখ্যমন্ত্রীর মতে, টেন্ডারের মাধ্যমে একশ্রেণির আধিকারিক এবং জনপ্রতিনিধিরা টাকা তুলছেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেক্টর ফাইভের ওয়েবেলের সামনে খাবার দোকানের রমরমা নিয়ে তাঁকে সরব হতে দেখা যায়। তিনি বলেন, "প্রতিদিনই এই ধরনের দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। আমি বেকার ছেলেদের চাকরি খাওয়ার পক্ষে নই। এভাবে রাস্তা আটকে খাবার দোকান না করে আলাদা করে ফুড জোন করা যেতে পারে ৷"
শুধু সল্টলেক নয়, কলকাতার হাতিবাগান, গড়িয়া মার্কেট নিয়েও কড়া আক্রমণ করেছেন মমতা ৷ তাঁর কথায়, "গড়িয়াহাটে কলকাতা কর্পোরেশনের তরফ থেকে যে স্টলগুলো দেওয়া হয়েছিল তার পরেও দখলদারি বাড়ছে ৷ এক্ষেত্রে কালো প্লাস্টিক টাঙিয়ে আবার এলাকা সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে ৷" বিভিন্ন পুরসভায় পানীয় জল ও রাস্তার আলোর যথেচ্ছ অপচয় নিয়েও সোমবার স্বরূপ হতে দেখা যায় মমতাকে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "জোকায় এখনও কাঁচা রাস্তা আছে ৷ কেন কলকাতা কর্পোরেশনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও এমনটা হবে ৷ পুকুর ভরাট হলে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দিতে হবে ৷ যারই হোক যত বড় অফিসার মন্ত্রীরই হোক না কেন বরদাস্ত করব না ৷ নবান্নের পাশেও বেআইনি বাড়ি হয়েছে ৷ রাস্তা ফুটপাথে জবরদখল বেড়েই চলেছে ৷ পুরসভ- পুলিশ সবাই চোখ বন্ধ করে আছে ৷ কেউ দেখছে না ৷"
এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "রাস্তার কলগুলি থেকে জল পড়েই চলেছে। রাস্তার আলোও দিনের বেলায় জ্বলছে। রাজ্য সরকারের কোটি কোটি টাকা জলে যাচ্ছে। কোথা থেকে টাকা আসবে ? একদিকে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না৷ কষ্ট করে টাকা জোগাড় করা হচ্ছে ৷ আর সেই টাকার অপচয় হচ্ছে।" এদিন মুখ্যমন্ত্রী জল অপচয় রুখতে আধুনিক ব্যবস্থা করা যায় কি না, তার পরামর্শ দিয়েছেন।
একইভাবে বিদ্যুতের অপচয় রুখতে বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পুরসভা গুলিতে আলো জ্বলবে বলে সময়ও বেধে দিয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, বর্ষা এলে বিভিন্ন জায়গায় শর্ট সার্কিটের সমস্যার কথা শোনা যায় ৷ এদিন তা নিয়েও রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অরূপ বলার চেষ্টা করেছিলেন, এই বিষয়টি দেখে পুরসভাগুলিই। এক্ষেত্রে তাকেও এই ব্যবস্থা সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন মমতা। মোটের উপর রাজনীতির রং না দেখে পুলিশ আধিকারিক জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সকলকে এক লাইনে রেখে মূলত নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন এক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি থাকলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই তা শুধরে নেওয়ার জন্য সময় দিয়েছেন ৷