কলকাতা, 8 অগস্ট: কর্মসূত্রে রাজনীতিক ও প্রশাসক হলেও ব্যক্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিবান মানুষ ৷ তিনি আর পাঁচজন রাজনীতিকের থেকে আলাদা ৷ কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্য ৷ সেই সূত্রেই সাহিত্যচর্চার প্রতি অনুরাগ তাঁর জন্মগত ৷ একইসঙ্গে, তিনি ছিলেন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ৷ বহু বিদেশি লেখকের বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন ৷ আবার বামপন্থা নিয়ে নিজেও লিখেছেন বেশকিছু বই ৷ লিখেছেন নাটকও ৷ এককথায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন আপাদমস্তক সংস্কৃতিবান একজন মানুষ ৷ যাঁর জীবন রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে ছড়ানো রয়েছে বিস্তৃত পরিসরে ৷
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পড়তেন শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে ৷ এরপর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ কলেজ জীবনে রাজনীতিতে মন ছিল না ৷ বরং কাকার মতোই সাহিত্যচর্চা নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন ৷ ভালোবাসতেন নাটক ৷ কফি হাউসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন এ সব নিয়েই ৷ তাঁর পড়ার টেবিলে থাকে থাকে সাজানো থাকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র, কাফকা ও মায়কোভস্কির বই ৷
বুদ্ধদেবের জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল কলম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকুইজের লেখা ৷ মারকুইজ, পাবলো নেরুদা-সহ বহু বিদেশি লেখকের লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুইজের উপন্যাস অনুবাদ করে তিনি নাম দেন 'বিপন্ন জাহাজের নাবিক' ৷ এই অনুবাদ সেই সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায় ।
নাটক ও ফিল্মের প্রতি বুদ্ধদেবের অনুরাগও সর্বজনবিদিত ৷ সুস্থ থাকাকালীন শহরে কোনও ভালো নাটক বা ফিল্ম তিনি মিস করতেন না ৷ 1993 সালে তিনি 'দুঃসময়' নাটকটি রচনা করেন ৷ যার মূল বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে মানবতার জয় ৷ পরে এই নাটক বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং নানা মহলে প্রশংসিতও হয়েছে ৷ এ ছাড়াও তাঁর লেখা আরও দুটি নাটক 'ইতিহাসের বিচার' ও 'রাজধর্ম'৷
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা নাটক 'পোকা' নিয়েও চর্চা হয়েছিল বিভিন্ন মহলে । তবে এটি সম্পূর্ণ তাঁর নিজের লেখা নয় । ফ্রানজ কাফকার 'মেটামরফোসিস' অবলম্বনে ওই লেখা ৷ তবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে অনেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ 'পুড়ে যায় জীবন নশ্বর'-এর কথা উল্লেখ করেন ৷ এটি 1999 সালে প্রকাশিত । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটগল্পকে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অসাধারণ বিশ্লেষণ করে সেই আলোচনাগ্রন্থে প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷
এ ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বহু রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন ৷ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দশ বছর ও শেষ দশ বছর নিয়ে দুটি খণ্ডে 'ফিরে দেখা' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যা ইতিহাসের দলিল ৷ রাজনৈতিক বিষয়ে লেখা তাঁর আরও দুটি গ্রন্থ 'নাৎসি উত্থান ও পতন' এবং 'স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা' বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
পশ্চিমবঙ্গের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী থাকাকালীন আটের দশকে সমরেশ বসুর একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ করার সুপারিশ এসেছিল তাঁর কাছে ৷ কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি ৷ সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ সেই চিন্তাধারাই ধরা দিয়েছে তাঁর প্রতিটি লেখায় ৷ 1998 সালেও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের সাক্ষী থাকে বাংলার মানুষ ৷ সে বার কলকাতা বইমেলায় বিধ্বংসী আগুনে বহু স্টল পুড়ে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল ৷ তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সেই বইমেলা তিন দিনের মধ্যে পুনর্জন্ম লাভ করে ৷ সরকারি পরিকাঠামো ও আর্থিক সাহায্য নিয়ে গিল্ডের পাশে দাঁড়ান তিনি ৷ বাঙালি ফিরে পায় তার প্রাণের উৎসব ৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই সাহিত্যপ্রেম ও সংস্কৃতিমনস্কতাই তাঁকে বাঙালির মনে চিরকালীন জায়গা তৈরি করে দিয়েছে ৷