জলপাইগুড়ি, 22 অগস্ট: আরজি কর-কাণ্ডের পর স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে ৷ যার বেশিরভাগই রয়েছে ওই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ৷ এই ঘটনায় যাঁরা জড়িত বলে যাঁদের নামে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদেরই একজন ড. সুশান্ত রায় ৷ তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে যে অভিযোগগুলি উঠেছিল, সেগুলি নিয়েই ফের হইচই শুরু হয়েছে ৷ যদিও অভিযোগকারীদের গুরুত্ব দিতে নারাজ ড. সুশান্ত রায় ৷
চোখের ডাক্তার থেকে উত্তরবঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের ওএসডি ৷ প্রভাবশালী ডাক্তারবাবু । সেই প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক বেনিয়ম-স্বজনপোষণ করার অভিযোগ ওঠে ড. সুশান্ত রায়ের বিরুদ্ধে ৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে শুরু করে কোভিড অতিমারীর সময় থেকে ৷ অভিযোগ ওঠে, প্রভাব খাটিয়ে তিনি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগগুলিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন ৷ তার পর তিনি স্বাস্থ্য় দফতরে উত্তরবঙ্গের ওএসডি হয়ে যান ৷ সেই সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে বেনিয়ম ও স্বজনপোষণের অভিযোগ ওঠে ৷
তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছেলের জন্য সরকারি বেতনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ৷ তাঁর ছেলে ড. সৌত্রিক রায় ৷ সৌত্রিক যখন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এমডি পড়ছেন, সেই সময় তাঁকে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে কন্ট্র্যাকচুয়াল মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দেখানো হয় ৷ সেই জন্য সৌত্রিক মাসে মাসে সরকারের থেকে বেতনও পেয়েছেন ৷ প্রশ্ন ওঠে, চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা একজন চিকিৎসক কীভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য সবেতন ছুটি পান ? শুধু তাই নয়, ছেলের হবু স্ত্রী, যিনি পেশায় নার্স, তাঁকে কে থ্যালাসেমিয়া ইউনিটে ছেলের সঙ্গেই ডিউটি করানোরও অভিযোগ উঠেছিল ।
এই নিয়ে হইচই পড়েছিল ৷ তদন্তও শুরু হয়৷ অভিযোগ, তার পরই তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বদলি করে দেওয়া হয় ৷ এই নিয়ে সেই সময়ই একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ইটিভি ভারত-এ ৷ তাছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও জমা পড়ে ৷ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে গ্রিন জলপাইগুড়ি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে 13 পাতার অভিযোগ করা হয় ড. সুশান্ত রায়ের বিরুদ্ধে ৷
সুশান্ত রায়ের বিরুদ্ধে ডাক্তারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরসও অভিযোগ করেছিল ৷ তারা রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা, ডিরেক্টর অফ মেডিক্যাল এডুকেশন-সহ প্রশাসনের একাধিক অভিযোগ করা হয় ৷ সুশান্ত রায় ও তাঁর ছেলে সৌত্রিক রায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চাওয়া হয় ৷ ওই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক ড. সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়, সুশান্ত রায় একজন আপাদ-মস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত লোক ৷
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা আগেও অভিযোগ করেছিলাম, একজন চোখের ডাক্তার হয়ে উনি কীভাবে উত্তরবঙ্গের সব জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক থেকে শুরু করে ডাক্তারদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন । উনি সিকিউরিটি নিয়ে নীল বাতি লাগিয়ে ঘুরতেন । কোনোভাবেই অস্থায়ী ডাক্তার এমডি ছাত্র হিসেবে সরকারি বেতন পেতে পারেন না । কিন্তু সুশান্ত রায় তাঁর প্রভাব খাটিয়ে ছেলের মাইনে দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন । সরকারি টাকা এই ভাবে তছরুপ করা যায় না ।’’
তাঁর দাবি, অভিযোগের তদন্ত করায় জলপাইগুড়ির তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ড. জগন্নাথ সরকারকে প্রভাব খাটিয়ে বদলি করা হয়েছিল । তদন্ত ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে । অভিযোগ জানানোর পরও সরকার কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ৷
একই সঙ্গে তিনি আরজি করের প্রসঙ্গ তুলেছেন ৷ অভয়ার নির্মম পরিণতির নেপথ্যেও সুশান্ত রায়ের যোগসূত্র আছে বলে তিনি দাবি করেছেন ৷ এই বিষয়ে অভিযোগ করা হবে বলেও ড. সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন ৷ তবে শুধু ড. গোস্বামী নন, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও আরজি কর-কাণ্ডে ড. সুশান্ত রায়ের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন ৷ ফলে জলপাইগুড়িতে নতুন করে হইচই পড়েছে ৷ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি নিয়ে ফের সরব হয়েছেন অনেকে ৷
গ্রিন জলপাইগুড়ির অঙ্কুর দাস বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যেই ড. সুশান্ত রায়ের দুর্নীতি নিয়ে 13 পাতার অভিযোগ ইডির কাছে জমা করেছি । মুখ্যমন্ত্রী, জেলাশাসক ও এসজেডিএ (শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)-র কাছে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছি যে বাম সরকারকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসজেডিএ-র কমপ্লেক্সের জমি নিয়েছিলেন সুশান্ত রায় । সেখানে চোখের চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা করবেন বলে জমি নিয়েছিলেন । সেই জমিতে বাড়ি হিসেবে বানিয়ে ব্যবহার করেছেন । জমির চরিত্র বদল করেছেন ।’’
তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘বর্তমানে সুশান্ত রায়ের বাড়ির সামনে ‘দৃষ্টিদান চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্র’" বোর্ড লেখা থাকলেও সেখানে কোনও চিকিৎসা হয় না ৷ আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি জমিটি সরকার ফের নিয়ে ভবঘুরেদের জন্য শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করুক । যেখানে ভবঘুরেরা থাকতে পারবেন ও দু’বেলা খেতেও পারবেন ।’’
যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তিনি কিন্তু অবসর নিয়েছেন ৷ তিনি এখন ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি । তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে ইটিভি ভারত-এর তরফে যোগাযোগ করা হয় ড. সুশান্ত রায়ের সঙ্গে ৷ তিনি জানান, কে কী বলল, তা নিয়ে উনি মাথা ঘামান না । যার যেখানে চিঠি পাঠানোর পাঠাতে পারে ৷