চন্দননগর, 20 ফ্রেব্রুয়ারি: বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্ন বিদেশি শব্দ ৷ বাংলাদেশের অভিধানে চোখ রাখলে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় প্রায় 3400 শব্দ এসেছে আরবি, ফারসি ও তুর্কি থেকে ৷ আবার 300-রও বেশি পর্তুগিজ শব্দও মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এই বাংলায় ৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আবহে এই তথ্য বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার অতিথিবৎসল রূপ ৷ আম বাঙালির মনের কোণে উঁকি দিয়ে যান অতুলপ্রসাদ ৷ আমরা গেয়ে উঠি...'মোদের গরব, মোদের আশা/আ-মরি বাংলা ভাষা ৷'
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় থেকে ব্রিটিশদের সময়কাল পর্যন্ত অসংখ্য শব্দ বাংলা ভাষায় সম্মিলিত হয়ে তার উৎকর্ষতা বাড়িয়েছে । দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ছবিই ধরা পড়েছে বাংলা ভাষাতেও ৷ বাংলা শব্দের ভাণ্ডারে কয়েক হাজার বিদেশি শব্দ যুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে আম বাঙালি রকমারি বিদেশি শব্দকে আপন করে নিয়েছে । আবার এমন অনেক উদাহরণও আছে যেখানে শাসকের রাজদণ্ডের চাপে বাংলা ভাষায় আধিক্য বেড়েছে বিদেশি শব্দের ৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শুধু বাংলা ভাষার প্রতি উন্মাদনা নয়, যেভাবে বাংলা ভাষা যুগ যুগ ধরে আত্মস্থ করেছে নানা বিদেশি শব্দকে, তার নিদর্শনকেই কুর্নিশ জানায় আম বাঙালি ৷ অনেক বিদেশি শব্দকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে বাংলা ভাষা । এত বছর পর আজও সেই বিদেশি শব্দগুলিকে পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সংবাদপত্র ও রোজকার জীবনযাত্রায় বহন করে আসছে বঙ্গবাসী । এখানেই অনন্য বাংলা ভাষা ।
বিদেশি ভাষা থেকে বাংলায় আসা শব্দগুলি দেখে নেব একনজরে:
1. ফারসি শব্দ - খুন, নালিশ, আইন, পেশকার, কাজি, দারোগা
2. আরবি শব্দ - আদালত, আসামি, উকিল, এজলাস, মামলা, জেরা
3. ফরাসি শব্দ - কার্তুজ, কুপন
4. তুর্কি ভাষার শব্দ - উর্দি, উজবুক, দারোগা, চাকু, কুলি, কোর্মা, তোপ
5. পর্তুগিজ শব্দ - গির্জা, চাবি, গুদাম, আলমারি, বালতি,পাউরুটি, আনারস
6. ওলন্দাজ ভাষার শব্দ - ইস্কাবন, রুইতন ও টেক্কা
7. ইংরেজি শব্দ - চেয়ার, টেবিল
8. চিনা শব্দ - চা ও চিনি
9. মায়ানমার শব্দ - লুঙ্গি (বস্ত্র)
10. জাপানি শব্দ - রিকশা
বাংলা সাহিত্য প্রেমীরা এখনও সাবলীল ভাবে বিদেশি শব্দ প্রয়োগ করে গর্বিত হন । মানুষের অজান্তেই হাজার হাজার বিদেশি শব্দ জায়গা করে নিয়েছে বাংলা শব্দমালায় । এ ভাবেই ভাষার সমৃদ্ধি হয় বলে দাবি করেছেন প্রাক্তন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, "সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ করতে আসা বিদেশিরা বিভিন্ন সময়ে এসেছে আমাদের দেশে । ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, আলেকজান্ডারের আমলে গ্রিক, তুর্কি ও মুঘলরা ভারতে আসে । তার পরবর্তীকালে আসে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজরা ৷ তাঁদের উপনিবেশ চলাকালীন বিভিন্ন বিদেশি শব্দ নিঃশব্দেই বাংলা ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে । রবীন্দ্রনাথের কথায়, বাংলা একটা নিজস্ব ভাষা । শুধুমাত্র বাংলা 'সংস্কৃত' থেকেই আসেনি । সংস্কৃতের তৎসম তদ্ভব ছাড়াও কোনও শব্দ সরাসরি অথবা বিভিন্ন বিদেশি ভাষা হয়েও বাংলায় যুক্ত হয়েছে । এমনও উদাহরণ আছে যে, লাতিন ও জার্মানি ভাষা ইংরেজির মধ্যে দিয়ে বাংলা শব্দমালায় প্রবেশ করেছে ।"
তিনি আরও বলেন, "1599 খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা আসে ব্যান্ডেলে । তারা দুশো বছরেরও বেশি এখানে রাজত্ব করেছে । সেইসঙ্গে পর পর চুঁচুড়া, চন্দননগর, শ্রীরামপুরে ওলন্দাজ, ফরাসিরা এখানে শিবির স্থাপন করেছে । তাদের শব্দমালা থেকে প্রচুর শব্দ এই বাংলার বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।"
সাহিত্যিক দেবাশিসের কথা অনুযায়ী, গ্রিসকে জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্রষ্টা বলা যেতে পারে । তাদের শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকেছে উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, জ্যামিতির 'কোণ' বা কোনও দ্রব্যের 'দাম' শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তা গ্রিক শব্দ রূপান্তরিত হয়ে বাংলায় এসেছে । অপরদিকে, পর্তুগিজরা যখন বাণিজ্য করতে বাংলায় এসেছে, তখন তাঁদেরও অসংখ্য শব্দ বাংলায় ঢুকেছে । যেমন আয়া, আলকাতরা, আলপিন-সহ একাধিক শব্দ এসেছে পর্তুগিজ শব্দ থেকে । এমনকি আমরা নিত্যদিন বাড়িতে যে জিনিসপত্র ব্যবহার করি, সেই বালতি, মগ ও তোয়ালে এগুলোও পর্তুগিজ শব্দ । সবজি, ফল ও খাবারের ক্ষেত্রেও এসেছে নানা পর্তুগিজ শব্দ ৷ যেমন তাদের আনারস, বিস্কুট ও আতা বহুল প্রচলিত বাঙালিদের কাছে । চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশ থাকাকালীন খুব বেশি না হলেও বাংলায় যুক্ত হওয়া শব্দের সংখ্যা কিছু কম নয় ৷ যেমন প্ল্যানচেট, কুপন, ম্যাটিনি (ম্যাটিনি শো) ও রেস্তোরাঁ এগুলি বাংলা শব্দে বহুল ব্যবহৃত ৷
আবার মুসলিম সাম্রাজ্য চলাকালীন তুর্কি, আরবি ও ফারসি শব্দ ঢুকেছে বাংলায় । কারণ সেই সময়ে রাজ ভাষা ছিল ফারসি ও আরবি । আদালতের প্রায় 90 শতাংশ শব্দ আরবি ও ফারসি থেকে আসা । আদালতে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদেরকে বলা হত মুন্সি । এই শব্দটাও আরবি শব্দ । বাংলাদেশে বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে অভিধান প্রকাশ হয়েছে । সেখানে আরবি, তুর্কি ও ফারসি শব্দ থেকে যে ভাষাগুলি বাংলায় পরিবর্তিত হয়ে ঢুকেছে তার উল্লেখ রয়েছে । সেই অভিধানে হিসেব করে বোঝা যায়, এই ভাষাগুলি থেকে প্রায় 3400 শব্দ এসেছে বাংলায় ।
এটি ছাড়াও পর্তুগিজ শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় ঢুকেছে এমনও একটি বই রয়েছে । বিখ্যাত সেই বইয়ের নাম 'পর্তুগিজ বেঙ্গল'। পর্তুগিজ থেকে ইংরেজিতে ও তার থেকে বাংলায়, এবং সরাসরি বাংলায় কী কী শব্দ ঢুকেছে, তার উল্লেখ আছে সেখানে । সেখানে দেখা যায়, পর্তুগিজ থেকে ইংরেজি হয়ে প্রায় 175টি শব্দ ঢুকেছে বাংলা শব্দমালায় । আর সরাসরি বাংলায় ঢুকেছে 185টি শব্দ ।
সাহিত্যিক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, বাংলা চিরকাল অতিথি বৎসল জাতি । দোলের সময় 'মঠ' আমরা শুকনো মিষ্টি খাবারের জন্য ব্যবহার করি । এটি একটি পর্তুগিজ শব্দ । সেই মিষ্টি এখনও গির্জার আকারে তৈরি হয় । কোনও ভাষা যদি জীবন্ত হয়, বিভিন্ন ভাষা সেই ভাষাকে গ্রহণ করবে । ভাষার বিবর্তন চিরকাল স্থান ও কালের উপর নির্ভর করে । যেমন বাংলা চন্দননগর থেকে বর্ধমান হোক বা উত্তরবঙ্গ, লেখার ক্ষেত্রে সব জায়গায় তা এক থাকলেও উচ্চারণে অনেক পরিবর্তন হয় । এমনকি বাংলাদেশেও বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকমের উচ্চারণ করে থাকেন বাসিন্দারা ।
আরও পড়ুন: