ETV Bharat / state

আসানসোলে বসে মার্কিন-কানাডিয়ানদের প্রতারণা, চিন্তিত প্রবাসী বাঙালিরা - CYBER FRAUD WITH FOREIGNERS

কল সেন্টার খুলে বিদেশি নাগরিকদের প্রতারণা ! আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের সাইবার সেলের অভিযানে গ্রেফতার 6 প্রতারক ৷

Cyber Fraud With Foreigners
মার্কিন-কানাডিয়ান নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনায় চিন্তিত প্রবাসী বাঙালিরা ৷ (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 13, 2025, 7:51 PM IST

আসানসোল, 13 ফেব্রুয়ারি: কেতাদূরস্ত ইংরেজিতে চলছে ফোনালাপ, তা-ও আবার বিদেশিদের মতো উচ্চারণে ! ফোনের এপার থেকে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে বিদেশি নামে ৷ কেউ জন, কেউ মার্ক, তো কেউ জেমস, আরও কত কী...৷ না, এঁরা কেউ বিদেশি নন ৷ সকলেই ভারতীয়, আসানসোলের বাসিন্দা ৷ ফোনের ওপারে যাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁরা সকলেই মার্কিন অথবা কানাডিয়ান নাগরিক ৷ কল সেন্টার খুলে বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা করাই এঁদের কাজ বলে অভিযোগ ৷

সম্প্রতি এমনই একটি চক্রের 6 জনকে গ্রেফতার করেছে আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের সাইবার সেলের গোয়েন্দারা ৷ আসানসোলের হটন রোডে কল সেন্টার খুলে চলছিল প্রতারণাচক্র ৷ আর প্রতারণার শিকার হচ্ছিলেন মার্কিন ও কানাডার নাগরিকরা ৷ এই ঘটনার কথা শুনে রীতিমতো চিন্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা ৷

আসানসোলে বসে মার্কিন-কানাডিয়ানদের প্রতারণা (নিজস্ব ভিডিয়ো)

কীভাবে ঘটছিল এই ঘটনা, পুলিশের জালে কীভাবে ধরা পড়লেন অভিযুক্তরা, কারা রয়েছে এর মাথায়, কী বা বলছেন প্রবাসী বাঙালিরা ৷ সেসবের হালহকিকত জানলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷

হঠাৎ পুলিশি অভিযান

11 ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, রাত তখন 12টা ৷ শুনশান আসানসোল হটন রোড ৷ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ হানা দেয় হটন রোডে অবস্থিত একটি কল সেন্টারে ৷ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময় ওই কল সেন্টারে 6 জন ছিলেন ৷ প্রত্যেকেই কানে হেডফোন দিয়ে, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের সামনে বসে কেতাদূরস্ত বিদেশিদের মতো উচ্চারণে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করে চলেছেন ৷ পুলিশ কর্তাদের দেখে প্রাথমিকভাবে তাঁরা চমকে গেলেও, পরক্ষণেই ফের ভাবলেশহীন হয়ে কাজ করতে থাকেন ৷ কিছুক্ষণ তাঁদের কথাবার্তা শোনেন সাইবার সেলের আধিকারিকরা ৷ তারপর আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ তাঁদের চেপে ধরে ৷ তখনই একে-একে বেরিয়ে আসতে শুরু করে কল সেন্টারের আসল সত্য ৷

কারা হলেন গ্রেফতার ও কী কী উদ্ধার ?

হটন রোডের ওই কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার রাতে 6 জনকে গ্রেফতার করেছে আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ ৷ সেখান থেকে 8টি এসএসডি ও 4টি হার্ড ডিস্ক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৷ এছাড়াও বেশ কয়েকটি সিপিইউ, হেডফোন, ডায়েরি ও অন্যান্য নথি বাজেয়াপ্ত করেছে আসানসোলের সাইবার আধিকারিকরা ৷

Cyber Fraud With Foreigners
আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের সাইবার সেলের অভিযানে গ্রেফতার 6 প্রতারক ৷ (ইটিভি ভারত)

এ নিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশের এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি বলেন, "ধৃতদের নাম আতাহার আলি আজম, রাজীব গুপ্ত, মহম্মদ মুক্তার, সৈয়দ রিজউই, মহম্মদ রিজওয়ান ও মহম্মদ নেহাল আনসারি ৷ আতাহার আলি আজম আসানসোল দক্ষিণ থানার বুধার বাসিন্দা, রাজীব গুপ্তার বাড়ি হীরাপুর থানার অন্তর্গত বিসি কলেজ হনুমান মন্দির এলাকায়, মহম্মদ মুক্তার ও সৈয়দ রিজউই আসানসোল উত্তর থানার কুরেশি মহল্লার বাসিন্দা, মহম্মদ রিজওয়ান আসানসোল উত্তর থানার পুরনো স্টেশন এলাকায় থাকেন ও ধৃত নেহাল আনসারির বাড়ি আসানসোল উত্তর থানার ওকে রোডে ৷"

কীভাবে করা হত প্রতারণা ?

আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি জানান, "মূলত আমেরিকান ও কানাডার নাগরিকদের টার্গেট করা হত ৷ তারপর তাঁদের আসানসোল থেকে ফোন করে বলা হত, তাঁদের সিস্টেমে টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে ৷ সিস্টেম ক্রাশ করে যেতে পারে ৷ এই বলে বিভিন্ন সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে তাঁদের কম্পিউটারগুলিকে রিমোট-সিস্টেমে হ্যাক করা হত ৷ এরপর অ্যান্টিভাইরাস ইনস্টল করার নামে মোটা অংকের টাকা চাওয়া হত বিদেশি ওই নাগরিকদের থেকে ৷ এভাবেই প্রতারিত হচ্ছিলেন আমেরিকার নাগরিকরা ৷"

আসানসোলে বসে আমেরিকায় ফোন করে প্রতারণা ! এ-ও সম্ভব ?

এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলির কথায়, "আমরা ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি যে, সোর প্লেক্স নামে আমেরিকায় একটি কোম্পানি আছে ৷ যে কোম্পানি এদের মূল চক্রী বলে এরা স্বীকার করেছে ৷ ধৃতেরা ওই কোম্পানির সাব-এজেন্ট হয়ে কাজ করত ৷"

কীভাবে চলত কাজ ?

আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ আধিকারিক জানান, আমেরিকার ওই সোর প্লেক্স কোম্পানি বাল্ক ইমেল পাঠাত আমেরিকান ও কানাডার নাগরিকদের ৷ তাদের ইমেল পাঠিয়ে ভয় দেখানো হত যে, সিস্টেম ক্রাশ করে যাবে ভাইরাসের জন্য ৷ অ্যান্টিভাইরাস নেওয়ার জন্য ফোন নম্বর দেওয়া হত এরপর ৷ যাঁরাই ওই ফাঁদে পড়ে ফোন করতেন, তাঁরাই ক্রমশ প্রতারণার চক্রব্যুহে ঢুকে পড়তেন ৷ ওই ফোনগুলি আসানসোলের ওই কল সেন্টার থেকে করা হত ৷ বিভিন্নভাবে টোপ দিয়ে আমেরিকান নাগরিকদের সিস্টেম বা কম্পিউটারগুলিকে টেকনিক্যাল পদ্ধতিতে হ্যাক করে নেওয়া হত ৷ তারপর চলত ব্ল্যাক মেল করে টাকা আদায় ৷"

টেলি-কলাররা অভিনয়ে পারদর্শী !

যাতে বিদেশি নাগরিকদের কোনও সন্দেহ না-হয়, সেই কারণে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে ফোন করত প্রতারক টেলি-কলাররা ৷ কেতাদূরস্ত বিদেশি কায়দায় ইংরেজি উচ্চারণ শুনে বোঝার উপায় থাকত না, ফোনগুলি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আসানসোলের হটন রোডের একটি আবাসন থেকে করা হচ্ছে ৷

এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি বলেন, "নাম বদলে প্রতারকরা নিজেদের বিদেশি হিসাবে পরিচয় দিত ৷ ধৃত আতাহার আলি আজম হয়ে উঠেছিল রজার অথবা জন ইভানস, রাজীব গুপ্তা নিজেকে মার্ক উইলিয়াম বলে পরিচয় দিতেন ৷ মহম্মদ মুক্তার হয়েছিল জেমস, সৈয়দ রিজউই ট্রেভর স্মিথ, মহম্মদ রিজওয়ান অ্যালেন ওয়েবার ও মহম্মদ নেহাল আনসারি স্টিভ মার্টিনের নামে ফোন করত মার্কিন ও কানাডিয়ান নাগরিকদের ৷

কীভাবে এগোয় তদন্ত প্রক্রিয়া ?

আসানসোলের সাইবার থানার পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছিল বিষয়টির কথা ৷ পুলিশ প্রায় নিজেদের তাগিদেই এই প্রতারণা চক্রটিকে ধরতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল ৷ বিভিন্ন রকম টেকনিক্যাল সাহায্য নিয়ে পুলিশ ওই কল সেন্টারটির লোকেশন ট্র্যাক করে ৷ এরপর মঙ্গলবার গভীর রাতে সেখানে হানা দেয় ৷ হাতেনাতে ধরে ফেলা হয় 6 জনকে ৷ ওই 6 জন তখন বিভিন্ন বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বার্তালাপ করছিল বলে অভিযোগ ৷ এরপর লাগাতার জেরাতে তারা প্রতারণা চক্রের কথা স্বীকার করেছে ৷ তবে, পুলিশের অনুমান এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত আছে ৷ ধৃতদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করে পুরো চক্রটির হদিশ পেতে চাইছে পুলিশ ৷ পাশাপাশি, বিদেশেও যোগাযোগ করে ওই আন্তর্জাতিক চক্রীকে চিহ্নিত করতে চাইছে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ৷

তবে, এই পুরো বিষয়টি জানার পর রীতিমতো চিন্তিত মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা ৷ বিশেষত, সফ্টওয়্যার বিশেষজ্ঞরা ৷ ভিডিয়ো ও অডিয়ো কলে তাঁরা ইটিভি ভারতকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৷

কী ভাবছেন প্রবাসে থাকা বাঙালি সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা ?

আসানসোলে বসে আমেরিকান ও কানাডিয়ান নাগরিকদের সিস্টেম হ্যাক করে প্রতারণা করা হচ্ছে, এমন কথা শুনেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালিরা ৷ শুধু তাই নয় এই ঘটনার থেকে তাঁরা বড় বিপদের আশঙ্কাও করছেন ৷ আমেরিকায় থাকা বাঙালি সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা তাই চাইছেন, খুব দ্রুততার সঙ্গে এই বিষয়টিকে নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাবধান করতে ৷

আসানসোলের বাসিন্দা বর্তমানে মার্কিন নাগরিক ও টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে বলেন, "আমি আসানসোলের মেয়ে ৷ এখন নিউ জার্সিতে থাকি ৷ আমি একজন টেকনোলজি প্রফেশনাল ৷ আমি ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির কাছে শুনলাম, আসানসোলে বসে নাকি আমেরিকার এবং কানাডিয়ানদের ফোন করে স্ক্যাম করা হচ্ছে ৷ ইমেল পাঠিয়ে তাঁদের সিস্টেম ক্রাশের ভয় দেখানো হচ্ছে ৷ তারপর অ্যান্টিভাইরাস ইনস্টল করার নামে সিস্টেমেটিক বিভিন্ন সফটওয়্যার ইনস্টল করে তাঁদের কম্পিউটার হ্যাক করে নেওয়া হচ্ছে ৷ এটা একটা মারাত্মক বিষয় ৷ মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করতে হবে ৷ আমি এই ঘটনা জানার পর প্রবাসী বাঙালিদের তো বটেই, আমার এদেশের যাঁরা বন্ধুবান্ধব রয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককে সচেতন এবং সাবধান করব ৷"

আমেরিকার ওহায়োতে সফ্টওয়্যার প্রফেশনাল হিসেবে কর্মরত আসানসোলের তুহিন দত্ত জানান, "আমি ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির মাধ্যমে খবর পেলাম আসানসোল থেকে একটি কল সেন্টার খুলে আমেরিকান এবং কানাডিয়ান নাগরিকদের অ্যান্টিভাইরাস বিক্রির নামে একটি চক্র চালানো হচ্ছে ৷ শুধু তাই নয়, এরপর তারা সিস্টেমের কন্ট্রোল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছে ৷ এটা খুবই চিন্তার বিষয় ৷ একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আমি চাই মানুষজনকে অবগত করাতে যে, এরকম একটি চক্র চলছে ৷"

মার্কিন মুলুকের ওহায়োতে থাকা আরও এক সফ্টওয়্যার প্রফেশনাল শিল্পী দত্ত বলেন, "আমি আসানসোলের মেয়ে ৷ আসানসোল থেকে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে শুনে খুব আশ্চর্য হলাম এবং ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির মাধ্যমেই আমরা এটা জানতে পারলাম ৷ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এবং একজন প্রবাসী বাঙালি হিসাবে আমি মনে করি এটা আমার দায়িত্ব বাকিদের বিষয়টি জানানো এবং সচেতন করা ৷ যাতে, অন্য কেউ এই প্রতারণার শিকার না-হয় ৷"

আসানসোল, 13 ফেব্রুয়ারি: কেতাদূরস্ত ইংরেজিতে চলছে ফোনালাপ, তা-ও আবার বিদেশিদের মতো উচ্চারণে ! ফোনের এপার থেকে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে বিদেশি নামে ৷ কেউ জন, কেউ মার্ক, তো কেউ জেমস, আরও কত কী...৷ না, এঁরা কেউ বিদেশি নন ৷ সকলেই ভারতীয়, আসানসোলের বাসিন্দা ৷ ফোনের ওপারে যাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁরা সকলেই মার্কিন অথবা কানাডিয়ান নাগরিক ৷ কল সেন্টার খুলে বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা করাই এঁদের কাজ বলে অভিযোগ ৷

সম্প্রতি এমনই একটি চক্রের 6 জনকে গ্রেফতার করেছে আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের সাইবার সেলের গোয়েন্দারা ৷ আসানসোলের হটন রোডে কল সেন্টার খুলে চলছিল প্রতারণাচক্র ৷ আর প্রতারণার শিকার হচ্ছিলেন মার্কিন ও কানাডার নাগরিকরা ৷ এই ঘটনার কথা শুনে রীতিমতো চিন্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা ৷

আসানসোলে বসে মার্কিন-কানাডিয়ানদের প্রতারণা (নিজস্ব ভিডিয়ো)

কীভাবে ঘটছিল এই ঘটনা, পুলিশের জালে কীভাবে ধরা পড়লেন অভিযুক্তরা, কারা রয়েছে এর মাথায়, কী বা বলছেন প্রবাসী বাঙালিরা ৷ সেসবের হালহকিকত জানলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷

হঠাৎ পুলিশি অভিযান

11 ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, রাত তখন 12টা ৷ শুনশান আসানসোল হটন রোড ৷ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ হানা দেয় হটন রোডে অবস্থিত একটি কল সেন্টারে ৷ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময় ওই কল সেন্টারে 6 জন ছিলেন ৷ প্রত্যেকেই কানে হেডফোন দিয়ে, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের সামনে বসে কেতাদূরস্ত বিদেশিদের মতো উচ্চারণে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করে চলেছেন ৷ পুলিশ কর্তাদের দেখে প্রাথমিকভাবে তাঁরা চমকে গেলেও, পরক্ষণেই ফের ভাবলেশহীন হয়ে কাজ করতে থাকেন ৷ কিছুক্ষণ তাঁদের কথাবার্তা শোনেন সাইবার সেলের আধিকারিকরা ৷ তারপর আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ তাঁদের চেপে ধরে ৷ তখনই একে-একে বেরিয়ে আসতে শুরু করে কল সেন্টারের আসল সত্য ৷

কারা হলেন গ্রেফতার ও কী কী উদ্ধার ?

হটন রোডের ওই কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার রাতে 6 জনকে গ্রেফতার করেছে আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ ৷ সেখান থেকে 8টি এসএসডি ও 4টি হার্ড ডিস্ক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৷ এছাড়াও বেশ কয়েকটি সিপিইউ, হেডফোন, ডায়েরি ও অন্যান্য নথি বাজেয়াপ্ত করেছে আসানসোলের সাইবার আধিকারিকরা ৷

Cyber Fraud With Foreigners
আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের সাইবার সেলের অভিযানে গ্রেফতার 6 প্রতারক ৷ (ইটিভি ভারত)

এ নিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশের এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি বলেন, "ধৃতদের নাম আতাহার আলি আজম, রাজীব গুপ্ত, মহম্মদ মুক্তার, সৈয়দ রিজউই, মহম্মদ রিজওয়ান ও মহম্মদ নেহাল আনসারি ৷ আতাহার আলি আজম আসানসোল দক্ষিণ থানার বুধার বাসিন্দা, রাজীব গুপ্তার বাড়ি হীরাপুর থানার অন্তর্গত বিসি কলেজ হনুমান মন্দির এলাকায়, মহম্মদ মুক্তার ও সৈয়দ রিজউই আসানসোল উত্তর থানার কুরেশি মহল্লার বাসিন্দা, মহম্মদ রিজওয়ান আসানসোল উত্তর থানার পুরনো স্টেশন এলাকায় থাকেন ও ধৃত নেহাল আনসারির বাড়ি আসানসোল উত্তর থানার ওকে রোডে ৷"

কীভাবে করা হত প্রতারণা ?

আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি জানান, "মূলত আমেরিকান ও কানাডার নাগরিকদের টার্গেট করা হত ৷ তারপর তাঁদের আসানসোল থেকে ফোন করে বলা হত, তাঁদের সিস্টেমে টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে ৷ সিস্টেম ক্রাশ করে যেতে পারে ৷ এই বলে বিভিন্ন সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে তাঁদের কম্পিউটারগুলিকে রিমোট-সিস্টেমে হ্যাক করা হত ৷ এরপর অ্যান্টিভাইরাস ইনস্টল করার নামে মোটা অংকের টাকা চাওয়া হত বিদেশি ওই নাগরিকদের থেকে ৷ এভাবেই প্রতারিত হচ্ছিলেন আমেরিকার নাগরিকরা ৷"

আসানসোলে বসে আমেরিকায় ফোন করে প্রতারণা ! এ-ও সম্ভব ?

এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলির কথায়, "আমরা ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি যে, সোর প্লেক্স নামে আমেরিকায় একটি কোম্পানি আছে ৷ যে কোম্পানি এদের মূল চক্রী বলে এরা স্বীকার করেছে ৷ ধৃতেরা ওই কোম্পানির সাব-এজেন্ট হয়ে কাজ করত ৷"

কীভাবে চলত কাজ ?

আসানসোল সাইবার থানার পুলিশ আধিকারিক জানান, আমেরিকার ওই সোর প্লেক্স কোম্পানি বাল্ক ইমেল পাঠাত আমেরিকান ও কানাডার নাগরিকদের ৷ তাদের ইমেল পাঠিয়ে ভয় দেখানো হত যে, সিস্টেম ক্রাশ করে যাবে ভাইরাসের জন্য ৷ অ্যান্টিভাইরাস নেওয়ার জন্য ফোন নম্বর দেওয়া হত এরপর ৷ যাঁরাই ওই ফাঁদে পড়ে ফোন করতেন, তাঁরাই ক্রমশ প্রতারণার চক্রব্যুহে ঢুকে পড়তেন ৷ ওই ফোনগুলি আসানসোলের ওই কল সেন্টার থেকে করা হত ৷ বিভিন্নভাবে টোপ দিয়ে আমেরিকান নাগরিকদের সিস্টেম বা কম্পিউটারগুলিকে টেকনিক্যাল পদ্ধতিতে হ্যাক করে নেওয়া হত ৷ তারপর চলত ব্ল্যাক মেল করে টাকা আদায় ৷"

টেলি-কলাররা অভিনয়ে পারদর্শী !

যাতে বিদেশি নাগরিকদের কোনও সন্দেহ না-হয়, সেই কারণে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে ফোন করত প্রতারক টেলি-কলাররা ৷ কেতাদূরস্ত বিদেশি কায়দায় ইংরেজি উচ্চারণ শুনে বোঝার উপায় থাকত না, ফোনগুলি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আসানসোলের হটন রোডের একটি আবাসন থেকে করা হচ্ছে ৷

এডিসি (সাইবার) মীর সইদুল আলি বলেন, "নাম বদলে প্রতারকরা নিজেদের বিদেশি হিসাবে পরিচয় দিত ৷ ধৃত আতাহার আলি আজম হয়ে উঠেছিল রজার অথবা জন ইভানস, রাজীব গুপ্তা নিজেকে মার্ক উইলিয়াম বলে পরিচয় দিতেন ৷ মহম্মদ মুক্তার হয়েছিল জেমস, সৈয়দ রিজউই ট্রেভর স্মিথ, মহম্মদ রিজওয়ান অ্যালেন ওয়েবার ও মহম্মদ নেহাল আনসারি স্টিভ মার্টিনের নামে ফোন করত মার্কিন ও কানাডিয়ান নাগরিকদের ৷

কীভাবে এগোয় তদন্ত প্রক্রিয়া ?

আসানসোলের সাইবার থানার পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছিল বিষয়টির কথা ৷ পুলিশ প্রায় নিজেদের তাগিদেই এই প্রতারণা চক্রটিকে ধরতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল ৷ বিভিন্ন রকম টেকনিক্যাল সাহায্য নিয়ে পুলিশ ওই কল সেন্টারটির লোকেশন ট্র্যাক করে ৷ এরপর মঙ্গলবার গভীর রাতে সেখানে হানা দেয় ৷ হাতেনাতে ধরে ফেলা হয় 6 জনকে ৷ ওই 6 জন তখন বিভিন্ন বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বার্তালাপ করছিল বলে অভিযোগ ৷ এরপর লাগাতার জেরাতে তারা প্রতারণা চক্রের কথা স্বীকার করেছে ৷ তবে, পুলিশের অনুমান এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত আছে ৷ ধৃতদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করে পুরো চক্রটির হদিশ পেতে চাইছে পুলিশ ৷ পাশাপাশি, বিদেশেও যোগাযোগ করে ওই আন্তর্জাতিক চক্রীকে চিহ্নিত করতে চাইছে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ৷

তবে, এই পুরো বিষয়টি জানার পর রীতিমতো চিন্তিত মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা ৷ বিশেষত, সফ্টওয়্যার বিশেষজ্ঞরা ৷ ভিডিয়ো ও অডিয়ো কলে তাঁরা ইটিভি ভারতকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৷

কী ভাবছেন প্রবাসে থাকা বাঙালি সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা ?

আসানসোলে বসে আমেরিকান ও কানাডিয়ান নাগরিকদের সিস্টেম হ্যাক করে প্রতারণা করা হচ্ছে, এমন কথা শুনেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালিরা ৷ শুধু তাই নয় এই ঘটনার থেকে তাঁরা বড় বিপদের আশঙ্কাও করছেন ৷ আমেরিকায় থাকা বাঙালি সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞরা তাই চাইছেন, খুব দ্রুততার সঙ্গে এই বিষয়টিকে নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাবধান করতে ৷

আসানসোলের বাসিন্দা বর্তমানে মার্কিন নাগরিক ও টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায় ইটিভি ভারতকে বলেন, "আমি আসানসোলের মেয়ে ৷ এখন নিউ জার্সিতে থাকি ৷ আমি একজন টেকনোলজি প্রফেশনাল ৷ আমি ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির কাছে শুনলাম, আসানসোলে বসে নাকি আমেরিকার এবং কানাডিয়ানদের ফোন করে স্ক্যাম করা হচ্ছে ৷ ইমেল পাঠিয়ে তাঁদের সিস্টেম ক্রাশের ভয় দেখানো হচ্ছে ৷ তারপর অ্যান্টিভাইরাস ইনস্টল করার নামে সিস্টেমেটিক বিভিন্ন সফটওয়্যার ইনস্টল করে তাঁদের কম্পিউটার হ্যাক করে নেওয়া হচ্ছে ৷ এটা একটা মারাত্মক বিষয় ৷ মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করতে হবে ৷ আমি এই ঘটনা জানার পর প্রবাসী বাঙালিদের তো বটেই, আমার এদেশের যাঁরা বন্ধুবান্ধব রয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককে সচেতন এবং সাবধান করব ৷"

আমেরিকার ওহায়োতে সফ্টওয়্যার প্রফেশনাল হিসেবে কর্মরত আসানসোলের তুহিন দত্ত জানান, "আমি ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির মাধ্যমে খবর পেলাম আসানসোল থেকে একটি কল সেন্টার খুলে আমেরিকান এবং কানাডিয়ান নাগরিকদের অ্যান্টিভাইরাস বিক্রির নামে একটি চক্র চালানো হচ্ছে ৷ শুধু তাই নয়, এরপর তারা সিস্টেমের কন্ট্রোল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছে ৷ এটা খুবই চিন্তার বিষয় ৷ একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আমি চাই মানুষজনকে অবগত করাতে যে, এরকম একটি চক্র চলছে ৷"

মার্কিন মুলুকের ওহায়োতে থাকা আরও এক সফ্টওয়্যার প্রফেশনাল শিল্পী দত্ত বলেন, "আমি আসানসোলের মেয়ে ৷ আসানসোল থেকে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে শুনে খুব আশ্চর্য হলাম এবং ইটিভি ভারতের প্রতিনিধির মাধ্যমেই আমরা এটা জানতে পারলাম ৷ একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এবং একজন প্রবাসী বাঙালি হিসাবে আমি মনে করি এটা আমার দায়িত্ব বাকিদের বিষয়টি জানানো এবং সচেতন করা ৷ যাতে, অন্য কেউ এই প্রতারণার শিকার না-হয় ৷"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.