শিশু পর্নোগ্রাফি রোধে আইনকে আরও বিস্তৃত করেছে সুপ্রিম কোর্ট ৷ আদালত সম্প্রতি জানিয়েছে, এই ধরনের ভিডিয়ো শেয়ার করা হোক বা না-হোক, তা দেখা, রেখে দেওয়া এবং রিপোর্ট না-করাও অপরাধ ৷ তা পকসো আইনে শাস্তিযোগ্য ৷ ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালার একটি ডিভিশন বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত জানায় প্রথমে ৷ পরে এই নিয়ে রায় দেয় ৷
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাদ্রাজ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যে শিশু পর্নোগ্রাফি রেখে দেওয়া পকসো আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় ৷ সুুপ্রিম কোর্ট সেই রায় খারিজ করে দিয়েছে ৷ পাশাপাশি এই ধরনের ভিডিয়ো রাখা নিয়ে কঠোর ব্যাখ্যা দিয়েছে ৷
জাস্ট রাইটস ফর চিলড্রেন অ্যালায়েন্স নামক এনজিও মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিল ৷ শেষ পর্যন্ত মামলাটি হয় জাস্ট রাইটস ফর চিলড্রেন অ্যালায়েন্স বনাম এস হরিশ । এই মামলার রায় শিশু পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত জিনিস থেকে এর ব্যবহার রোধ করতে যুগান্তকারী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ৷
কোনটা শাস্তিযোগ্য
এই সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে পকসো আইনের দু’টি বিধান, তা হল - ধারা 14 ও 15 ৷ ধারা 14 হল - পর্নোগ্রাফিক উদ্দেশ্যে কোনও শিশু বা শিশুদের ব্যবহার করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা করা হয় ৷ দ্বিতীয়বার বা পরে দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে । পকসো আইনের ধারা 15-কে তিনটি উপ-ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে ৷ ধারা 15(1) অনুযায়ী, একটি শিশুর সঙ্গে জড়িত পর্নোগ্রাফিক সামগ্রী সংরক্ষণ বা দখলের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৷ সেখানে যেকোনও ব্যক্তি এটিকে মুছে ফেলতে, ধ্বংস করতে বা একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট না-করলে সেটাকে পর্নোগ্রাফি শেয়ার বা ট্রান্সমিট করার অভিপ্রায় হিসেবে ধরা হয় ৷ এর শাস্তি হল 5 হাজার বা তার বেশি জরিমানা ৷ দ্বিতীয়বার এই ধরনের ঘটনা ঘটালে জরিমানার পরিমাণ হয় 10 হাজার টাকা ৷
ধারা 15(2) এর অধীনে রয়েছে, রিপোর্ট করার উদ্দেশ্যে বা আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য ছাড়া কোনও শিশু জড়িত পর্নোগ্রাফিক জিনিস পাঠানো, প্রচার, বিতরণ বা প্রদর্শন করায় কারাদণ্ড বা জরিমানা হয় ৷ কিংবা উভয় শাস্তিও হতে পারে৷ ধারা 15(3) হল - বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিশু পর্নোগ্রাফিক জিনিসের সঞ্চয় বা দখলকে নিষিদ্ধ করা এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা ৷
আগে, বিভিন্ন হাইকোর্ট বলেছিল যে এই ধরনের জিনিস শেয়ার করা বা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার অভিপ্রায় থাকলে ধারা 15-র অধীনে অপরাধ যোগ্য হিসেবে হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল । প্রকৃতপক্ষে, মাদ্রাজ হাইকোর্টের যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল, সেখানে একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বাতিল করে দেওয়া হয় ৷ কারণ হিসেবে বলা হয় পকসো বা 2000 সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনে এই বিষয়টি শাস্তিযোগ্য নয় ৷
সুপ্রিম কোর্ট এখন স্পষ্ট করেছে যে ধারা 15-এর প্রতিটি উপ-ধারা প্রতিটি অপরাধের আলাদা করে বিধান দিতে পারে । বিচারপতি পারদিওয়ালা ব্যাখ্যা করেছেন যে ধারা 15 তিনটি 'স্বতন্ত্র' অপরাধের জন্য বিধান দেয় ৷ সেখানে তিনটি পৃথক উদ্দেশ্যের সঙ্গে 'শিশু পর্নোগ্রাফিক সামগ্রী' সংরক্ষণ বা দখল করা হলে শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ৷ শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ বা দখল ধারা 15-এর অধীনে একটি অপরাধ ৷ তাই এই ধরনের জিনিস রেখে দেওয়া বা তা মুছে না ফেলা ধারা 15-এর প্রতিটি উপ-ধারায় পৃথক অপরাধ নির্ধারণে একে অপরের থেকে স্বাধীন ।
ধারা 15(1) এর অধীনে স্পষ্ট করা আছে যে পর্নোগ্রাফিক সামগ্রী সংগ্রহ করা, কিন্তু তা নিয়ে অভিযোগ না-জানালে সেখানে মানসিক অভিপ্রায় থাকে ৷ অভিযুক্তদের দ্বারা সেগুলি মুছে ফেলা, ধ্বংস করা বা রিপোর্ট করা না-হওয়া পর্যন্ত এসব জিনিস রাখাই 15(1) ধারার অধীনে একটি অপরাধ ৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে, কীভাবে তা রাখা হয়েছিল, তার তথ্য এবং পরিস্থিতি উন্মোচিত করতে হবে ।
সুপ্রিম কোর্ট আইটি আইনের 67বি ধারার বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিয়েছে, যা ইলেকট্রনিক আকারে শিশুদের যৌনতামূলক কাজের চিত্রিত বিষয়বস্তু প্রকাশ বা প্রেরণের শাস্তি দেয় । আদালত রায় দিয়েছে যে ধারা 67বি শুধুমাত্র শিশু পর্নোগ্রাফিক সামগ্রীর ‘ইলেক্ট্রনিক প্রচার’ নয়, বরং ‘এই জাতীয় সামগ্রীর সৃষ্টি, দখল, প্রচার এবং ব্যবহারের’ জন্যও শাস্তি দেয় ৷
সোশাল মিডিয়ার বাধ্যবাধকতা ও প্রমাণের ভার
শিশু পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে পড়া আটকাতে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, সেটাকে দ্বিগুণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট । 2000 সালের তথ্য প্রযুক্তি আইন ও পকসো আইনের মতো বিভিন্ন আইনের অধীনে এই ধরনের বিষয়বস্তুর প্রকাশনা এবং প্রচলন সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা নির্দিষ্ট করা হয়েছে । প্রাসঙ্গিকভাবে, সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেছে যে তথ্য সুরক্ষিত রাখার যে নিয়ম রয়েছে, যার অধীনে কোনও সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর তথ্য গোপন রাখেন, তা শিশু পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ।
পকসো আইনের অধীনে অপরাধের প্রমাণের ভার সম্পর্কেও স্পষ্ট দিকনির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷ পকসো আইনের 30 ধারায় বলা হয়েছে যে আইনের অধীনে যেকোনও অপরাধের জন্য, বিশেষ আদালত অনুমান করবে যে অভিযুক্তের অপরাধমূলক মানসিক অবস্থা ছিল কি না । যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কিছু ‘মূল তথ্য’-এ তা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ ৷
উদাহরণ স্বরূপ, আদালত উল্লেখ করেছে যে ধারা 15(1)-এর অধীনে একটি অপরাধের জন্য, প্রসিকিউশনকে শুধুমাত্র মৌলিক তথ্য দেখাতে হবে যে অভিযুক্ত শিশু পর্নোগ্রাফি রেখেছিল, সেটাকে নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য কোনও সক্রিয় পদক্ষেপ করেনি ৷ তাহলে বিষয়টি আর 15(1) ধারার অধীনে থাকবে না ৷ তখন অভিযুক্তকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে ৷
নিয়মের পরিধি ও অর্থ
মজার বিষয় হল সুপ্রিম কোর্ট ‘শিশু পর্নোগ্রাফি’ শব্দটি ব্যবহার করার প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এটিকে ব্যবহার করা ভুল বলে অভিহিত করেছে ৷ সুপ্রিম কোর্টের মতে, এটা অপরাধের সম্পূর্ণ মাত্রাকে বোঝাতে অপর্যাপ্ত । আদালত স্পষ্টভাবে বলেছে যে শিশু পর্নোগ্রাফি শিশুকে প্রকৃত হেনস্তার সঙ্গে জড়িত । ‘শিশু পর্নোগ্রাফি’ শব্দটির ব্যবহার সম্ভাব্য অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে ৷ কারণ, পর্নোগ্রাফি প্রায়শই প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একটি সম্মতিমূলক কাজ হিসাবে দেখা হয় ।
এটা প্রতিরোধ করার জন্য, আদালত ‘শিশুর যৌন শোষণমূলক এবং হেনস্তার উপাদান’ বা ‘সিএসইএএম’ শব্দটি তৈরি করেছে ৷ যাতে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় যে পর্নোগ্রাফিক জিনিসগুলি সেই ঘটনার রেকর্ড হিসেবে ব্যবহার হয়, যেখানে একটি শিশু হয় যৌন শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে বা যেখানে কারও সামনেই শিশুদের উপর কোনও নির্যাতন করা হয়েছে ।
প্রকৃতপক্ষে, রায়ে কিছু পরামর্শ দেওয়ার সময় আদালত সংসদকে ‘শিশু পর্নোগ্রাফি’ শব্দটিকে ‘সিএসইএএম’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য পকসো আইন সংশোধনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার কথা বলেছে ৷ যাতে এই ধরনের অপরাধের বাস্তবতাকে আরও সঠিকভাবে প্রতিফলিত করা যায় । সুপ্রিম কোর্ট অন্যান্য আদালতকেও বলেছে যে ‘শিশু পর্নোগ্রাফি’ শব্দটি কোনও বিচারের আদেশ বা রায়ে ব্যবহার করা যাবে না এবং পরিবর্তে ‘সিএসইএএম’ ব্যবহার করা হবে ।
বিচ্ছেদের চিন্তা
আরেকটি ইতিবাচক দিক হল, সুপ্রিম কোর্ট শিশু পর্নোগ্রাফির আইনি ও নৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রককে ব্যাপক যৌন শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে । মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং, থেরাপিউটিক হস্তক্ষেপ এবং শিশু পর্নোগ্রাফির শিকারদের জন্য শিক্ষাগত সহায়তার ব্যবস্থাও উল্লেখ করা হয়েছে ।
সবচেয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে, এই রায় পকসো আইনের বিধানগুলির বিকল্প বা পরিবর্তিত ব্যাখ্যাগুলিকে অপ্রসাঙ্গিক করে দিয়েছে, যা রাজ্য হাইকোর্টগুলি কয়েক বছর ধরে তৈরি করেছিল । কিছু হাইকোর্ট এই ধরনের জিনিস রেখে দেওয়া ও শেয়ার করার মতো পৃথক অপরাধকে একটি একক অপরাধ হিসেবে ধরেছিল । এগুলিকে পৃথক হিসাবে ধরে সুপ্রিম কোর্ট পকসো আইনকে আরও শক্ত করেছে, যাতে শিশু পর্নোগ্রাফি কাছে রাখলেই শাস্তি দেওয়া যায় ৷
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো দ্বারা প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পকসো আইনের 14 এবং 15 ধারার অধীনে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা 2021-2022 সালে 1200-রও বেশি ছিল । প্রকৃতপক্ষে, 2022 সালে শিশুরা সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে, এমন মামলার সংখ্যা 1823, যা আগের বছরের তুলনায় 32 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । এই উদ্বেগজনক সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, এই রায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ যেতে পারে । রায়ে সব সঠিক কথা বলা হয়েছে – কেউ শুধু আশা করতে পারে যে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর যুক্তিযুক্ত পরিণতি হবে ।
(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)