ETV Bharat / opinion

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? - Political Crisis in Bangladesh

author img

By Anshuman Behera

Published : Aug 14, 2024, 9:00 PM IST

Political Crisis in Bangladesh: অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে ৷ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট ৷ এই সংকটের কারণ কী কী, সেই ব্যাখ্যাই দিয়েছেন বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্স স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. অংশুমান বেহরা ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট (এপি)

গত 15 বছর ধরে বাংলাদেশে যে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার আচমকা ইস্তফায় তা শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ ইতিহাস যেন নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করেছে ৷ প্রায় পাঁচ দশক আগে, 1975 সালের 15 অগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে হওয়া একটি অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ।

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

শেখ হাসিনার শাসনকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেই দেশগুলির তালিকায় যুক্ত হল, যে দেশগুলি হিংসাত্মক আন্দোলনের জেরে রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ৷ 1971 সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উত্তরসূরীদের জন্য সরকারি চাকরিতে 30 শতাংশের সংরক্ষণ নিয়েই প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৷ দেশব্যাপী সেই ছাত্র-বিক্ষোভের জেরে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে ৷

এছাড়াও বাইরের প্রভাব তো ছিলই ৷ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠনগুলির সমর্থনও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে । যদিও ছাত্র বিক্ষোভ একটি তাৎক্ষণিক অনুঘটক ছিল এবং বহিরাগত শক্তিগুলি আরও সূক্ষ্ম ভূমিকা পালন করেছিল ৷ তবে এর জেরে দু’টি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি হয়েছে৷ তা হল, গণতন্ত্রের পরিসর সীমিত হয়েছে এবং ইসলামি শক্তির পুনরুত্থান হয়েছে ৷ ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছবিটা বদলেছে ৷ এটার নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় চ্যালেঞ্জই বেশি ৷ সাফল্য এসেছে সীমিত ৷ দেশের মৌলিক মতাদর্শ - জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা - প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে । বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সীমিত সাফল্যকে দু’টি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় ৷ প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতিগুলি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে অনিচ্ছা দেখিয়েছে । 1975 সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও 2024 সালে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্যে কারণ প্রায় একই ৷ দুই ক্ষেত্রেই নির্বাচিত সরকারগুলির স্বৈরাচারী মনোভাব ৷ যা বিরোধীদের জন্য খুব কম জায়গা রেখেছিল ৷ এর ফলে একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলিতে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল এবং শেখ হাসিনার 15 বছরের শাসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল হল, বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়া, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এই শাসনগুলির মুখোমুখি হওয়া বৈধতা নিয়ে সংকট তৈরি করে ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

2009 সালের জানুয়ারি থেকে 2024 সালের অগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । কয়েক বছরের অনিশ্চয়তা ও সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট 2008 সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে এবং 2009 সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । 2008 সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত বিপুল জনসমর্থন বাংলাদেশি জনগণের আশা ও আকাঙ্খা প্রতিফলন ঘটিয়েছিল ।

সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে । এটা 2014, 2018 এবং 2024 সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন বিরোধীদের বয়কটের মাধ্যনে স্পষ্ট হয়েছিল । সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পিছনের দিকে যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিংসা ও জালিয়াতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । এছাড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদান সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি হ্রাস পেতে শুরু করে ৷ কারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ - যেমন প্রতিনিধিত্ব, অধিকার ও আইনের শাসন বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকারিতা কমে গিয়েছিল । শক্তিশালী, বৈধ ও গণতান্ত্রিক বিরোধী দল যেকোনও গণতন্ত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে ৷ সেই বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, যখন বিরোধী দল, ইসলামপন্থী, নাগরিক সমাজ দ্বারা সমর্থিত ছাত্রদের সংগঠিত হিংসাত্মক বিক্ষোভ হয় ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

বাংলাদেশে বারবার হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেই ইসলামী শক্তির ক্রমাগত পুনরুত্থানের জন্য দায়ী করা যেতে পারে । এর বিপরীতেও একটি তত্ত্ব আছে ৷ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করা ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’কে অসম্মান করেছিল ৷ এই দ্বি-জাতি তত্ত্বই ভারত বিভাজন ও ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ উত্থানে সহায়ক হয়েছিল ৷ বাংলাদেশে ইসলামবাদের পুনরুত্থান এই ধারণাগুলিকে আবারও নিশ্চিত করেছে ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল, যেমন - পিউরিটান, রহস্যবাদী, জঙ্গি সংস্কারপন্থী এবং অ্যাংলো-মোহামেডানদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও তারা দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের বিরোধিতায় সহমত পোষণ করে । ঔপনিবেশিক যুগে হিন্দু জমিদার, মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে শুরু হওয়া ইসলামী আন্দোলন এখন পাকিস্তানপন্থী এবং ভারত-বিরোধী মনোভাব, নারী স্বাধীনতা এবং পশ্চিমী আচরণবিধির বিরোধিতায় পরিণত হয়েছে । রাজনৈতিক ইসলামের আদর্শকে একসময় বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণ হিসেবে মনে করা হয়েছিল ৷ কিন্তু তা একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে । উল্লেখযোগ্যভাবে, রাজনৈতিক ইসলাম বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী (জেআই)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ।

শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে দমন, পরবর্তীতে জামায়াত-ই-ইসলামীর মতো ইসলামপন্থী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করা, এই শক্তিগুলিকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল । জেআই-এর অনেক নেতাকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ৷ তার পরও গভীর সামাজিক ভিত্তি এই সংগঠনকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ৷ প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) দ্বারা সমর্থিত ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান, বিশেষ করে জেআই-এর পুনরুত্থান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । গত 15 বছরে, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো আওয়ামী লীগকে বৈধতা ও অস্থিতিশীল করার জন্য বারবার প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে । 2009 সালের পিলখানা বিদ্রোহ, ব্লাসফেমি আইনের দাবিতে হেফাজত-ই-ইসলামের বিক্ষোভ, আইএসআইএস কর্তৃক 2016 সালের সন্ত্রাসী হামলার দাবি, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ছাত্রদের বিক্ষোভের মতো ঘটনাগুলিতে জেআই এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর জড়িত ছিল । 2024 সালের এই বিক্ষোভগুলি মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও এটা উপেক্ষা করা যাবে না যে তা সর্বদাই ইসলামপন্থী, গণতন্ত্রবিরোধী এবং ভারতবিরোধী ছিল । সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ইসলামপন্থী বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে, যখন শেখ হাসিনার শাসনের প্রচেষ্টা ইসলামী অনুভূতিকে তুষ্ট করার জন্য তর্কাতীতভাবে ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যায় ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সর্বোত্তম শাসনের উপযোগী সরকার গড়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সংগ্রাম করেছে । ইসলামের ধারণাগুলি প্রায়শই গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নীতিগুলির সঙ্গে সরাসরি বিরোধিতা তৈরি করেছে । যদিও রাজনৈতিক ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইসলামপন্থীদের লক্ষ্য অবাস্তব রয়ে গিয়েছে, তাদের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করেছে । দেশে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার দায় নির্বাচিত সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায় ।

ফলস্বরূপ, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট ইসলামপন্থী শক্তি দ্বারা গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক নীতির অবক্ষয় থেকে উদ্ভূত হয় ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের। এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না৷)

গত 15 বছর ধরে বাংলাদেশে যে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার আচমকা ইস্তফায় তা শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ ইতিহাস যেন নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করেছে ৷ প্রায় পাঁচ দশক আগে, 1975 সালের 15 অগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে হওয়া একটি অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ।

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

শেখ হাসিনার শাসনকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেই দেশগুলির তালিকায় যুক্ত হল, যে দেশগুলি হিংসাত্মক আন্দোলনের জেরে রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ৷ 1971 সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উত্তরসূরীদের জন্য সরকারি চাকরিতে 30 শতাংশের সংরক্ষণ নিয়েই প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৷ দেশব্যাপী সেই ছাত্র-বিক্ষোভের জেরে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে ৷

এছাড়াও বাইরের প্রভাব তো ছিলই ৷ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠনগুলির সমর্থনও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে । যদিও ছাত্র বিক্ষোভ একটি তাৎক্ষণিক অনুঘটক ছিল এবং বহিরাগত শক্তিগুলি আরও সূক্ষ্ম ভূমিকা পালন করেছিল ৷ তবে এর জেরে দু’টি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি হয়েছে৷ তা হল, গণতন্ত্রের পরিসর সীমিত হয়েছে এবং ইসলামি শক্তির পুনরুত্থান হয়েছে ৷ ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছবিটা বদলেছে ৷ এটার নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় চ্যালেঞ্জই বেশি ৷ সাফল্য এসেছে সীমিত ৷ দেশের মৌলিক মতাদর্শ - জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা - প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে । বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সীমিত সাফল্যকে দু’টি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় ৷ প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতিগুলি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে অনিচ্ছা দেখিয়েছে । 1975 সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও 2024 সালে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্যে কারণ প্রায় একই ৷ দুই ক্ষেত্রেই নির্বাচিত সরকারগুলির স্বৈরাচারী মনোভাব ৷ যা বিরোধীদের জন্য খুব কম জায়গা রেখেছিল ৷ এর ফলে একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলিতে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল এবং শেখ হাসিনার 15 বছরের শাসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল হল, বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়া, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এই শাসনগুলির মুখোমুখি হওয়া বৈধতা নিয়ে সংকট তৈরি করে ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

2009 সালের জানুয়ারি থেকে 2024 সালের অগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । কয়েক বছরের অনিশ্চয়তা ও সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট 2008 সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে এবং 2009 সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । 2008 সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত বিপুল জনসমর্থন বাংলাদেশি জনগণের আশা ও আকাঙ্খা প্রতিফলন ঘটিয়েছিল ।

সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে । এটা 2014, 2018 এবং 2024 সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন বিরোধীদের বয়কটের মাধ্যনে স্পষ্ট হয়েছিল । সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পিছনের দিকে যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিংসা ও জালিয়াতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । এছাড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদান সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি হ্রাস পেতে শুরু করে ৷ কারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ - যেমন প্রতিনিধিত্ব, অধিকার ও আইনের শাসন বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকারিতা কমে গিয়েছিল । শক্তিশালী, বৈধ ও গণতান্ত্রিক বিরোধী দল যেকোনও গণতন্ত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে ৷ সেই বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, যখন বিরোধী দল, ইসলামপন্থী, নাগরিক সমাজ দ্বারা সমর্থিত ছাত্রদের সংগঠিত হিংসাত্মক বিক্ষোভ হয় ৷

Political Crisis in Bangladesh
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ কী? (এপি)

বাংলাদেশে বারবার হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেই ইসলামী শক্তির ক্রমাগত পুনরুত্থানের জন্য দায়ী করা যেতে পারে । এর বিপরীতেও একটি তত্ত্ব আছে ৷ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করা ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’কে অসম্মান করেছিল ৷ এই দ্বি-জাতি তত্ত্বই ভারত বিভাজন ও ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ উত্থানে সহায়ক হয়েছিল ৷ বাংলাদেশে ইসলামবাদের পুনরুত্থান এই ধারণাগুলিকে আবারও নিশ্চিত করেছে ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল, যেমন - পিউরিটান, রহস্যবাদী, জঙ্গি সংস্কারপন্থী এবং অ্যাংলো-মোহামেডানদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও তারা দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের বিরোধিতায় সহমত পোষণ করে । ঔপনিবেশিক যুগে হিন্দু জমিদার, মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে শুরু হওয়া ইসলামী আন্দোলন এখন পাকিস্তানপন্থী এবং ভারত-বিরোধী মনোভাব, নারী স্বাধীনতা এবং পশ্চিমী আচরণবিধির বিরোধিতায় পরিণত হয়েছে । রাজনৈতিক ইসলামের আদর্শকে একসময় বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণ হিসেবে মনে করা হয়েছিল ৷ কিন্তু তা একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে । উল্লেখযোগ্যভাবে, রাজনৈতিক ইসলাম বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী (জেআই)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ।

শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে দমন, পরবর্তীতে জামায়াত-ই-ইসলামীর মতো ইসলামপন্থী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করা, এই শক্তিগুলিকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল । জেআই-এর অনেক নেতাকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ৷ তার পরও গভীর সামাজিক ভিত্তি এই সংগঠনকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ৷ প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) দ্বারা সমর্থিত ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান, বিশেষ করে জেআই-এর পুনরুত্থান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । গত 15 বছরে, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো আওয়ামী লীগকে বৈধতা ও অস্থিতিশীল করার জন্য বারবার প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে । 2009 সালের পিলখানা বিদ্রোহ, ব্লাসফেমি আইনের দাবিতে হেফাজত-ই-ইসলামের বিক্ষোভ, আইএসআইএস কর্তৃক 2016 সালের সন্ত্রাসী হামলার দাবি, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ছাত্রদের বিক্ষোভের মতো ঘটনাগুলিতে জেআই এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর জড়িত ছিল । 2024 সালের এই বিক্ষোভগুলি মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও এটা উপেক্ষা করা যাবে না যে তা সর্বদাই ইসলামপন্থী, গণতন্ত্রবিরোধী এবং ভারতবিরোধী ছিল । সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ইসলামপন্থী বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে, যখন শেখ হাসিনার শাসনের প্রচেষ্টা ইসলামী অনুভূতিকে তুষ্ট করার জন্য তর্কাতীতভাবে ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যায় ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সর্বোত্তম শাসনের উপযোগী সরকার গড়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সংগ্রাম করেছে । ইসলামের ধারণাগুলি প্রায়শই গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নীতিগুলির সঙ্গে সরাসরি বিরোধিতা তৈরি করেছে । যদিও রাজনৈতিক ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইসলামপন্থীদের লক্ষ্য অবাস্তব রয়ে গিয়েছে, তাদের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করেছে । দেশে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার দায় নির্বাচিত সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায় ।

ফলস্বরূপ, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট ইসলামপন্থী শক্তি দ্বারা গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান এবং ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক নীতির অবক্ষয় থেকে উদ্ভূত হয় ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি লেখকের। এখানে প্রকাশিত তথ্য এবং মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না৷)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.