ETV Bharat / opinion

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থান - Russia Ukraine War

Russia-Ukraine War: দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধে ভারত কারও পক্ষ নেয়নি ৷ তার পরও যুদ্ধের সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী থেকে অংশীদার হিসেবে গোটা বিশ্ব দেখছে ভারতের অবস্থানকে ৷ এই নিয়েই লিখেছেন অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো বিবেক মিশ্র ৷

Russia-Ukraine War
ইউক্রেনের এক সেনা স্টিংগার এয়ার ডিফেন্স মিসাইল লঞ্চার বহন করছেন (ছবি-এপি)
author img

By Vivek Mishra

Published : Jun 18, 2024, 1:07 PM IST

সুদূর এশিয়া থেকে আপাত শান্ত পরিস্থিতি বলে মনে হলেও ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে ৷ লাভ বেশি হবে না জানা সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনের সবচেয়ে বিশিষ্ট শহর খারকিভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত অগ্রগতি ধীরে ধীরে হলেও এটা ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়াকে নতুন করে সীমান্ত তৈরিতে সাহায্য করবে ৷ অন্যদিকে, ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমী বিশ্ব থেকে যে অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে, তা মার্কিন সহায়তায় একটি পূর্ণতা পেতে পারে ৷ তার কারণ, গত এপ্রিল মাসে মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে 60 বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে ৷ ফলে এই যুদ্ধের শেষ এখনই দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে সারা বিশ্ব এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন করে বদলে যাওয়া নিয়ে সতর্ক ৷

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত এগিয়েছে, বিশ্বের নজরে ভারতের অবস্থান বদলেছে ৷ সেটা সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেন, উভয়ের অংশীদারিত্ব-সহ একটি পক্ষ হিসাবে দেখা পর্যন্ত । যেহেতু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছে, এই প্রত্যাশাগুলি নতুন করে সামনে এসেছে ৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, 15-16 জুন সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনে ভারতের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ৷

Russia-Ukraine War
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থান (ইটিভি ভারত)

ভারত রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধের পটভূমিতে খুব বেশি অসুবিধা ছাড়াই নেভিগেট করছে বলে মনে হচ্ছে ৷ কিন্তু ভারতের জন্য লুকানো চ্যালেঞ্জ হল - এটি একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ, যা ভৌগোলিকভাবে ভারতের থেকে খুব দূরে, তা কি ভারতের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য়পূর্ণ ?

ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে 70 বছরেরও বেশি সময়ের সম্পর্ক । প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি থেকে শুরু করে কৌশলগত অংশীদারিত্ব, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর । প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরতা তাৎপর্যপূর্ণ ৷ কিন্তু এই কারণগুলি কি বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলির অবস্থান শক্ত করার জন্য যথেষ্ট ?

শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বা ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখলে এই সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না ৷ প্রথমত, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঠান্ডা যুদ্ধের যুগের থেকে যথেষ্ট ভালো হয়েছে । দ্বিতীয়ত, ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এর ফলে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রভাব পরিবর্তন হয়েছে ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত স্বাধীন অবস্থান এবং গতিশীল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । যুদ্ধের ফলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে, ভারতের শক্তি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করেছে । বেশিরভাগ দেশের মতো, ভারতকেও মানিয়ে নিতে হয়েছে এবং নতুন করে সবকিছু ভাবতে হয়েছে ৷

ভারতের অবস্থান এই যুগে যেকোনও ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে । এই অবস্থানকে কারও পক্ষপাতিত্ব না করে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করা বলেই বর্ণনা করা হয়েছে । রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের তার স্বার্থের উদ্দেশ্যমূলক মূল্যায়ন তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে করা যেতে পারে: এর কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, চলমান বিশ্ব ব্যবস্থায় মহান শক্তি পুনর্গঠন এবং শক্তি ও প্রতিরক্ষার চাহিদা ।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্যে ভারত পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে । এই পদ্ধতিটি বেশ কয়েকটি মূল কারণের মধ্যে নিহিত রয়েছে । প্রথমত, ভারতের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, ইউরোপের কোনও বিরোধ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার উপর জোর দেয় । ভারত যেমন এশিয়ার সংঘাতে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের প্রশংসা করে না, তেমনই ইউরোপীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে । রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রাথমিক প্রেক্ষাপট হল ইউরোপের ইতিহাস, যেখানে ভারতের অংশীদারিত্ব নেই ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কৌশলগত স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখার জন্য ভারতের সিদ্ধান্ত বেশ কিছু কারণে বিচক্ষণ । প্রথমত, পক্ষ নেওয়ার ফলে ভারতকে সুদূরপ্রসারী পরিণতি-সহ সংঘাতে জড়ানোর ঝুঁকি ছিল । মিত্রতা ও স্বার্থ জড়িত জটিল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, নিরপেক্ষতা ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও কূটনৈতিক নমনীয়তাকে রক্ষা করেছে ।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধের প্রকৃতি দেখে সেটাকে শক্তিশালী লড়াই বলতেই হবে ৷ এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবস্থান বদলাচ্ছে ৷ পাশাপাশি এই যুদ্ধ বিশ্বকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করার বিষয়েও উদ্বেগ তৈরি করেছে ৷ একদিকে রাশিয়া ও অন্যদিকে পশ্চিমী বিশ্বের সমর্থন পুষ্ট ইউক্রেন ৷ এর ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বিশ্বে বিভাজন তৈরি হচ্ছে৷ পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঠেকাতে ভারতের স্বার্থ নিহিত রয়েছে । বর্তমান পরিস্থিতি কোনও এক পক্ষের সঙ্গে থাকার বদলে অনেকের সঙ্গে থাকার উপর জোর দিচ্ছে ৷ পক্ষপাতমূলক অবস্থান থেকে দূরে সরে গিয়ে ভারতকে অবশ্যই তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থরক্ষা করে ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ নেভিগেট করতে হবে ।

ভূ-রাজনৈতিকভাবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি মহান শক্তি সংঘাত ৷ এর ফলে কাঠামোগতভাবে বিশ্বে মেরুকরণের গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ৷ ইউক্রেনের সমর্থনে পশ্চিমী বিশ্ব রয়েছে ৷ ফলে ইউক্রেন পিছু হটতে চাইছে না ৷ রাশিয়াও নমনীয় হতে নারাজ ৷ এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে । রাশিয়া, চিন, ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া ও আরও কিছু দেশ একদিকে রয়েছে ৷ এদের সঙ্গে পশ্চিমী বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ভাঙন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ৷ এই সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকা দেশগুলির জন্য অবশ্যই যথেষ্ট জায়গা রয়েছে । তাৎপর্যপূর্ণ অংশীদারিত্ব ছাড়াই অবস্থান নেওয়া সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ বনাম স্বার্থ সমীকরণকে জটিল করে তোলে ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলির অবস্থান এখন বহুমুখীতা থেকে বহু-সারিবদ্ধতার দিকে যাচ্ছে ৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও হামাস-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব সেই প্রক্রিয়ায় বাধা হচ্ছে ৷ এর ফলে শক্তির বণ্টন অসমভাবে হতে পারে ৷ কোনও দেশ অন্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনৈতিকভাবে এক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে । চিন এর ভালো উদাহরণ ৷ তাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ়, আবার পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল ৷

ভারতের শক্তি ও প্রতিরক্ষা চাহিদার ক্ষেত্রে রাশিয়া ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে । 2022 সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার উপর ভারতের তেল নির্ভরতাও বেড়েছে ৷ এর সঙ্গে সরবরাহের পাশাপাশি দামের বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে ৷ একটি শক্তি-নির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি বিশ্বের শক্তির বাজারে তার নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছে । তেলের দামের স্থিতিশীলতা ভারতের মতো একটি বড় শক্তি-নির্ভর দেশের জন্য একটি মূল কারণ ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিযোগিতার ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, যা ভারতের পছন্দগুলিকে বিভ্রান্ত করবে না । যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফলের মতো বাহ্যিক বিষয়গুলি ভারতের অবস্থানকে প্রভাবিত করবে না । অবশেষে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিপরীতে ভারতের নিজস্ব স্বার্থরক্ষার অর্থ ভারতের সঙ্গে অন্যান্য মহান শক্তির সম্পর্কের বিষয়টি কী হবে ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়বে কি ? দ্বিতীয়ত, ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিন বড় ফ্যাক্টর ৷ কারণ, চিন-রাশিয়া সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে৷ যদি না নাটকীয় পরিবর্তন পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে চিনের নিজস্ব সম্পর্ক ভেঙে না দেয় ।

সুদূর এশিয়া থেকে আপাত শান্ত পরিস্থিতি বলে মনে হলেও ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে ৷ লাভ বেশি হবে না জানা সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনের সবচেয়ে বিশিষ্ট শহর খারকিভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত অগ্রগতি ধীরে ধীরে হলেও এটা ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়াকে নতুন করে সীমান্ত তৈরিতে সাহায্য করবে ৷ অন্যদিকে, ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমী বিশ্ব থেকে যে অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে, তা মার্কিন সহায়তায় একটি পূর্ণতা পেতে পারে ৷ তার কারণ, গত এপ্রিল মাসে মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে 60 বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে ৷ ফলে এই যুদ্ধের শেষ এখনই দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে সারা বিশ্ব এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন করে বদলে যাওয়া নিয়ে সতর্ক ৷

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত এগিয়েছে, বিশ্বের নজরে ভারতের অবস্থান বদলেছে ৷ সেটা সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেন, উভয়ের অংশীদারিত্ব-সহ একটি পক্ষ হিসাবে দেখা পর্যন্ত । যেহেতু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছে, এই প্রত্যাশাগুলি নতুন করে সামনে এসেছে ৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, 15-16 জুন সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনে ভারতের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ৷

Russia-Ukraine War
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থান (ইটিভি ভারত)

ভারত রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধের পটভূমিতে খুব বেশি অসুবিধা ছাড়াই নেভিগেট করছে বলে মনে হচ্ছে ৷ কিন্তু ভারতের জন্য লুকানো চ্যালেঞ্জ হল - এটি একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ, যা ভৌগোলিকভাবে ভারতের থেকে খুব দূরে, তা কি ভারতের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য়পূর্ণ ?

ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে 70 বছরেরও বেশি সময়ের সম্পর্ক । প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি থেকে শুরু করে কৌশলগত অংশীদারিত্ব, এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীর । প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরতা তাৎপর্যপূর্ণ ৷ কিন্তু এই কারণগুলি কি বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলির অবস্থান শক্ত করার জন্য যথেষ্ট ?

শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বা ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখলে এই সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না ৷ প্রথমত, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঠান্ডা যুদ্ধের যুগের থেকে যথেষ্ট ভালো হয়েছে । দ্বিতীয়ত, ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এর ফলে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রভাব পরিবর্তন হয়েছে ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত স্বাধীন অবস্থান এবং গতিশীল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল । যুদ্ধের ফলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে, ভারতের শক্তি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করেছে । বেশিরভাগ দেশের মতো, ভারতকেও মানিয়ে নিতে হয়েছে এবং নতুন করে সবকিছু ভাবতে হয়েছে ৷

ভারতের অবস্থান এই যুগে যেকোনও ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে । এই অবস্থানকে কারও পক্ষপাতিত্ব না করে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করা বলেই বর্ণনা করা হয়েছে । রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের তার স্বার্থের উদ্দেশ্যমূলক মূল্যায়ন তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে করা যেতে পারে: এর কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, চলমান বিশ্ব ব্যবস্থায় মহান শক্তি পুনর্গঠন এবং শক্তি ও প্রতিরক্ষার চাহিদা ।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্যে ভারত পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে । এই পদ্ধতিটি বেশ কয়েকটি মূল কারণের মধ্যে নিহিত রয়েছে । প্রথমত, ভারতের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, ইউরোপের কোনও বিরোধ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার উপর জোর দেয় । ভারত যেমন এশিয়ার সংঘাতে বাহ্যিক হস্তক্ষেপের প্রশংসা করে না, তেমনই ইউরোপীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে । রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রাথমিক প্রেক্ষাপট হল ইউরোপের ইতিহাস, যেখানে ভারতের অংশীদারিত্ব নেই ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কৌশলগত স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখার জন্য ভারতের সিদ্ধান্ত বেশ কিছু কারণে বিচক্ষণ । প্রথমত, পক্ষ নেওয়ার ফলে ভারতকে সুদূরপ্রসারী পরিণতি-সহ সংঘাতে জড়ানোর ঝুঁকি ছিল । মিত্রতা ও স্বার্থ জড়িত জটিল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, নিরপেক্ষতা ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও কূটনৈতিক নমনীয়তাকে রক্ষা করেছে ।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধের প্রকৃতি দেখে সেটাকে শক্তিশালী লড়াই বলতেই হবে ৷ এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবস্থান বদলাচ্ছে ৷ পাশাপাশি এই যুদ্ধ বিশ্বকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করার বিষয়েও উদ্বেগ তৈরি করেছে ৷ একদিকে রাশিয়া ও অন্যদিকে পশ্চিমী বিশ্বের সমর্থন পুষ্ট ইউক্রেন ৷ এর ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বিশ্বে বিভাজন তৈরি হচ্ছে৷ পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঠেকাতে ভারতের স্বার্থ নিহিত রয়েছে । বর্তমান পরিস্থিতি কোনও এক পক্ষের সঙ্গে থাকার বদলে অনেকের সঙ্গে থাকার উপর জোর দিচ্ছে ৷ পক্ষপাতমূলক অবস্থান থেকে দূরে সরে গিয়ে ভারতকে অবশ্যই তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থরক্ষা করে ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ নেভিগেট করতে হবে ।

ভূ-রাজনৈতিকভাবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি মহান শক্তি সংঘাত ৷ এর ফলে কাঠামোগতভাবে বিশ্বে মেরুকরণের গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ৷ ইউক্রেনের সমর্থনে পশ্চিমী বিশ্ব রয়েছে ৷ ফলে ইউক্রেন পিছু হটতে চাইছে না ৷ রাশিয়াও নমনীয় হতে নারাজ ৷ এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে । রাশিয়া, চিন, ইরান, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া ও আরও কিছু দেশ একদিকে রয়েছে ৷ এদের সঙ্গে পশ্চিমী বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ভাঙন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ৷ এই সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকা দেশগুলির জন্য অবশ্যই যথেষ্ট জায়গা রয়েছে । তাৎপর্যপূর্ণ অংশীদারিত্ব ছাড়াই অবস্থান নেওয়া সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ বনাম স্বার্থ সমীকরণকে জটিল করে তোলে ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলির অবস্থান এখন বহুমুখীতা থেকে বহু-সারিবদ্ধতার দিকে যাচ্ছে ৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও হামাস-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব সেই প্রক্রিয়ায় বাধা হচ্ছে ৷ এর ফলে শক্তির বণ্টন অসমভাবে হতে পারে ৷ কোনও দেশ অন্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনৈতিকভাবে এক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে । চিন এর ভালো উদাহরণ ৷ তাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ়, আবার পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল ৷

ভারতের শক্তি ও প্রতিরক্ষা চাহিদার ক্ষেত্রে রাশিয়া ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে । 2022 সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার উপর ভারতের তেল নির্ভরতাও বেড়েছে ৷ এর সঙ্গে সরবরাহের পাশাপাশি দামের বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে ৷ একটি শক্তি-নির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি বিশ্বের শক্তির বাজারে তার নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছে । তেলের দামের স্থিতিশীলতা ভারতের মতো একটি বড় শক্তি-নির্ভর দেশের জন্য একটি মূল কারণ ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিযোগিতার ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, যা ভারতের পছন্দগুলিকে বিভ্রান্ত করবে না । যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফলের মতো বাহ্যিক বিষয়গুলি ভারতের অবস্থানকে প্রভাবিত করবে না । অবশেষে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিপরীতে ভারতের নিজস্ব স্বার্থরক্ষার অর্থ ভারতের সঙ্গে অন্যান্য মহান শক্তির সম্পর্কের বিষয়টি কী হবে ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়বে কি ? দ্বিতীয়ত, ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিন বড় ফ্যাক্টর ৷ কারণ, চিন-রাশিয়া সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে৷ যদি না নাটকীয় পরিবর্তন পশ্চিমী বিশ্বের সঙ্গে চিনের নিজস্ব সম্পর্ক ভেঙে না দেয় ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.