গত সপ্তাহে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ-এর বিনিয়োগ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও দ্রুত হতো, 'যদি আমাদের আরও নিরাপদ সীমান্ত থাকত ।’ যেহেতু স্থায়ীভাবে সীমান্তে নিরাপত্তার ব্য়বস্থা ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়, তাই খরচও বেশি হয় ৷ জওয়ানদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেওয়া ও সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এই খরচের মধ্য়ে রয়েছে ৷ সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল ইউরোপ ৷ সেখানে দেশগুলির মধ্যে কোনও আঞ্চলিক বিরোধ না থাকার কারণে খোলা সীমান্ত ৷ তাই নিরাপত্তা বাজেট কম হয় ।
ডোভাল আরও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের মতো সীমান্ত সমস্যা থাকায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সীমিত বাণিজ্যের ফলে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ে । ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু হলে পাকিস্তান অনেক উপকৃত হবে ৷ অন্যদিকে ভারতও একটি অতিরিক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে । যাই হোক, পাক নেতৃত্বের অলীক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের উপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলেছে বটে ৷ তবে তাদের অর্থনীতিকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ।
পাকিস্তান ভারতকে তার স্থলপথ ব্যবহার করার অনুমতি না দেওয়ায় আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগ বাড়াতে নয়াদিল্লিকে ইরানের চাবাহার বন্দরে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করেছে । এতে আগামী বছরগুলোতে পাকিস্তানের গুরুত্ব কমে যাবে । কিছু দক্ষিণ এশীয় দেশেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে ৷ যার ফলে তাদের জনসংখ্যা ভারতে স্থানান্তরিত হয়ে এই দেশের জনসংখ্যার উপর প্রভাব ফেলছে । পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এবং মণিপুর ও মিজোরামেও জনসংখ্যার পরিবর্তন দৃশ্যমান । এটি জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করে ।
এই বিষয়ে ডোভাল উল্লেখ করেছেন, 'সীমান্ত নিরাপত্তা দেশের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার ওপরও প্রভাব ফেলে ৷ যেমন মৌলবাদের আগমন । আমাদের এখানে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে, পাশাপাশি আরাকান (মায়ানমার) এলাকার লোকজনও এখানে আসছে । এগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে ।’ অনুপ্রবেশ বন্ধ করার দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ ও মায়ানমার সীমান্তে অসম রাইফেলসের উপর ।
একটি বাড়তি সমস্যা হল যে সীমান্তের সব অংশ কাঁটাতার ও নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত নয় । নদী, পাহাড়ি স্রোত ও উপত্যকা রয়েছে, যেখানে কাঁটাতার স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করা কঠিন । এগুলিকে ঠিক করা যেতে পারে ৷ এই ধরনের অঞ্চলে নজরদারি করার একমাত্র পদ্ধতি হল টহল ও পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার করা । নজরদারির জন্য প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সরঞ্জামগুলি ব্যবহারে খরচ অনেক ৷ তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও রয়েছে ৷ তবে এই খরচ অবশ্যই করা উচিত ৷
এই বিষয়ে ডোভাল বলেন, 'যদি বাস্তবে আপনার পরিস্থিতি ভালো না হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা কম হয় ৷ আপনার কাছে আরও ভালো মানের সেন্সর, রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ইত্যাদি থাকে, তাহলে আপনি আরও ভালো প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হবেন ৷’ সরঞ্জামগুলিকে ব্যবহার করতে কর্মীদের প্রশিক্ষণও সমানভাবে প্রয়োজনীয় । তবে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হলে টহল জরুরি ৷
গত বছরের 7 অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলা ইজরায়েলিদের প্রতিটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করে হয়েছিল । গাজার কাঁটাতারকে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও প্রযুক্তি নিবিড় সীমান্ত হিসাবে বিবেচনা করা হতো । সেখানে সেন্সর, সিসিটিভি ক্যামেরা, বিদ্যুতায়ন এবং আর যা যা ছিল, তার সবকটিই সারাক্ষণই নিরীক্ষণ করা হতো । এগুলিকে সহজ উপায়ে এড়িয়ে বিস্ময়করভাবে ইজরায়েলিদের উপর হামলা চালানো হয় ৷
ভারতের বেশিরভাগ সীমান্ত অঞ্চল প্রত্যন্ত এবং এখনও অবধি অনুন্নত রয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে উত্তর অংশে । একটি ধারণা ছিল যে পরিকাঠামো যদি বিকশিত হয়, তবে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৷ এটি স্থানীয় জনগণকে বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর চলাচলকেও প্রভাবিত করেছে । বর্তমানে পরিকাঠামোগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে ।
সীমান্ত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়ন জনগণকে ভারতীয় সমাজে আকৃষ্ট করবে । এটি পর্যটনের প্রচারও বৃদ্ধি করবে । এই নিয়ে ডোভাল উল্লেখ করেছেন যে পরিকাঠামো সংক্রান্ত উন্নয়ন থিয়েটার ও রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ৷ মোবাইল টাওয়ার তৈরি করা উচিত ৷ তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা চ্যালেঞ্জ রয়েছে ।
ডোভাল সীমান্ত গ্রামগুলিকে 'আমাদের চোখ' বলে উল্লেখ করেছেন । তিনি সীমান্ত গ্রামগুলিকে ইজরায়েলের নিযুক্ত প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছেন ৷ তিনি উল্লেখ করেছেন, 'সীমান্তে তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি শূন্য ছিল । তারা বুঝতে পারেনি যে হাজার হাজার হামাস লোক অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছে । তাদের সব উচ্চপ্রযুক্তি ছিল । আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের এত চোখ (গ্রামবাসী) আছে, যেগুলো সীমান্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারে । আমরা আমাদের গ্রামের সঙ্গে একটি ইন্টারফেস পেয়েছি ।’
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গ্রামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা বর্তমানে 'প্রথম গ্রাম' ধারণার একটি অংশ, যা মোদি সরকারের দ্বারা তৈরি করা হয়েছে । মানা পরিদর্শন করার পর প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন, ‘এখনও আমার কাছে সীমান্তের প্রতিটি গ্রামই দেশের প্রথম গ্রাম ।’ আগে এগুলোকে ‘শেষ গ্রাম’ বলা হতো ।
অরুণাচল, সিকিম, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির বিকাশের উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার 'ভাইব্র্যান্ট ভিলেজ' প্রকল্প তৈরি করেছে ।' ওই গ্রামের বাসিন্দারা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য 'চোখ ও কান' হবে । যে সমস্ত জায়গায় নজরদারির অভাব রয়েছে, সেখানে শত্রুদের গতিবিধি বরাবর দিয়ে এসেছেন পশুপালকরা ৷
ডোভালের দ্বারা উত্থাপিত আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হল কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বা সিএপিএফ-এর মধ্যে আরও সমন্বয় ও আন্তঃকার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা । তিনি উল্লেখ করেছেন, 'আমাদের কি এগিয়ে যাওয়া উচিত এবং আমাদের সিএপিএফ-এর আন্তঃকার্যক্ষমতার মধ্যে যৌথ কাজ করার কথা ভাবতে হবে । আমরা এখন একসঙ্গে একটি বিশাল শক্তি ৷ আমরা অনেক জায়গায় একই ধরনের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৷ যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ, মান উন্নত করার মতো বিষয়গুলি এখানে রয়েছে ৷’ সিএপিএফ-এর সম্মিলিত শক্তি বর্তমানে প্রায় 10 লাখ ।
ভারতে সিএপিএফ-এর অধীনে অনেক সংস্থা রয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে বিএসএফ, সিআরপিএফ, এসএসবি, সিআইএসএফ, অসম রাইফেলস (যদিও এটি সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করে) এবং আইটিবিপি । সমস্ত সিএপিএফ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে রয়েছে । তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে । যদিও তাদের দায়িত্বগুলি সাধারণত নির্দিষ্ট করা হয়, সেখানে সর্বদা একটি ওভারল্যাপ থাকে । অসম রাইফেলস মায়ানমার সীমান্তে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উত্তর-পূর্বে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে ।
বিএসএফ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তে মোতায়েন রয়েছে ৷ কয়েকটি ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রণ রেখাতেও রয়েছে ৷ আইটিবিপি মূলত উত্তর অংশে মোতায়েন করা হয়েছে । সিআরপিএফ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বে, তাই জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর পূর্বে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কাজ করে ৷ সিআইএসএফ বন্দর ও বিমানবন্দর-সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি সুরক্ষিত করে । এসএসবি নেপাল ও ভুটান সীমান্ত পরিচালনার জন্য দায়িত্বে রয়েছে । বিভিন্ন সিএপিএফ মাও অধ্যুষিত এলাকায় কাজ করে ।
ভারত কখনোই 'এক সীমান্ত এক বাহিনী' তৈরির বিষয়টি বিবেচনা করেনি ৷ এর থেকে বোঝা যায় যে যতগুলি বিভিন্ন বাহিনী মোতায়েন করা হোক না কেন, সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য একটি বাহিনী দায়ী থাকবে । যদিও বিএসএফ সীমান্তে সীমাবদ্ধ সীমানা এবং নির্দিষ্ট সীমান্তে এসএসবি দায়িত্ব রয়েছে ৷ এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রেখা ও চিনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা নেই ৷ সেখানে সেনাবাহিনী, বিএসএফ ও আইটিবিপি-র জওয়ানদের মোতায়েন করা হয় । এই অঞ্চলগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ সেখানকার বারবার গোলমাল হয় ৷ যুক্তিসঙ্গত কারণে এই এলাকাগুলির দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর থাকা উচিত ৷ এই অঞ্চলে নিযুক্ত সমস্ত অতিরিক্ত বাহিনী অবশ্যই সেনার অধীনে কাজ করা উচিত ৷
যেহেতু সিএপিএফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে রয়েছে, তাই এই ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সমস্যা হচ্ছে ৷ কারণ, সব বাহিনীকে এক ছাতার তলায় আনা হলে, তা সরাসরি প্রতিরক্ষামন্ত্রকের অধীনে চলে যাবে ৷ এর ফলে কাজ পরিচালনায় সমস্যা বাড়তে পারে ৷ কারণ, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সদর দফতর, সেনাবাহিনী এবং তাদের নিজস্ব থেকে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে ৷
যদিও সিএপিএফ-এর মধ্যে যৌথ ও একীভূত ভাবে কাজ করালে, তাদের ভূমিকার পরিবর্তন হবে এবং কার্যকারিতা বাড়াতে সক্ষম হবে ৷ একইভাবে উন্নত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় মোতায়েত থাকা বাহিনীর জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযুক্তকরণের বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন । সম্ভবত নতুন সরকার এই দিকটি বিবেচনা করতে পারে ।