হায়দরাবাদ, 10 ফেব্রুয়ারি: জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ দেখে এখন 'এল নিনো' নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে ৷ কী এই ‘এল নিনো’ ? এটা একটা সামুদ্রিক ঘটনা ৷ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে টপিক্যাল অঞ্চলে দেখা যায় ৷ ভূপৃষ্ঠের জলের উষ্ণায়নের জেরে এটা তৈরি হয় ৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু থেকে দূরে সমুদ্রে কিছু একটা ঘটছে, তা নিয়ে ভারতের মানুষ চিন্তিত হবে কেন ? কারণ, এটা আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে ৷ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলের উষ্ণতার হেরফের দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষা-সহ বিশ্বের অনেক অংশে বৃষ্টিপাতের ধরনের সঙ্গে জটিলভাবে সম্পর্কিত ৷ আর বৃষ্টি তো ভারতের কোটি কোটি মানুষের জীবনরেখা । তাই এই ‘এল নিনো’ স্বাভাবিকভাবেই ভারতেরও চিন্তার কারণ হয় কখনও কখনও ৷
চিনে যেমন পরস্পর সংযুক্ত কিন্তু বিপরীত শক্তির দু’টি জিনিসকে 'ইয়িন ও ইয়াং' বলা হয় ৷ এটাও অনেকটা সেই রকম ৷ এর এক প্রান্তকে বলা হয় ‘এল নিনো’ এবং অন্য প্রান্তকে বলা হয় ‘লা নিনা’ ৷ যখন নিরক্ষীয় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের জলস্তর শীতল হয়, তখন এই পরিস্থিতি তৈরি হয় ৷ পেরুর মৎস্যজীবীরা এই বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করেন ৷ তাঁরাই এর নাম দেন ৷ স্প্যানিশে ‘এল নিনো’র অর্থ ছোট ছেলে আর ‘লা নিনা’র অর্থ ছোট মেয়ে ৷ বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে এল নিনো সাউদার্ন ওসিলিয়েশন বা ইএনএসও সাইকেল বলেন ৷
স্বাভাবিক সময়ে বাণিজ্য বায়ু (ট্রেড উইন্ডস) বা ইস্টারলিগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিষুবরেখার সমান্তরালে প্রবাহিত হয় এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উষ্ণ জলকে এশিয়ার দিকে প্রবাহিত করতে বাধ্য করে । বাণিজ্য বায়ু এই অঞ্চলের উপরের উষ্ণ জলকে দূরে ঠেলে দিতে সাহায্য করে, যা নীচ থেকে পুষ্টিসমৃদ্ধ ঠান্ডা জলকে উপরে ওঠার প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে ৷ এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সমুদ্রে মাইক্রোস্কোপিক প্ল্যাঙ্কটন থেকে মাছের বিকাশে সাহায্য করে ৷ কিন্তু ‘এল নিনো’ পর্বে বাণিজ্য বায়ু আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে উষ্ণ জল ঠেলে তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে ৷ তখনই ‘লা নিনা’ বাণিজ্য বায়ুর শক্তি সংগ্রহ করে । যাই হোক, উষ্ণ ও ঠান্ডা হওয়ার এই পর্যায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ৷
সাউদার্ন ওসিলিয়েশনের ঘটনাটি প্রথম গিলবার্ট থমাস ওয়াকার আবিষ্কার করেছিলেন, যিনি 1904 সালে ভারতের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মহাপরিচালক হিসাবে কাজ করছিলেন । তিনি তাঁর কঠিন গাণিতিক জ্ঞানকে ভারত ও অন্যান্য অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে আবহাওয়ার তথ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করতে ব্যবহার করেছিলেন । বিশ্বে তিনিই প্রথম ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের বিকল্প ওসিলিয়েশন প্যাটার্ন এবং ভারত-সহ টপিক্যাল অঞ্চলে পরিবর্তনশীল তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরনের সম্পর্ক নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন ৷ যদিও সেই সময় কেউ তাঁর অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেননি৷ তবে ওয়াকার তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন ।
গিলবার্ট ওয়াকারের নামানুসারে তথাকথিত ‘ওয়াকার সার্কুলেশন’ আবার আবিষ্কার 1960 সালে উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সম্ভব হয়েছিল ৷ সমুদ্র এবং বায়ুমণ্ডল প্রকৃতপক্ষে যে একসঙ্গে আবদ্ধ, সেটাও প্রমাণিত হয় তখন ৷ এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর জন্য একটি জটিল প্রতিক্রিয়া অংশ । আজকাল উন্নত স্যাটেলাইট প্রযুক্তি যেমন অ্যাডভান্সড ভেরি হাই-রেজোলিউশন রেডিওমিটার দ্বারা সংগৃহীত তথ্য আমাদের মহাসাগরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার অসামঞ্জস্য নিরীক্ষণ করতে সাহায্য করে । আমরা এখন বেশ কয়েকটি উপগ্রহ থেকে বিশ্বব্যাপী বৃষ্টিপাতের তথ্য মিশ্রিত করতে সক্ষম ।
ইএনএসও ফিডব্যাক লুপের সূচনা বিন্দু কোথায়, তা স্পষ্ট নয় । এটা হতে পারে যে যখন বাণিজ্য বায়ু শিথিল হয়ে যায়, তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাতাসের শক্তিশালী হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় উষ্ণ বা শীতল হতে শুরু করে । কিন্তু এই তাপমাত্রার পরিবর্তন সাধারণত এক বছরের বেশি স্থায়ী হয় না ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কয়েক বছর স্থায়ী হতে দেখা গিয়েছে ৷ সারা বিশ্বে দীর্ঘ ঝাঁকুনি । গতবছর বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন উচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৷ এর নেপথ্যে আসল কারণ এল নিনো বলেই মনে করা হয় ৷
বিজ্ঞান সংক্রান্ত একটি জার্নাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্সে প্রকাশিত একটি নতুন সমীক্ষা দেখা গিয়েছে যে, সূর্যের তাপমাত্রার বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলি ‘এল নিনো’ তৈরিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে ৷ এছাড়া গ্রিন হাউস গ্যাসের জেরে মানুষের তৈরি গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা কারণ ৷
এখন এনওএএ-এর জলবায়ু কেন্দ্রের দ্বারা রিপোর্ট করা হয়েছে যে ‘সুপার স্ট্রং এল নিনো’ প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলে অভূতপূর্ব তাপমাত্রা তৈরি করেছে ৷ যা স্বাভাবিকের চেয়ে 2 ডিগ্রির বেশি ৷ যার প্রভাব খুব শীঘ্রই দেখা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ এর কারণ শক্তিশালী ‘এল নিনো’র প্রভাবে গত বছর সবচেয়ে উষ্ণ বছর ছিল ৷ ভারত 120 বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ গরমের সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ৷ এর মধ্যে শুষ্কতম মাস ছিল অগস্ট ৷ ওই মাসে বৃষ্টিপাতের 6 শতাংশ ঘাটতি ছিল ৷ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অন্তত 25 শতাংশ অংশে খরা পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে । 2024 সালের এপ্রিলের মধ্যে ইএনএসও নিরেপক্ষ অবস্থানে চলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে ৷ কিন্তু তার পর ‘লা নিনা’র প্রভাব তৈরি হতে কত সময় লাগবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ৷
আর এই ‘লা নিনো’র প্রভাবে ভারতে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে ৷ আর এখানে তাপমাত্রাও কমবে ৷ কিন্তু সেই তাপমাত্রা কতটা কমবে, বৃষ্টির পরিমাণ কতটা বাড়বে, এর ফলে গত বছর যে কষ্ট পেতে হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অংশের মানুষকে ৷ তাঁরা কি এবার পর্যপ্ত স্বস্তি পাবেন ? তবে আশঙ্কাও থাকছে৷ কারণ, ‘লা নিনা’ রাক্ষসেও পরিণত হতে পারে ৷ যার জেরে অসময়ে বৃষ্টি চাষের ক্ষতি করতে পারে ৷ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে৷ তাই আগে থেকে সতর্ক হওয়া জরুরি ৷
আরও পড়ুন: