হায়দরাবাদ, 31 জুলাই: কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত 23 জুলাই মোদি সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদ তথা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করেছেন ৷ সাধারণ নির্বাচনের পরে এটি প্রথম বাজেট হওয়ায় ভোটে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে দেশে অর্থনীতির বিভিন্ন মহল থেকে এর থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেকটাই ।
প্রত্যাশিত ভাবেই, এই বাজেট পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে, যা অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারের অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট । এই রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের কৌশলগত অগ্রাধিকার প্রদানের স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে এই বাজেটে ৷
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবি, বর্তমান সরকার কর্মসংস্থান, দক্ষতা, এমএসএমই এবং মধ্যবিত্তের উন্নয়নে উপর জোর দিয়ে চারটি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ দরিদ্র, মহিলা, যুবসমাজ ও কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে চায় ৷ রাজনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, এই বাজেট এমন এক সময়ে পেশ করা হয়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি, ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ৷ ফলে প্রধান অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি কঠোর হচ্ছে এবং দেশজুড়ে অসম আর্থিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে ।
ভারত এই অর্থনীতি, ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যেও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র উঠে আসছে ৷ কারণ, দেশে কোভিড-19-পরবর্তী আর্থিক বৃদ্ধির গতি অব্যাহত রেখেছে এবং বিশ্বব্যাপী এবং অভ্যন্তরীণ একাধিক সমস্যা সত্ত্বেও 2024 অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার 8.2 শতাংশে উন্নিত করেছে । এই পটভূমিতে, আমাদের 2024-25 অর্থবছরের বাজেটের প্রকৃত বরাদ্দ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে বুঝতে হবে ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি
বৈশ্বিক অস্থিরতার রুক্ষ পরিস্থিতি সত্ত্বেও ভারত এখনও একটি স্থিতিশীল বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ৷ অর্থনৈতিক সমীক্ষা 2023-24-এর তথ্য ভারতের মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) সম্পর্কে এমনই তথ্য দেয় । ওই সমীক্ষায় দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি 2024 সালের মার্চ মাসে যা 8.2 শতাংশ হয়েছে তা চলতি অর্থবছরে 6.5 শতাংশ থেকে 7 শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা IMF) এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (ADB) 2024-25-এর জন্য ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার 7 শতাংশ অনুমান করেছে । সম্ভাব্য নিম্নমুখী আর্থিক বৃদ্ধির এই চ্যালেঞ্জ দেশের ভোগ বাবদ ব্যয়, সরকারি ব্যয় বা বিনিয়োগ ব্যয় বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে বা রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে মোকাবিলা করা যেতে পারে । অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখিত কিছু কৌশলের সমন্বয়েরও চেষ্টা করা যেতে পারে ।
ভোগ্য সামগ্রীর ক্রয় ও পরিষেবার লক্ষ্যে ব্যয় বৃদ্ধি
বাজেটের বৃহৎ লক্ষ্য হল, দেশে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভোগ্য সামগ্রীর ক্রয় বৃদ্ধি করা যা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে । এর কারণ হল, উচ্চ স্তরের কর্মসংস্থান মানুষের হাতে আরও বেশি অর্থ দেয় এবং তারা পরিবর্তে আরও বেশি পণ্য এবং পরিষেবার লক্ষ্যে ব্যয় করে । এই চাহিদা পণ্য এবং পরিষেবার ব্যবহার বাড়ায় এবং এর ফলে আরও বেশি উৎপাদন বৃদ্ধি হয় । অধিক উৎপাদনের জন্য উচ্চতর কর্মসংস্থানের প্রয়োজন । এটি শেষ পর্যন্ত উচ্চতর জিডিপি এবং দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথ প্রসস্থ করে ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় প্রকল্প
এই প্রত্যাশা নিয়েই কেন্দ্রীয় সরকার আগামী পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একাধিক প্রকল্পে 2 লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে । দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে । এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে, আগামী পাঁচ বছরে দেশের 20 লক্ষ তরুণদের দক্ষ করার জন্য একটি নতুন কেন্দ্রীয় আর্থিক মদতপুষ্ট প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে ৷ এই লক্ষ্যেরই অংশ হিসাবে 7.5 লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের সুবিধার্থে মডেল স্কিলিং লোন প্রকল্পটিও সংশোধন করা হবে ।
পাশাপাশি, এমএসএমই-র জন্য ঋণের সহজলভ্যতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা করা হয় ৷ এগুলি মূলত শ্রম এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার উচ্চ সম্ভাবনাযুক্ত । ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের মতো উদ্যোগ, মুদ্রা ঋণের সীমা বাড়িয়ে 20 লক্ষ টাকা করা এবং ঋণের জন্য এমএসএমই-এর যোগ্যতা মূল্যায়ন করার জন্য বিকল্প পদ্ধতি তৈরি করার মতো পদক্ষেপগুলি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভোগ্য সামগ্রীর ক্রয় ও পরিষেবার লক্ষ্যে ব্যয় বৃদ্ধির সরকারের লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ।
বাজেটের থেকে সাধারণ মানুষের আশা ও সেই প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গৃহিত পদক্ষেপ
এটি উল্লেখ্য যে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া এবং প্রত্যাশিত ফলাফল পেতে সময় লাগবে । এরই মধ্যে, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, সবরকম কর দেওয়ার পরেও দেশের সাধারণ মানুষের হাতে যেন আরও বেশি টাকা থাকে, যাকে আমরা নিষ্পত্তিযোগ্য আয় বলি । মধ্যবিত্তের উদ্বেগ দূর করতে বাজেটে ট্যাক্স স্ল্যাব পরিবর্তনের ঘোষণা করা হবে বলে আশাবাদী দেশের মানুষ । এই আশা পূরণের লক্ষ্যেই এ বারের বাজেটে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের পরিমাণ 50 শতাংশ বাড়িয়ে 75,000 টাকা করা হয়েছে এবং নতুন আয়কর ব্যবস্থা (new income tax regime) বেছে নেওয়া করদাতাদের জন্য ট্যাক্স স্ল্যাবগুলির সামঞ্জস্য করা হয়েছে । যদিও, এই সব পদক্ষেপ দেসের সাধারণ মানুষের ভোগ্য সামগ্রীর ক্রয় ও পরিষেবার লক্ষ্যে ব্যয় বৃদ্ধির ধরণগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না ৷ কারণ, অনেক করদাতাই পুরানো স্ল্যাবে তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন ।
যাদের সামগ্রিক করের পরিমাণ কর্পোরেটের রাজস্বে অবদানের চেয়ে বেশি, আয়করের স্ল্যাবগুলির সংশোধন করদাতাদের জন্য বড় স্বস্তি এনে দিতে পারে । এই পদক্ষেপ ভোগ্য সামগ্রীর ক্রয় ও পরিষেবার লক্ষ্যে ব্যয় বৃদ্ধির গতি বাড়িয়ে দিতে পারে ৷ যদিও, উচ্চতর ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা এবং রাজস্বের একীকরণ সরকারের নীতিগত অবস্থান দ্বারা সীমাবদ্ধ ।
দেশের আর্থিক বৃদ্ধিকে আরও গতি দেওয়ার জন্য, কেন্দ্রীয় সরকার শহুরে এবং গ্রামীণ বাজারের জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার উপর জোর দিয়েছে, যা গ্রামীণ এলাকায় নতুন আয়-উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে । এছাড়াও, কৃষি প্রকল্প এবং গ্রামীণ উন্নয়নের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়ে এই বাজেটে যা পরোক্ষভাবে ভোগ বাবদ ব্যয়কে বাড়িয়ে তুলতে পারে । এর পাশাপাশি, বেসরকারী খাতের পরিকাঠামোগত বিনিয়োগও কার্যক্ষমতা ব্যবধান তহবিলের মাধ্যমে প্রসার করা হবে এবং প্রয়োজনীয় নীতি ও নিয়ম চালু করা হবে ।
এমনকি, একটি বাজার ভিত্তিক অর্থায়ন কাঠামোরও প্রস্তাব করা হয়েছে এই বাজেটে । উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি সত্ত্বেও, এটি আশ্চর্যজনক যে, (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন) MNREGA-এর জন্য এই বছরের বাজেট বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় 19,297 কোটি টাকা কম । এমনকি, যখন এই বরাদ্দগুলিকে মোট বাজেটের একটি অংশ হিসাবে দেখলেও তা গত 10 বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । এই ক্ষেত্রে উচ্চ বরাদ্দ গ্রামীণ বাজার এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে আরও গতিময় করবে ।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোগ-ব্যয় বাড়ানো, আর্থিক একত্রীকরণের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এই বাজেটে । এবার ধৈর্য ধরে দেখতে হবে কীভাবে এই পদক্ষেপগুলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে ।
লেখক শ্রীনগর গাড়ওয়াল, উত্তরাখণ্ডের এইচএনবি গাড়ওয়াল ইউনিভার্সিটির বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান । এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত ৷ প্রবন্ধে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ।