মালদা, 8 অক্টোবর: নাটমন্দির সর্বজনীনের পুজো মণ্ডপে ঢুকলেই মনে হবে যেন আমের রাজ্যে প্রবেশ ৷ চারদিকের দেওয়ালজুড়ে আমের বিবরণ ৷ হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রখ্যাত জমিদার রামপ্রসন্ন রায়ে নামাঙ্কিত প্রসন্নভোগ আম এখন প্রায় লুপ্ত ৷ মাত্র একটি গাছই বেঁচে রয়েছে ৷ রাজা লক্ষ্মণ সেনের নাম ব্যবহারে কীভাবে লক্ষ্মণভোগ আমের উৎপত্তি, তার পূর্ণ বিবরণ রয়েছে এই দেওয়ালেই ৷ মালদার নাটমন্দির সর্বজনীনের দুর্গাপুজোর কাহিনী তুলে ধরল ইটিভি ভারত ৷
এবছর তাদের অবদান 'আম-কথা'৷ মণ্ডপে থাকছে এছাড়া জিআই তকমা পাওয়া ফজলি, আম্রপালি, হিমসাগর, ল্যাংড়ার প্রাচীন ইতিহাস ৷ সব মিলবে এই মণ্ডপে ৷ থাকছে একটি আমবাজারও ৷ সেই বাজারে নানা প্রজাতির আম বিক্রি করবে বিক্রেতারা ৷ সবই মাটির ৷ এর জন্য কৃষ্ণনগর থেকে আনা হয়েছে একাধিক মডেল ও আম ৷ দেবীমূর্তি তৈরি করেছেন এই শহরেরই শিল্পী মিন্টু হালদার ৷
জেনে নিন এখানকার বিশেষত্ব: 1800 সাল ৷ ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে তখন মালদা অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র ৷ আম, রেশমের রমরমা কারবার ৷ পূর্ব বাংলায় যাতায়াতের পথে অন্যতম বিশ্রাম কেন্দ্র হিসাবেও স্বীকৃত এই শহর ৷ শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দায় বিশাল বিশাল ঢেউ ৷ প্রায় প্রতিদিনই বণিকদের বজরা ঠেকত নদীর ঘাটে ৷ নাব্য মহানন্দা বেয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতেন তাঁরা ৷ পারস্য দেশের বণিকরাও তখন এখানে বাণিজ্য করতেন ৷ এমন এক জায়গায় যা হয়, সেটাই হয়েছিল ৷
পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বারবণিতারা ৷ তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল শহরজুড়ে ৷ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তৎকালীন বিদ্বজ্জনেরা ৷ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শেষে এগিয়ে এলেন হংসনারায়ণ গিরি ৷ প্রখ্যাত বণিক ৷ বিপুল সম্পদের অধিকারী ৷ বারবণিতাদের তিনি শর্ত দিলেন, যদি তাঁরা একটি জায়গায় সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করেন তবে তিনি তার ব্যবস্থা করে দেবেন ৷ তাঁর শর্তে রাজি হয়ে গেলেন দেহপসারিণীরাও ৷ অবশেষে নিজের সম্পত্তি থেকে বেশকিছু জমি বারবণিতাদের দান করলেন হংসনারায়ণ ৷ সেই জায়গায় গড়ে উঠল মালদা শহরের একমাত্র পতিতা পল্লী ৷ নতুন এই এলাকার নাম হয়ে গেল হংস গিরি লেন ৷ এখনও সেই নামেই এই এলাকাকে চেনে মালদার মানুষ ৷
তবে গোটা হংস গিরি লেনেই কিন্তু বারবণিতাদের বাস নয়, শুধুমাত্র একটি রাস্তা এবং তার দু'ধারের খানিকটা অংশজুড়ে বাস তাঁদের ৷ বাকি লেনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের বসবাস ৷ পতিতাপল্লির মূল রাস্তার পাশেই রয়েছে একটি দুর্গামন্দির ৷ যা নাটমন্দির নামে পরিচিত ৷ সেখানে দুর্গাপুজো হয় ৷ এলাকার মানুষের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন তথাকথিত 'নিষিদ্ধ' নারীরাও ৷
আমের 'রমরমা': মালদায় যে কোনও নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলির ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় আম ৷ এ থেকে এড়িয়ে থাকতে পারে না জাতীয় নির্বাচন কমিশনও ৷ তার প্রমাণ মিলেছে গত লোকসভা নির্বাচনে ৷ আমকে থিম করেই সেবার তৈরি হয়েছিল মডেল বুথ ৷ তাই এবারের পুজোয় সেই আমকেই থিম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পুজো কমিটির সদস্যরা ৷
নাটমন্দিরের পুজো: কয়েক বছর ধরে নাটমন্দির সর্বজনীনের পুজো মালদাবাসীর মুখে মুখে ফেরে ৷ থিমের বৈচিত্র্য এই পুজোকে অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা করে রেখেছে ৷ এবছর তাদের অবদান 'আম-কথা'৷
কী বলছেন পুজো উদ্যোক্তা: পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য মঙ্গল দাসের গলায় সেই সুরই শোনা গেল ৷ তিনি বলেন, "আম মালদার ঐতিহ্য, মালদার পরিচিতি ৷ একটা সময় অসংখ্য প্রজাতির আম এই জেলায় উৎপাদিত হত ৷ ইতিমধ্যে অনেক প্রজাতি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ৷ এখন আমবাগান কেটে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে ৷ জমি মাফিয়াদের সফট টার্গেট আমবাগান ৷ এতে জেলায় আমবাগানের পরিমাণ কমে যাচ্ছে ৷ আমরা চাই, জেলার আম বেঁচে থাকুক ৷ আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি ৷ শুধু আমগাছ নয়, আমরা জেলাবাসীকে গাছ লাগানোর জন্যও সচেতন করছি ৷ তাতে সবুজ হবে এই মালদা ৷ রক্ষিত থাকবে ভবিষ্যতের জীবন ৷"
শিল্পী কী বলছেন: পুজো কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মাসখানেক ধরে মণ্ডপ সাজিয়ে তুলছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার শালমারা গ্রামের পটশিল্পীরা ৷ তাঁদেরই একজন মৌসুমি রানা ৷ তিনি বলেন, "স্বামীর কাছেই এই কাজ শিখেছি ৷ সেটাও 15 বছর হয়ে গেল ৷ শুধু প্যান্ডেল নয়, কাগজ ও শাড়িতে পেইন্টিং, পটের ছবি, সবই করি ৷ 6-7 বছর ধরে প্যান্ডেলের কাজ করছি ৷ মালদার মানুষ খুব ভালো লাগে ৷ মালদার আম তো আরও ভালো ৷ এই জেলার ঐতিহ্য নিয়ে এবার কাজ করছি ৷"