হায়দ্রাবাদ, 20 ডিসেম্বর: রাজনীতি যদি সম্ভবনার শিল্প হয়, তাহলে নির্বাচনকে জয়ের প্রতীক ভাবা যেতেই পারে। এরই ভিত্তিতে দেশে দেশে, কালে কালে নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বহু কিংবদন্তি। আর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে পালের হাওয়া নিজের দিকে ঘুরিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়েছেন নেতারা। নভেম্বরে শেষ হওয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এমনই এক কিংবদন্তির জন্ম দিল - ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিসকে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর মার্কিন-মসনদে ফিরে আসা মহাকাব্যের মতোই ঐতিহাসিক, কালজয়ী। তিনিই আমেরিকার 45তম ও 47তম রাষ্ট্রপতি।
ট্রাম্পের লাভ, হ্যারিসের লোকসান
মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাস থেকে গতিপ্রকৃতি কোনওটাই ভারতের সঙ্গে মেলে না। আমেরিকার সরকার প্রেসিডেন্ট পরিচালিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাধারণ মানুষের ভোটে। আর ভারতের সরকার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে থাকা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা পরিচালিত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা।
আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে থেকে একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন ভোটাররা। সেই হিসেবে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন বড় ব্যবধানে। ট্রাম্প পেয়েছেন 312টি ইলেক্টোরাল ভোট। শতাংশের বিচারের তাঁর প্রাপ্ত ভোট 49.9 শতাংশ। আর 48.4 শতাংশ ভোট পেয়ে হ্যারিসের ঝুলিতে গিয়েছে 226টি ইলেক্টোরাল ভোট।
ট্রাম্প, নাম তো শুনা হি হোগা
মাত্র একটা বছর কোনও মানুষের জীবনে কী কী পরিবর্তন আনতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে ট্রাম্প এবং 2024 সালকে বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বছরের শুরুতেই পর্ণ তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ দেওয়া সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন ট্রাম্প। তিনিই আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি কোনও মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেন। আর বছরের শেষ দিকে তাঁর উপরেই আবারও আস্থা রাখল আমেরিকা। তবে ট্রাম্পের জীবনে এমন নজির গড়া বেনজির ঘটনা নয়। ট্রাম্প মানেই শিরোনাম। ট্রাম্প মানেই বিতর্ক।
বিতর্কের শুরু অবশ্য কয়েক দশক আগে। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে এক ব্রিটিশ মডেলের সঙ্গে আপত্তিকর আচরণ করার অভিযোগ আছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন মডেল থেকে শুরু করে অভিনেত্রী, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন নানা অভিযোগ এনেছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। অন্য অভিযোগের তালিকাও খুব একটা ছোট নয় । চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল আমেরিকায়। সে বার জো বাইডেনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। ফল প্রকাশের সময় তিনি দাবি করেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। পরে মার্কিন সংসদ ভবনে বেশ কিছু লোক হামলা চালায়। তাদের বেশিরভাগই ট্রাম্প সমর্থক বলে দাবি ওঠে। এই নিয়ে দায়ের হয় ফৌজদারি মামলাও।
ট্রাম্প ও গুলি
ঘটনা আরও আছে। সরাসরি ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলিও চালানো হয়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে দু'বার চলেছে গুলি। প্রথম ঘটনাটি ঘটে জুলাই মাসে। পেনসিলভিনিয়ায় একটি সভা চলাকালীন ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে চলে গুলি। কান স্পর্শ করে চলে যায় গুলি। ট্রাম্পের কান থেকে রক্ত পড়তে দেখা যায় । এর কয়েক মাস বাদে সেপ্টেম্বর মাসে নিজের পাম বিচের বাড়ির কাছে এক জায়গায় গল্ফ খেলছিলেন ট্রাম্প । সে সময়েও তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর চেষ্টা হয়। তার আগেই ধরা পড়ে যায় বন্দুকবাজ । ট্রাম্পের কোনও ক্ষতি হয়নি। ঘটনাস্থলেই ধরা পড়ে বন্দুকবাজ । তবে এসব এখন অতীত। কারণ সবাই জানে জো জিতা ওহি সিকন্দর। আর সেই ডোনাল্ড ‘সিকন্দর’ ট্রাম্পের হাতেই থাকছে আমেরিকার আগামী পাঁচ বছর।
প্রত্যাশার চাপ থেকে…
তামিলনাড়ুর তিরুবারুর জেলার ছোট্ট গ্রাম থুলাসেনদ্রাপুরম। এই গ্রামেই থাকতেন হ্যারিসের দাদু। সেখান থেকে আমেরিকা আর তারপর একেবারে হোয়াইট হাউসের হাতছানি - কমলা হ্যারিসকে নিয়ে ক্রমশ চড়ছিল প্রত্যাশার পারদ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাস তিনেক আগে লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন বাইডেন। তাঁর ইচ্ছাতেই প্রার্থী হন কমলা। এর আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হননি। সেদিক থেকে সকলেরই মনে হয়েছিল আমেরিকায় থাকা ভারতীয়দের সমর্থন হয়তো হ্যারিসের দিকেই যাবে। এমনিতেই ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভারতীয়দের সমর্থন থাকে, কিন্তু এবারে অঙ্কটা মিলল না।
…পরাজয়ের অন্ধকার
দেশ আর জাতীয়তাবাদী আবেগকে উস্কে মার্কিন নির্বাচনে ‘ট্রাম্প’ করলেন ডোনাল্ড। আমেরিকার বুথ ফেরত সমীক্ষা বলছে, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্তদের ভোটই ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজের রাস্তা দেখিয়েছে। সেই বিচারে ভারতীয় সম্প্রদায়ের ভোটেও থাবা বসিয়েছেন ট্রাম্প। একটি সূত্রের এমনও দাবি, ভারতীয় ভোটারদের মধ্যে কমবেশি 60 শতাংশই ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে।
চার বছর ধরে বাইডেনের ডেপুটি হিসেবে কাজ করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদের যোগ্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন কমলা। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যা যা কাজ করেছেন, তার ভিত্তিতেই নির্বাচনে জিততে চেয়েছিলেন। বাস্তবে দেখা গেল গত চার বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাই তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াল। মার্কিন অর্থনীতির উপর করোনার প্রভাব এতদিন পরেও চোখে পড়ার মতো। অনুপ্রবেশের মতো সমস্যারও কোনও উপযুক্ত সমাধান হয়নি। এসবই হ্যারিসের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।
এবারের নির্বাচনের প্রচারে গর্ভপাতকে সামনে রেখে ঝড় তুলতে চেয়েছিলেন কমলা। কম বয়সি মহিলাদের মধ্যে এই প্রচার দাগও কেটেছিল। তবে তার প্রভাব ব্যাপক হল না। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকে। কিন্তু চূড়ান্ত ফল হ্যারিসকে অবশ্যই হতাশ করেছে। এই পরাজয় থেকে স্পষ্ট যে ডোনাল্ডকে ‘ট্রাম্প’ করার মতো কোনও মহামন্ত্র তাঁর জানা ছিল না।
কী হল, কেন হল ?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভিবাসন এবং অর্থনীতি - এই দুটি বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন ট্রাম্প। মেক্সিকোর মতো দেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে আমেরিকার নাগরিকদের চাকরির নিশ্চয়তা ফিরিয়ে আনবেন বলে কথা দিয়েছেন ভোটের প্রচারে।
পাশাপাশি ভোট প্রচার থেকেই তিনি শুল্কনীতিতে পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন। তাঁর দাবি, আমেরিকায় যে সব দেশ ব্যবসা করে তাদের মধ্যে অনেকেই মার্কিন পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন ভারত, চিন থেকে শুরু করে ব্রাজিলের মতো দেশের নাম। ট্রাম্প চান পাল্টা এই সমস্ত দেশ থেকেও বেশি পরিমাণে কর আদায়ের রণনীতি তৈরি করতে।
ট্রাম্প এবং দুই যুদ্ধ
বিশ্বের দুটি প্রান্তে গত দুবছরের বেশি সময় ধরে দুটি যুদ্ধ চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল আর হামাসের যুদ্ধ শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর বেশ কিছু দিন পর থেকে। এখনও থামেনি মৃত্যু-মিছিল। এমনই পরিস্থিতিতে আমেরিকার মসনদে ট্রাম্পেইর ফিরে আসা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রথমত, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ। তাতে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। অস্ত্র থেকে শুরু করে অর্থ, সবই দেদার দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগেই ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি জিতলে এই ধরনের ঘটনায় রাশ টানা হবে। আমেরিকা বিশ্বের অন্য প্রান্তে যুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে বা যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেয় এমনটা চান না ট্রাম্প।
অন্যদিকে, আমেরিকার পুরনো বন্ধু ইজরায়েল। ট্রাম্প জেতায় খুশি জেরুজালেমও। তবে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক তেমন মধুর নয়। তাই হামাসের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের আক্রমণাত্মক ভূমিকা নয়া মার্কিন প্রশাসন কীভাবে দেখবে, তা নিয়ে গোটা দুনিয়াই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। পাশাপাশি ইউক্রেনকে আমেরিকা যদি সাহায্য বন্ধ করে তাহলে রাশিয়া কী অবস্থান নেবে সেটাও কোটি টাকার প্রশ্ন।
ভারতীয়দের ভালো ফল
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতীয়দের ফল ভালোই হয়েছে। হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন 6 ভারতীয় বংশোদ্ভুত। এই নির্বাচনের আগে পর্যন্ত হাউজে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল 5। এবারে তা বেড়েছে ।
এর মধ্যে ভারতীয়-আমেরিকান আইনজীবী সুহাস সুব্রহ্মণ্যম ইতিহাস গড়েছেন ৷ ভার্জিনিয়া এবং গোটা ইস্ট কোস্ট বা মার্কিন পূর্ব উপকূল থেকে তিনিই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যিনি রিপাবলিকান প্রার্থী মাইক ক্ল্যানসিকে পরাজিত করে হাউজ রিপ্রেজেন্টেটিভে নির্বাচিত হয়েছেন ৷ এর পাশাপাশি রো খান্না, শ্রী থানেদার, রাজা কৃষ্ণমূর্তির মতো প্রার্থীরা আবারও নির্বাচিত হয়েছেন। আমেরিকার কংগ্রেসে ডাঃ অ্যামি বেরা সবচেয়ে প্রবীণ ভারতীয়-আমেরিকান৷ তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন৷ এই নিয়ে পরপর সাত বার জয়ী হলেন অ্য়ামি ৷
দ্য বং কানেকশন
এবার আমেরিকায় ভোট দেওয়া গিয়েছে বাংলা ভাষাতেও। নিউইয়র্কের ব্যালট ছাপা হয়েছিল বাংলায় ৷ আমেরিকার সমস্ত প্রদেশেই আগাম ভোটদানের ব্যবস্থা রয়েছে ৷ একে বলা হয় ‘আর্লি ভোটিং’ ৷ নিউইয়র্কে আগাম ভোট দিতে গিয়ে ভোটাররা দেখেন, অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলাতেও ব্যালট ছাপা হয়েছে ৷ নগর পরিকল্পনা বিভাগ জানায়, নিউইয়র্কের বাসিন্দারা 200টিরও বেশি ভাষায় কথা বলেন ৷ আর তাই ব্যালট পেপারে ইংরেজি ছাড়াও আরও চারটি ভাষা ছিল । জায়গা করে নিয়েছিল বাংলা, চাইনিজ, স্প্যানিশ ও কোরিয়ান ভাষা ৷
আর কবে…
সমাজ বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, কোনও উদারনৈতিক সমাজ কেমন হবে তার উদাহরণ আমেরিকা। অর্থনীতির প্রশ্নেও আমেরিকা সুপার পাওয়ার। কার্ল মার্কস মনে করতেন একটি সমাজের বৌদ্ধিক উন্নতি নির্ভর করে সেখানকার মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমেরিকা এখনও আধুনিক মানসিকতা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। দুবার দুই মহিলাকে পরাজিত করে হোয়াইট হাউজের বাসিন্দা হয়েছেন ট্রাম্প। এখানেই প্রশ্ন, আর কবে নিজেদের রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে কোন মহিলাকে নির্বাচিত করবেন আমেরিকানরা? উত্তর 2024 সালেও অধরা থেকে গেল।