ETV Bharat / health

দায়িত্ব-প্রত্যাশার চাপে স্যান্ডউইচ হচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী, কী বলছেন মনোবিদরা ? - Sandwich Generation - SANDWICH GENERATION

Sandwich Generation Psychology: অফিস, সংসার, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের চাপে পড়েননি এমন স্বামী-স্ত্রী বা পরিবার খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল । অনেকে এই সংসার সামলাতে গিয়ে স্বপ্ন ছেড়েছেন, কেউ আবার সংসার সামলানোর দায়িত্ব থেকেই মুক্তি চেয়েছেন । স্বামী-স্ত্রী যেই হোন না কেন, আসলে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তাঁদেরকে স্যান্ডউইচ হতেই হয় । প্রত্যাশা আর সামর্থ্যের দোটানায় পিষতে থাকেন দু'জনেই । সমস্যাটা কত গভীরে ? তল খোঁজার চেষ্টা করল ইটিভি ভারত।

Sandwich Generation
স্যান্ডউইচ জেনারেশন (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Jun 16, 2024, 6:19 PM IST

Updated : Jun 16, 2024, 7:24 PM IST

হায়দরাবাদ, 16 জুন: তাঁর নাম নীলাঞ্জনা (নাম অপরিবর্তিত) । আর পাঁচটা দিনের মতোই এদিন নীলাঞ্জনা উঠেই সন্তানের স্কুলের টিফিন তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । আটটা বাজলেই শ্বশুরকে চা দিতে হবে । শ্বাশুড়ি বেশ কিছু সময় ধরে শয্যাশায়ী । তাঁর আলাদা করে খেয়াল রাখতে হয় । স্বামী দীপাঞ্জন (নাম অপরিবর্তিত) আবার 10টার মধ্যে খেয়ে অফিস বেরবেন । তাঁর খাবারটাও এই সময়ের মধ্যে তৈরি করতে হয় । এইভাবেই সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল থেকে রাত ।

একই রুটিনের জাঁতাকলে রোজ নিজেকে একটু একটু করে নিংড়ে দিচ্ছেন নীলাঞ্জনা । দীপাঞ্জনের সঙ্গে আর সেইভাবে কথাও হয় না তাঁর ৷ সাংসারিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁরা যে শেষ কবে একসঙ্গে বসে আড্ডা মেরেছেন, মন খুলে কথা বলেছেন, তা ভুলে গিয়েছেন নীলা । উলটে এখন বিরক্তিভাব, ঝগড়া, অসহিষ্ণুতা দু'জনের মধ্যে অ-দেখা পাঁচিল তুলে দিয়েছে । কী করে দীপাঞ্জনকে বোঝাবে সারাটা দিন সংসার-সন্তান সামলে, দায়িত্ব আর কতর্ব্যের মাঝে পড়ে প্রতিনিয়ত পাঁউরুটির ভিতরে থাকা মশলার মতো তিনি যেন স্যান্ডউউচ হয়ে যাচ্ছেন ।

মাঝে মধ্যে তাঁর মনে হয় এই যান্ত্রিক জীবনে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় কোথাও। কিন্তু পারে না ৷ রাগ-দুঃখ-কষ্ট সবই উত্থাল সমুদ্রের মতো মনের ভিতরেই আছড়ে পড়ে । এর থেকে বেরনোর আদৌ কী কোনও উপায় হয় ? নাকি, এমনভাবে চলাটাই জীবন?

মনোবিদ কেদাররঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, নীলাঞ্জনার মতো এই সমস্যা তো আসলে অনেকেরই । ছবিটা একেকটা পরিবারে একেক রকম হতে পারে ৷ আজকে একটা মেয়ে, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছেন । সেই মেয়েটিকে তাঁর নিজের বাবা-মায়েরও খেয়াল রাখতে হয় । তার মানে, দু'টি বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে প্লাস স্বামীর সবসময়ের খেয়ালের দায়িত্ব ওই মেয়েটির উপরে ৷ ফলে তাঁদের কষ্টটা অনেক বেশি ।

কেদাররঞ্জন বলেন, "আসলে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে স্যান্ডউইচ জেনারেশন বলে ৷ যা চলে আসছে বহু বছর ধরে । আমরা তখন বুঝতে পারিনি কারণ, ঠাকুমা-ঠাকুরদা, জ্যাঠামশাই-কাকা, পিসি, মেসো নিয়ে আমাদের জেনারেশন এগিয়েছে ৷ এখন যেটা নিউক্লিয়ার পরিবারে নেই । তখন সংসারের কাজ ভাগাভাগি হয়ে যেত ৷ এখন নিউক্লিয়ার পরিবারে সেটাই বড় চাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে । তাই সাইকোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দেয় ৷ অ্যাংজাইটি দেখা দেয় বেশি ।"

অর্থাৎ সন্তানের পড়াশোনা থেকে বাবা-মায়ের শরীর ভালো আছে কি না, এই নিয়ে মনের মধ্যে অনবরত চিন্তা চলাটা স্বাভাবিক । কিন্তু সেটাকে যদি কঠিন দায়িত্ব হিসেবে আগে থেকেই ভেবে নেওয়া হয়, সেখানে শুরু হয় আসল সমস্যা । কেন আমি একা করব, একা ভাবব, একা দায়িত্ব নেব- এইসব প্রশ্ন ওঠে ৷ যার ফলে দেখা দেয় অবসাদ । রাতে ঘুম চলে যায় ৷ সংসারে রোজ অশান্তি হতে থাকে ৷ হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় । কাউকে মনের কথা বুঝিয়ে বলা যায় না । বললেও হয়তো সে বোঝে না । মানিয়ে নিতে বলেন ।

তবে এমনটা হলে একজন মনোবিদের কাছে যেতে অসুবিধে কোথায় ? লোকে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে বলবে এই ভেবে? জীবনটা তো নিজের ৷ সেটা পুরোপুরি সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার সকলের রয়েছে । মনের কষ্ট যদি কারও কাছে বলে হালকা হওয়া যায়, যদি তিনি সমস্যা থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাতে পারেন, বা তা সামলানোর উপায় বলে দিতে পারেন, তাহলে কেন যাব না ?

তবে সমস্যাটা তো শুধু নীলাঞ্জনার একার নয় । দীপাঞ্জনও অফিসে গাধার মতো খেটে চলেছেন সংসারের খরচ, ওষুধের খরচ, নীলাঞ্জনার বাবা-মায়ের একটা দায়িত্ববোধ, সন্তানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-টিউশন ইত্যাদি খরচ সামলাতে গিয়ে মাসের শেষে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে । মাঝেমধ্যে অফিসের অতিরিক্ত কাজ বসের কথায় বাড়ি নিয়ে গিয়ে করতে হচ্ছে ৷ ফলে নীলাঞ্জনা বারবার বললেও সন্তানের একটু পড়া দেখা, মায়ের যত্ন করা বা সংসারের কাজে সাহায্য করতে পারেন না তিনি ।

আবার অফিস থেকে ফিরে দীপাঞ্জন এতটাই ক্লান্ত থাকেন যে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না । বরং ফোনের অপর প্রান্তে কোনও বন্ধুর সঙ্গে সাংসারিক কথা ছাড়া অন্য কথা বললে একটু হলকাবোধ করেন তিনি ৷ অনেকেই ভাবতে পারেন নীলাঞ্জনাকে অবহেলা করছেন তিনি ? কিন্তু সংসারের সবাইকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তিনিও যে স্যান্ডউইচ হচ্ছেন, তা কাকে বোঝাবেন দীপাঞ্জন ?

উডল্যান্ডের মনোবিদ সব্যসাচী মিত্রের মতে, জীবনে চাওয়ার কোনও শেষ থাকে না । সেটারও একটা সীমা টানতে হয় । বুঝতে হয়, কোনটা প্রয়োজন আর কতটা প্রয়োজন ৷ স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই চাকরি করলে অফিস-সংসারে ব্যালেন্স আনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন । আবার স্বামী টাকা রোজগারের দিকে বেশি নজর দিলে, সেখানেও সংসারে কাউকে সময় দিতে না পারার অভিযোগে অশান্তির মধ্যে পড়ছেন । এখান থেকেই দানা বাঁধছে অবসাদ বা ডিপ্রেশন । আসছে উদ্বিগ্নতা ও এক্সট্রা ম্যারাইটাল অ্যাফেয়ারের প্রবণতা। এক্ষেত্রে দীপাঞ্জনের মতো মানুষেরা যে ভুলটা করেন, তা হল অফিসের কাজ বাড়িতে নিয়ে আসেন । কোথাও সবকিছুর একটা সীমারেখা টানা উচিত । সেটাই দীপাঞ্জনের মতো মানুষ ভুলে যান ।

জীবনে টাকা ছাড়া চলা যায় না, সেটা যেমন বাস্তব, ততটাই বাস্তব পরিবার-বন্ধু ছাড়া সেই জীবন রোবট ছাড়া আর কিছু হবে না । প্রচুর অর্থ রোজগারের পর যদি দিনের শেষে মনে সেই শান্তিটাই না থাকে, তাহলে সেই টাকা কী কাজে লাগবে ? এক্ষেত্রে উপায় কী ? মনোবিদ সব্যসাচীর বক্তব্য, “অফিস থেকে ফিরে যে সময়টা ফোন দেখে বা টিভি দেখে কাটাচ্ছি, সেটাই পরিবারকে দেব । ক্লান্তি তো সারাদিন বাড়ির কাজে ব্য়স্ত থাকা স্ত্রীরও হয় ৷ তবে হাতে-হাতে কাজ করলে সেটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় । ফলে স্ত্রীর সঙ্গে অনায়াসে সময় কাটানো যায় । তিনিও খিটখিটে মেজাজের হবেন না । গল্প করা, নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলা, সিনেমা দেখা ইত্যাদি একসঙ্গে করাই যায় । জীবনে চলার পথে প্রতিটা জিনিসের জন্য একটা দাম দিতেই হয় । প্রত্যাশা ততটাই রাখা ভালো যতটা অ্যাচিভ করা সম্ভব ।”

বাবা-মায়ের এই সমস্যা কী সন্তানের উপর কোনও প্রভাব ফেলে?

মনোবিদ সব্যসাচী মিত্রের মতে, আসলে হাজারো নীলাঞ্জন-দীপাঞ্জনের মতো মানুষের সমস্যার বীজ অজান্তেই তাঁদের সন্তানের মধ্যে বপণ করে দিচ্ছেন ৷ বাবা-মায়ের ব্যবহার সন্তানের বিকাশে পজিটিভ-নেগেটিভ প্রভাব পড়ে । মনোবিদদের ভাষায় একে ‘লার্নট বিহেভিয়ার’ বলে ৷ বাবা-মা যদি অবসাদ, চিন্তা ইত্যাদির অতিরিক্ত মদ্যপান করেন, ধূমপান করেন, কথায় কথায় রেগে যান, ঝগড়া করেন, নিজেকে অবহেলা করেন ইত্যাদি দেখে সন্তান এটাই শেখে ৷ অতিরিক্ত চিন্তা হলে, অবসাদ হলে এমন ব্যবহার করাটাই স্বাভাবিক ।

কীরকম সেটা ? তাঁদের মনে হয় বাবা-মা ভালো মানুষ, সকলকে ভালো রাখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না । ফলে সেই সন্তান ডিইএনকে জেনারেশনের (ডাবল ইঞ্জিন নো কিড জেনারেশন) মধ্যে পড়ে যায় । অর্থাৎ সন্তান-সংসার সামলাতে যদি এত চাপ হয়, তাহলে তার থেকে দূরে থাকাই ভালো । কিংবা দায়িত্ব নিতে গিয়ে যদি এমন মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয় তাহলে বিয়ে না করাই ভালো । এই ধরনের মনোভাব সমাজে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলছে । তাঁরা ঠিকই করে নিচ্ছেন, লিভ ইন রিলেশনে থাকব, কিন্তু বাচ্চা থাকবে না । না কোনও দায়িত্ব থাকবে, না কোনও কতর্ব্য । আসলে বাবা-মা যে স্যান্ডউইচ জেনারেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, সেই গতিপথ নিজেরা মিলে মসৃণ না করে তুললে, তা সন্তানের উপর তথা সমাজের উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য ।

হায়দরাবাদ, 16 জুন: তাঁর নাম নীলাঞ্জনা (নাম অপরিবর্তিত) । আর পাঁচটা দিনের মতোই এদিন নীলাঞ্জনা উঠেই সন্তানের স্কুলের টিফিন তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । আটটা বাজলেই শ্বশুরকে চা দিতে হবে । শ্বাশুড়ি বেশ কিছু সময় ধরে শয্যাশায়ী । তাঁর আলাদা করে খেয়াল রাখতে হয় । স্বামী দীপাঞ্জন (নাম অপরিবর্তিত) আবার 10টার মধ্যে খেয়ে অফিস বেরবেন । তাঁর খাবারটাও এই সময়ের মধ্যে তৈরি করতে হয় । এইভাবেই সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল থেকে রাত ।

একই রুটিনের জাঁতাকলে রোজ নিজেকে একটু একটু করে নিংড়ে দিচ্ছেন নীলাঞ্জনা । দীপাঞ্জনের সঙ্গে আর সেইভাবে কথাও হয় না তাঁর ৷ সাংসারিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁরা যে শেষ কবে একসঙ্গে বসে আড্ডা মেরেছেন, মন খুলে কথা বলেছেন, তা ভুলে গিয়েছেন নীলা । উলটে এখন বিরক্তিভাব, ঝগড়া, অসহিষ্ণুতা দু'জনের মধ্যে অ-দেখা পাঁচিল তুলে দিয়েছে । কী করে দীপাঞ্জনকে বোঝাবে সারাটা দিন সংসার-সন্তান সামলে, দায়িত্ব আর কতর্ব্যের মাঝে পড়ে প্রতিনিয়ত পাঁউরুটির ভিতরে থাকা মশলার মতো তিনি যেন স্যান্ডউউচ হয়ে যাচ্ছেন ।

মাঝে মধ্যে তাঁর মনে হয় এই যান্ত্রিক জীবনে সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় কোথাও। কিন্তু পারে না ৷ রাগ-দুঃখ-কষ্ট সবই উত্থাল সমুদ্রের মতো মনের ভিতরেই আছড়ে পড়ে । এর থেকে বেরনোর আদৌ কী কোনও উপায় হয় ? নাকি, এমনভাবে চলাটাই জীবন?

মনোবিদ কেদাররঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, নীলাঞ্জনার মতো এই সমস্যা তো আসলে অনেকেরই । ছবিটা একেকটা পরিবারে একেক রকম হতে পারে ৷ আজকে একটা মেয়ে, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছেন । সেই মেয়েটিকে তাঁর নিজের বাবা-মায়েরও খেয়াল রাখতে হয় । তার মানে, দু'টি বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে প্লাস স্বামীর সবসময়ের খেয়ালের দায়িত্ব ওই মেয়েটির উপরে ৷ ফলে তাঁদের কষ্টটা অনেক বেশি ।

কেদাররঞ্জন বলেন, "আসলে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে স্যান্ডউইচ জেনারেশন বলে ৷ যা চলে আসছে বহু বছর ধরে । আমরা তখন বুঝতে পারিনি কারণ, ঠাকুমা-ঠাকুরদা, জ্যাঠামশাই-কাকা, পিসি, মেসো নিয়ে আমাদের জেনারেশন এগিয়েছে ৷ এখন যেটা নিউক্লিয়ার পরিবারে নেই । তখন সংসারের কাজ ভাগাভাগি হয়ে যেত ৷ এখন নিউক্লিয়ার পরিবারে সেটাই বড় চাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে । তাই সাইকোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দেয় ৷ অ্যাংজাইটি দেখা দেয় বেশি ।"

অর্থাৎ সন্তানের পড়াশোনা থেকে বাবা-মায়ের শরীর ভালো আছে কি না, এই নিয়ে মনের মধ্যে অনবরত চিন্তা চলাটা স্বাভাবিক । কিন্তু সেটাকে যদি কঠিন দায়িত্ব হিসেবে আগে থেকেই ভেবে নেওয়া হয়, সেখানে শুরু হয় আসল সমস্যা । কেন আমি একা করব, একা ভাবব, একা দায়িত্ব নেব- এইসব প্রশ্ন ওঠে ৷ যার ফলে দেখা দেয় অবসাদ । রাতে ঘুম চলে যায় ৷ সংসারে রোজ অশান্তি হতে থাকে ৷ হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় । কাউকে মনের কথা বুঝিয়ে বলা যায় না । বললেও হয়তো সে বোঝে না । মানিয়ে নিতে বলেন ।

তবে এমনটা হলে একজন মনোবিদের কাছে যেতে অসুবিধে কোথায় ? লোকে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে বলবে এই ভেবে? জীবনটা তো নিজের ৷ সেটা পুরোপুরি সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার সকলের রয়েছে । মনের কষ্ট যদি কারও কাছে বলে হালকা হওয়া যায়, যদি তিনি সমস্যা থেকে মুক্তির রাস্তা দেখাতে পারেন, বা তা সামলানোর উপায় বলে দিতে পারেন, তাহলে কেন যাব না ?

তবে সমস্যাটা তো শুধু নীলাঞ্জনার একার নয় । দীপাঞ্জনও অফিসে গাধার মতো খেটে চলেছেন সংসারের খরচ, ওষুধের খরচ, নীলাঞ্জনার বাবা-মায়ের একটা দায়িত্ববোধ, সন্তানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-টিউশন ইত্যাদি খরচ সামলাতে গিয়ে মাসের শেষে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে । মাঝেমধ্যে অফিসের অতিরিক্ত কাজ বসের কথায় বাড়ি নিয়ে গিয়ে করতে হচ্ছে ৷ ফলে নীলাঞ্জনা বারবার বললেও সন্তানের একটু পড়া দেখা, মায়ের যত্ন করা বা সংসারের কাজে সাহায্য করতে পারেন না তিনি ।

আবার অফিস থেকে ফিরে দীপাঞ্জন এতটাই ক্লান্ত থাকেন যে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না । বরং ফোনের অপর প্রান্তে কোনও বন্ধুর সঙ্গে সাংসারিক কথা ছাড়া অন্য কথা বললে একটু হলকাবোধ করেন তিনি ৷ অনেকেই ভাবতে পারেন নীলাঞ্জনাকে অবহেলা করছেন তিনি ? কিন্তু সংসারের সবাইকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তিনিও যে স্যান্ডউইচ হচ্ছেন, তা কাকে বোঝাবেন দীপাঞ্জন ?

উডল্যান্ডের মনোবিদ সব্যসাচী মিত্রের মতে, জীবনে চাওয়ার কোনও শেষ থাকে না । সেটারও একটা সীমা টানতে হয় । বুঝতে হয়, কোনটা প্রয়োজন আর কতটা প্রয়োজন ৷ স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই চাকরি করলে অফিস-সংসারে ব্যালেন্স আনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন । আবার স্বামী টাকা রোজগারের দিকে বেশি নজর দিলে, সেখানেও সংসারে কাউকে সময় দিতে না পারার অভিযোগে অশান্তির মধ্যে পড়ছেন । এখান থেকেই দানা বাঁধছে অবসাদ বা ডিপ্রেশন । আসছে উদ্বিগ্নতা ও এক্সট্রা ম্যারাইটাল অ্যাফেয়ারের প্রবণতা। এক্ষেত্রে দীপাঞ্জনের মতো মানুষেরা যে ভুলটা করেন, তা হল অফিসের কাজ বাড়িতে নিয়ে আসেন । কোথাও সবকিছুর একটা সীমারেখা টানা উচিত । সেটাই দীপাঞ্জনের মতো মানুষ ভুলে যান ।

জীবনে টাকা ছাড়া চলা যায় না, সেটা যেমন বাস্তব, ততটাই বাস্তব পরিবার-বন্ধু ছাড়া সেই জীবন রোবট ছাড়া আর কিছু হবে না । প্রচুর অর্থ রোজগারের পর যদি দিনের শেষে মনে সেই শান্তিটাই না থাকে, তাহলে সেই টাকা কী কাজে লাগবে ? এক্ষেত্রে উপায় কী ? মনোবিদ সব্যসাচীর বক্তব্য, “অফিস থেকে ফিরে যে সময়টা ফোন দেখে বা টিভি দেখে কাটাচ্ছি, সেটাই পরিবারকে দেব । ক্লান্তি তো সারাদিন বাড়ির কাজে ব্য়স্ত থাকা স্ত্রীরও হয় ৷ তবে হাতে-হাতে কাজ করলে সেটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় । ফলে স্ত্রীর সঙ্গে অনায়াসে সময় কাটানো যায় । তিনিও খিটখিটে মেজাজের হবেন না । গল্প করা, নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলা, সিনেমা দেখা ইত্যাদি একসঙ্গে করাই যায় । জীবনে চলার পথে প্রতিটা জিনিসের জন্য একটা দাম দিতেই হয় । প্রত্যাশা ততটাই রাখা ভালো যতটা অ্যাচিভ করা সম্ভব ।”

বাবা-মায়ের এই সমস্যা কী সন্তানের উপর কোনও প্রভাব ফেলে?

মনোবিদ সব্যসাচী মিত্রের মতে, আসলে হাজারো নীলাঞ্জন-দীপাঞ্জনের মতো মানুষের সমস্যার বীজ অজান্তেই তাঁদের সন্তানের মধ্যে বপণ করে দিচ্ছেন ৷ বাবা-মায়ের ব্যবহার সন্তানের বিকাশে পজিটিভ-নেগেটিভ প্রভাব পড়ে । মনোবিদদের ভাষায় একে ‘লার্নট বিহেভিয়ার’ বলে ৷ বাবা-মা যদি অবসাদ, চিন্তা ইত্যাদির অতিরিক্ত মদ্যপান করেন, ধূমপান করেন, কথায় কথায় রেগে যান, ঝগড়া করেন, নিজেকে অবহেলা করেন ইত্যাদি দেখে সন্তান এটাই শেখে ৷ অতিরিক্ত চিন্তা হলে, অবসাদ হলে এমন ব্যবহার করাটাই স্বাভাবিক ।

কীরকম সেটা ? তাঁদের মনে হয় বাবা-মা ভালো মানুষ, সকলকে ভালো রাখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না । ফলে সেই সন্তান ডিইএনকে জেনারেশনের (ডাবল ইঞ্জিন নো কিড জেনারেশন) মধ্যে পড়ে যায় । অর্থাৎ সন্তান-সংসার সামলাতে যদি এত চাপ হয়, তাহলে তার থেকে দূরে থাকাই ভালো । কিংবা দায়িত্ব নিতে গিয়ে যদি এমন মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয় তাহলে বিয়ে না করাই ভালো । এই ধরনের মনোভাব সমাজে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলছে । তাঁরা ঠিকই করে নিচ্ছেন, লিভ ইন রিলেশনে থাকব, কিন্তু বাচ্চা থাকবে না । না কোনও দায়িত্ব থাকবে, না কোনও কতর্ব্য । আসলে বাবা-মা যে স্যান্ডউইচ জেনারেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, সেই গতিপথ নিজেরা মিলে মসৃণ না করে তুললে, তা সন্তানের উপর তথা সমাজের উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য ।

Last Updated : Jun 16, 2024, 7:24 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.