ত্বকে ছোটোখাটো প্রদাহ এবং ফুসকুড়ি খুবই সাধারণ বিষয় । তবে, যদি ত্বকে সাদা দাগ হয়, লাল হয়ে ফুলে যায় আর তা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়, তাহলে এই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের । এই ধরনের অবস্থাকে বলা হয় সোরিয়োসিস । যা ত্বকের সমস্যা হিসেবে পরিচিত । এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা । তাই এই বিষয়টি নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করতে প্রতি বছর 29 অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব সোরিয়োসিস দিবস । সারা বিশ্বের প্রায় 130 মিলিয়ন মানুষ সোরিয়োসিস ও সোরিয়াটিক আর্থারাইটিসে আক্রান্ত হয় । এই বছর এই দিনটির থিম হল ‘জানানো’ ।
সোরিয়োসিস কী ?
জাতীয় সোরিয়োসিস প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘‘সোরিয়োসিস হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত একটি রোগ, যা শরীরে প্রদাহ তৈরি করে । ত্বক ফুলে যাওয়া বা দাগ হয়ে যাওয়া হল এই প্রদাহের প্রকাশ্য সংকেত । রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ত্বকের কোষের বৃদ্ধির গতি বাড়ার ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে । সাধারণত ত্বকের কোশে এক মাস সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে আবার শেষও হয়ে যায় । সোরিয়োসিস হলে এই ঘটনাটিই তিন বা চার দিনের মধ্যেই হয়ে যায় । শেষ হয়ে যাওয়ার বদলে ত্বকের কোষগুলি এক জায়গায় জড়ো হতে থাকে । ফুলে যাওয়া বা দাগ হওয়া শরীরের যে কোনও অংশেই হতে পারে । যদিও এটা সাধারণত কনুই, হাঁটু ও মাথার ত্বকে দেখা যায় ।’’
সোরিয়োসিসের ফলে প্রদাহের জেরে শরীরের অন্য অংশও প্রভাবিত হতে পারে । আর এর থেকে সোরিয়াটিক আর্থারাইটিসও হতে পারে । যাঁদের সোরিয়োসিস হয়, তাঁদের তিন জনের মধ্যে এক জনের এই সমস্যা সোরিয়াটিক আর্থারাইটিসে পরিণত হতে পারে । এর ফলে জয়েন্টে শক্ত ভাব ও ফুলে যাওয়ার সমস্যা তৈরি হতে পারে ।
সোরিয়োসিস যে কোনও লিঙ্গের, যে কোনও বয়সের অথবা যে কোনও জাতির মানুষকে আক্রমণ করতে পারে । তবে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় । সোরিয়োসিস সংক্রামক নয় । তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা হলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
এর কারণ কী ?
ত্বকের সমস্যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত বলেই জানা যায় । তবে এর সঙ্গে জেনেটিক্সেরও যোগ রয়েছে । যার অর্থ এর সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক থাকতে পারে । দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ সোরিয়োসিস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে যে যাঁদের সোরিয়োসিস হয়, তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ‘আচমকা বৃদ্ধি পায়’ । এর ফলে ত্বকের কোশগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে । দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকা কোশগুলি এক জায়গায় ত্বকের উপরে জড়ো হয় । এর থেকেই একটা ক্ষতস্থান তৈরি হয় ।
সোরিয়োসিসের প্রকারভেদ
শরীরের বিভিন্ন অংশে নানা রকমের সোরিয়োসিস হতে দেখা যায় । শরীরের এমন কিছু জায়গা আছে, যেমন – যৌনাঙ্গ, হাত, পা ও নখ, মুখ, মাথার ত্বক ও ত্বকের ভাঁজে এটা হতে দেখা যায় ।
- গুটেট সোরিয়োসিস
যে সমস্ত মানুষ সোরিয়োসিসে আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে 8 শতাংশ এই গুটেট সোরিয়োসিসে আক্রান্ত হন । প্রদাহের কারণে ছোট, গোলাকার ও লাল রঙের জায়গা ত্বকে তৈরি হওয়া গুটেট সোরিয়োসিসের চিহ্ন । গুটেট সোরিয়োসিস সাধারণত হাত, পা ও কাঁধে দেখা যায় । তবে এটা শরীরের যে কোনও অংশেই আক্রমণ করতে পারে ।
- পোস্চুলার সোরিয়োসিস
যে সমস্ত মানুষ সোরিয়োসিসে আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে 3 শতাংশের শরীরে এই পোস্চুলার সোরিয়োসিস দেখা যায় । এর লক্ষণ হল ত্বকের প্রদাহ বা লাল অংশে পোস্চুল (সাদা পুঁজ যুক্ত ফোলা অংশ) তৈরি হওয়া । পোস্চুলার সোরিয়োসিস শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশে দেখা যায় । তার মধ্যে রয়েছে হাত বা পায়ের মতো PPP অথবা শরীরের বেশিরভাগ অংশ ।
- প্লাক সোরিয়োসিস
প্লাক সোরিয়োসিস সবচেয়ে বেশি দেখা যায় । যাঁরা সোরিয়োসিসে আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে 80 শতাংশের মধ্যে এই ধরনের সোরিয়োসিস দেখা যায় । প্রদাহ থেকে হওয়া দাগ, ত্বকে চুলকানি যুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক দাগের মতো প্লাকও শরীরের যে কোনও অংশ হতে পারে । কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ত্বকের রং লাল হয়ে যায় । সঙ্গে দেখা যায় রূপোলি সাদা রঙের দাগ । আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্লাকের রং বেগুনি হয় । এটা ব্যক্তি বিশেষের ত্বকের ধরনের উপর নির্ভর করে । এই ধরনের প্লাক সাধারণত মাথার ত্বক, হাঁটু, কনুই এবং পেটের নিচের দিক ও আশপাশে দেখা যায় । এই ধরনের পিঠের নিচের দিকে ও তার আশপাশেও দেখা যায় এই ধরনের প্লাক । তবে এটা শরীরের যে কোনও অংশেই আক্রমণ করতে পারে ।
- ইনভার্স সোরিয়োসিস
যে সমস্ত মানুষ সোরিয়োসিসের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে এক চতুর্থাংশ এই ইনভার্স সোরিয়োসিসে আক্রান্ত হন । ইনভার্স সোরিয়োসিসের লক্ষণ হল একেবারে লাল রঙের মসৃণ ত্বক । যাতে কোনও দাগ থাকে না । ইনভার্স সোরিয়োসিস সাধারণ সেই সব জায়গায় দেখা যায়, যেখানে ত্বক ভাঁজ হয় । যেমন – বগলে, স্তনের নিচে, যৌনাঙ্গের আশপাশে ও নিতম্বে । এই ক্ষেত্রে খুবই চুলকানি হয় । আবার যন্ত্রণাও হয় । ওই জায়াগাগুলিতে ঘষাঘষি করলে বা ঘাম হলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে ।
- এরিথ্রোডার্মিক সোরিয়োসিস
যে সমস্ত মানুষ সোরিয়োসিসে ভোগেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র 2 শতাংশ এই এরিথ্রোডার্মিক সোরিয়োসিসে আক্রান্ত । এই রোগকে বিরলই বলা চলে । এই ধরনের সোরিয়োসিসের ক্ষেত্রে ত্বকে গাঢ় লাল রং হয়ে যায় । আর ত্বকের উপর বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে কালচে হয়ে যায় । এটা সাধারণত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । আর এটা জীবন ঘাতকও হতে পারে । এছাড়া আর যে লক্ষণগুলি মারাত্মক চুলকানি, যন্ত্রণা, হৃদযন্ত্রের গতি ও শরীরের তাপমাত্রায় পরিবর্তন, শরীরের জলের অভাব এবং নখে বদল । এরিথ্রোডার্মিকের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা দ্রুত করা দরকার ।
চিকিৎসা
সোরিয়োসিস হল আসলে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা । কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সাহায্যে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে । যদিও পুরোপুরি নিরাময় হবে, এমন কোনও চিকিৎসা সোরিয়োসিসের ক্ষেত্রে নেই । একবার ধরা পড়লে এর লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে । এই রোগের চিকিৎসায় অনেক সময় টপিক্যাল ক্রিম, লাইট থেরাপি ও ওষুধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয় । তবে পুরোটাই নির্ভর করে লক্ষণ ও কতটা খারাপ অবস্থা তার উপর । চিকিৎসা হয় একটি মাত্র পদ্ধতিতে হয় । অথবা দু’টোর সংমিশ্রণে করা হয় ।
ফলে সোরিয়োসিস যদি আগে ধরা পড়ে, তাহলে এটা আরও খারাপ হওয়া থেকে আটকানো যেতে পারে । আর কতগুলি জিনিসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যা থেকে সোরিয়োসিস হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে । সেগুলির মধ্যে রয়েছে মানসিক চাপ, মদ্যপান, খাবার, অল্যার্জি প্রভৃতি । সমস্যা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ত্বকের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।