করোনা এবং ওমিক্রনের বাড়বাড়ন্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই অ্যান্টিবডি বিষয়ে ফের একবার আলোচনা শুরু হয়েছে ৷ কিন্তু বিজ্ঞানীরাও এবিষয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে অ্যান্টিবডি কেন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না ? এত তাড়াতাড়ি যাতে অ্যান্টিবডি নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য কি কোনও উপায় করা সম্ভব ? গবেষকদের মতে, সম্ভবত টি সেল ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবডিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব ৷ ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপিকা সিনা কুরিকস্য়াঙ্কের একটি ভাষণে জানা গিয়েছে, কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে টি সেল (T cells can be of help to level up immunity against covid ) ৷
কেন টি সেল ভ্যাকসিন দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে:
অ্য়ান্টিবডি মূলত কোষগুলিকে ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর কাজ করে ৷ অর্থাৎ কোভিডের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে ৷ আর সেই কারণেই কিছু কিছু দেশে কোভিডের এই নতুন ঢেউ আসার পর অ্যান্টিবডি বুস্ট আপ করা নিয়ে রীতিমত প্রচার শুরু হয়েছে ৷ কিন্তু এখানে একটি বড় সমস্যা রয়েছে ৷ কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করা এই অ্যান্টিবডিগুলি বেশি দিন স্থায়ী হয় না এবং সেই কারণেই বুস্টারের কথা চিন্তা করতে হচ্ছে বিজ্ঞানীদের ৷ একদিকে যেমন এই তৃতীয় ডোজটি কোভিডকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা থেকে আটকায়, তেমনি ফাইজার ভ্যাকসিনের এই ডোজ নেওয়ার দশ সপ্তাহের মধ্যেই যে কোনও ব্যক্তির করোনার যে কোনও রকম উপসর্গে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাও 75 শতাংশ থেকে কমে 45 শতাংশ হয়ে যায় ৷
কিন্তু যদি কোভিডের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে হয় তাহলে এবার বোধহয় টি সেল নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসে গিয়েছে ৷ কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি জটিল প্রক্রিয়ার একটি অংশ মাত্র ৷
বিভিন্ন প্রতিরোধকারী কোষগুলি কিভাবে কাজ করে :
যখন শরীর ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে শ্বেত রক্তকনিকা বা লিম্ফোসাইটিস ৷ যা মূলত দুটি প্রকার বি সেল এবং টি সেল ৷ বি সেল প্রধানত অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেসময় টি সেল হয়, বি সেলকে তার কাজে সাহায্য করে আর নয়ত নিজেই 'যোদ্ধা কোষ' হিসাবে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই শুরু করে ৷ কিছু টি সেল এবং বি সেল আবার মেমরি সেল বা স্মৃতিধারক কোষেও পরিণত হয় ৷ যা মনে রাখে কি করে ভাইরাসের প্রতিরোধ গড়ে তোলা হল, যাতে ফের কখনও শরীর আক্রান্ত হলে একই ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় ৷ বি কোষ এবং টি কোষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভাইরাসটিকে দেখে ৷ সাধারণ ভাবে বলতে গেলে বি কোষ ভাইরাসের বাইরের গঠন, আকার প্রভৃতির দিকে নজর দেয় যাতে সে এমন অ্যান্টিবডির খাঁচা বা জিগস পাজেল তৈরি করতে পারে, যা দিয়ে তাকে বন্দি করে ফেলা যায় ৷ অন্যদিকে টি সেল বা টি কোষ দেখে ভাইরাসের আভ্য়ন্তরীণ গঠন গড়তে কতখানি অ্যামিনো অ্যাসিড কাজে লেগেছে এবং ভাইরাসটির মধ্যে আর কী কী উপাদান আছে সেই সমস্ত কিছু ৷
ভিতরে হোক বা বাইরে সমস্ত ভাইরাসের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট থাকে ৷ একজন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিভিন্ন ধরনের বি সেল এবং টি সেল তৈরি করতে করতেই শেষ হয়ে যায়, যা ভাইরাসের এই নিজস্ব বৈশিষ্টগুলির সঙ্গে লড়াই দিতে পারবে ৷ একে বলা হয় প্রতিক্রিয়ার প্রস্থ, একজন মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রস্থ যদি খুব ভাল হয় সেক্ষেত্রে প্রচুর লিম্ফোসাইট থাকবে যারা সমস্ত বৈশিষ্ট তার অজান্তেই জেনে নিতে পারবে ৷
ওমিক্রন যে এত এত গবেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে, তার প্রধাণ কারণ হল অ্যান্টিবডিগুলি এর যে ব্যাহিক আবরণটিকে অক্রমণ করছে, তা ভীষণভাবে পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত ৷ যার জেরে তা দিনের পর দিন অ্যান্ডিবডিগুলিকে ভীষণ দুর্বল করে দিচ্ছে ৷
কিন্তু যেহেতু টি সেল ভাইরাসের আভ্য়ন্তরীণ গঠনটির দিকেও লক্ষ্য দেয় তাই ওমিক্রন টি কোষকে বোকা বানাতে পারে না ৷ এমনকি এই মুহূর্তে অনেক তথ্যই এটা বলছে যে ভাইরাসের বহিরাঙ্গের রূপ তথা স্পাইক প্রোটিন অতিমারির ফলে এতটাই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে যে, তা অনেকক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির হাতে ধরাই পড়ছে না ৷ টি সেল কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাইরাসের মিউটেশনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে এবং কোভিডের জন্য তৈরি করা টি কোষগুলি অ্যান্টিবডির তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ৷
টি সেল শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে কী :
অন্যান্য ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে টি সেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমরা জানি, এর থেকেই বলা যায় টি সেল শুধু বি সেলকে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য না করে নিজেই 'যোদ্ধা কোষ' হিসাবে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই শুরু করতে পারে ৷ যা ভাইরাসের সব ধরনের রূপান্তরগুলিকে বুঝতে পারবে এবং তার সঙ্গে লড়তে পারবে ৷ টি সেল করোনার বিরুদ্ধে কতখানি কার্যকরী তার প্রমাণ অবশ্য় এখনও জোগাড় করছেন গবেষকরা, তবে এটা পরিষ্কার যে টি সেল কোভিডের বিরুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে ৷
অন্যদিকে বলাই যায় যে টি কোষের প্রতিক্রিয়া দুর্বল হলে ভাইরাসের সংক্রমণ আরও জোরালো হয়ে উঠতে পারে ৷ মারাত্মকভাবে করোনা আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও প্রমাণ মিলেছে যে, তাঁদের টি কোষের প্রতিক্রিয়া ভীষণ দুর্বল ৷ করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও টি কোষের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন কারণ এটি ভাইরাসের বৈশিষ্টগুলিকে চিনতে সক্ষম ৷ এমনকি এই প্রতিক্রিয়ার প্রস্থটিকে পরবর্তীতেও ব্য়বহার করা যেতে পারে ৷
কোভিডের একটি বিটা ভাইরাস হল করোনা ৷ যার মধ্যে সাধারণ সর্দি কাশির সমস্যা তৈরি করা ভাইরাসগুলিরও কিছু কিছু বৈশিষ্ট বর্তমান ৷ যার বিরুদ্ধে টি সেলকে আগেও লড়াই করতে হয়েছে ৷ তাই কোভিডের বিরুদ্ধেও একে কাজে লাগানো যেতেই পারে ৷
আরও পড়ুন :ভেপিং করলে আরও জোরালো হবে করোনার উপসর্গ, বলছে গবেষণা
ভ্য়াকসিনের ক্ষেত্রে কি পরিবর্তন আসতে পারে :
ফাইজার, অ্যাস্ট্রোজেনেকার মত একাধিক ভ্য়াকসিন এতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে লড়াইকেই মুখ্য বলে বিবেচনা করেছে ৷ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষমও হয়েছে ভ্যাকসিনগুলি ৷ তারা টি সেলকেও সহায়ক হিসেবে কাজে লাগিয়েছে ৷ কিন্তু এখন যখন টি কোষ সংক্রান্ত নতুন তথ্য সামনে এসেছে তখন ভ্য়াকসিন স্ট্রাটেজির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতেই পারে ৷ কেবলমাত্র একটি প্রোটিনকে লক্ষ্যবস্তু না করে আরও একটু বিস্তারিত ভাবা যেতে পারে ৷ যা আগামী দিনে কোভিডের বিরুদ্ধে আরও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে ৷ অধ্যাপিকা সিনা কুরিকস্য়াঙ্ক জানিয়েছেন এবিষয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে ৷ ট্রায়ালও চলছে কিছুক্ষেত্রে ৷