হায়দরাবাদ, 24 সেপ্টেম্বর: হাতে গুনে পুজোর বাকি আর মাত্র একটা মাস ৷ তিলোত্তমায় পুজো প্রস্তুতির ব্যস্ততা তুঙ্গে ৷ একদিকে চলছে মণ্ডপ সজ্জার কাজ ৷ অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পুজো-শপিং নিয়ে ৷ পুজোর চারটে দিন নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা লুকে মেলে ধরতে চলছে তারই প্ল্যানিং ৷ অনেকে আবার এই সময় শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝড়াতে হয় ডায়েট শুরু করেছেন নয়তো বা ছুটেছেন জিমে ৷ কিন্তু শুধু জিম বা শুধু ডায়েট ওজন কমানো বা বাড়ানোর জন্য কী আদৌও কোনও ভূমিকা রাখে? সঠিক ডায়েট না মানলে কী কী ক্ষতি হতে পারে কিংবা পুজোর আগে কেমন ডায়েট মেনে চলা উচিত, সেই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মণিপাল হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ইন্দ্রাণী ঘোষ ৷
প্রঃ পুজোর এক মাস আগে ডায়েট করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
উঃ পুজোর একমাস আগে ডায়েট করলে কতটা ওজন আর কমতে পারে ! 3 থেকে 4 কিলো কমতে পারে তাও শুধু ডায়েট করে নয় ৷ তার সঙ্গে থাকতে হবে প্রপার এক্সারসাইজ ৷ কেউ যদি মনে করেন পুজোর আগে কয়েকদিন একটু ডায়েট করে, ব্যায়াম করে নিজের পছন্দের পোশাক পরব, তাহলে তিনি করতেই পারেন ৷ তারপর যদি সেটা মেনে চলেন, তাহেল সেটা আরও ভালো ৷ তবে কেউ যদি ভেবে থাকেন, ডায়েট করছি মানে, সব খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতে হবে বা অর্ধেক সময় না খেয়ে থাকতে হবে, তাহলে সেটা ভুল ৷ সেক্ষেত্রে সেটা হবে প্রপার ব্যালেন্স ডায়েট ৷ তাতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম সবকিছু থাকতে হবে পরিমাণ মতো ৷ সেই সব কিছু মাথায় রেখেই ডায়েট প্ল্যান করতে হবে ৷
প্রঃ অনেক সময় নেট দেখে অনেকেই ডায়েট প্ল্যান করেন ৷ সেটার কী প্রভাব পড়তে পারে?
উঃ নেট দেখে ডায়েট করা অবশ্যই ভুল ৷ সবসময় ইউটিউব বা গুগলে সব কথা ঠিক দেওয়া থাকে না ৷ সেক্ষেত্রে কোনও ডায়েটেশিয়ান বা কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয়, তাহলে সেটা শরীরের জন্য ভালো ৷ আসলে এই সামাজিক মাধ্যমে বেশিরভাগ বলা হয়, ভাত খাবেন না, রুটি খাবেন না বা খাওয়া নিয়ে নানা উপদেশ দেওয়া হয় ৷ কিন্তু সেখানে ভিতরের বিষয়টা বলা হয় না ৷ সেখানে শরীর ভিটামিনস বা মিনারেলসের যে ঘাটতি, তার কথা বলা হয় না ৷ ফলে পরবর্তী সময়ে এর খারাপ প্রভাব দেখা যায় ৷
প্রঃ না জেনে বুঝে ডায়েট করলে কী কী ক্ষতি হতে পারে?
উঃ অনেক রকম ক্ষতি হতে পারে ৷ প্রথমত, আমার মাসল লস হতে পারে ৷ শরীরে ভিটামিনস, মিনারেলস কম হতে পারে ৷ শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে ৷ পায়ে ক্র্যাম্পের সমস্যা হতে পারে, হার্টের সমস্যা হতে পারে যদি ম্যাগনেশিয়াম কমে যায়, শরীর যদি প্রপার আয়রন না পায়, তাহলে রক্তের ঘাটতি বা অ্যানিমিয়া হতে পারে ৷ হয়তো সেটা দ্রুত বোঝা যায় না ৷ তবে ভবিষ্যতে তা খারাপ আকার ধারণ করে ৷
প্রঃ অনেক সময় দেখা যায়, ডায়েটের কারণে অনেকে মৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়েন? এটা কতটা বিপদ সংকেত দিচ্ছে এখনকার জেনারেশনকে?
উঃ ছোটবেলা থেকে সকলেই ব্যালেন্স ডায়েট শব্দটার সঙ্গে পরিচিত ৷ কিন্তু শুধু ফল খেয়ে বা শুধু সবজি খাওয়া মানেই সেটা ডায়েট হয়ে যায় না ৷ প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম শরীর তখন ঠিক মতো পায় না ৷ আসলে ডায়েটে ফ্যাট কম খেতে বলা হয়, যাঁরা রোগা হতে চান ৷ কিন্তু কম খাওয়া মানে এই নয় যে, একদম না খাওয়া ৷ শরীর মেশিনের মতো কাজ করে ৷ আর সেটা চালাতে গেলে তোমাকে খাবার দিতে হবে ৷
প্রঃ অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, খুব মোটা বা খুব রোগা না হলেও পেটের কাছে জমে অতিরিক্ত চর্বি? কী করণীয়?
উঃ পেটের চর্বি কমাতে গেলে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে বিভিন্ন ভাজাভুজি খাবার ৷ জাঙ্ক ফুড, তেলে ভাজা জাতীয় জিনিস এড়িয়ে চলতে পারলে পেটের চর্বি কমবে ৷ তবে তার সঙ্গে ব্যায়ামটাও জরুরী ৷ এছাড়া অনেকে আজকাল হাঁটা প্রায় ভুলেই গিয়েছেন ৷ এছাড়া যেখানে কাজ করা হয়, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় এয়ার কন্ডিশনারড ৷ ফলে একজন ব্যক্তি যদি প্রায় 9 ঘণ্টা অফিসে কাজ করেন সেই সময়টুকু তাঁর যে পরিমাণ জল খাওয়া উচিত তা তিনি খান না ৷ কারণ, তাঁর তৃষ্ণা আসে না ৷ অথচ অজান্তেই আমার শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে যাচ্ছে ৷ তাই সঠিক পরিমানে জল খাওয়াটা মেনে চলা উচিত ৷
প্রঃ কিটো ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ডায়েট, লো-কার্বোহাইড্রেট ডায়েট নাম তো অনেক, কোনটা বেছে নেবে, কীভাবে?
উঃ ডায়েট এই ভাবে পছন্দ করা যায় না ৷ কার শরীরে কী প্রয়োজন তা জানার পরেই প্রপার ডায়েট প্ল্যান তৈরি করা হয় ৷ সেক্ষেত্রে ডায়েট প্ল্যান করার আগে অবশ্যই একজন নিউট্রিশনিস্ট বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে তারপর করা উচিত ৷ আসলে আমরা একটা ফ্লোয়ের মধ্য দিয়ে চলে যাই ৷ কাজটা করতে হবে করে নিই ৷ আর সেক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয় ৷ কারোর ডায়েট প্ল্যান করার আগে রক্ত পরীক্ষা করা অবশ্যই প্রয়োজন ৷ কারণ যদি দেখা যায়, রক্ত পরীক্ষার পর কারোর শরীরে পটাশিয়াম কম আছে, তাহলে তাঁকে সেই অনুযায়ী ফল বা শাক-সবজি না দিলে, সেটা আরও কমে যাবে ৷ আবার কারোর ক্ষেত্রে দেখা গেল রক্ত পরীক্ষায়, প্রোটিন শরীরে অনেক বেশি রয়েছে ৷ আমি যদি না জেনেই প্রোটিন জাতীয় খাবার খাই, তাহলে তো তা হিতে বিপরীত হবে ! ওজন, উচ্চতা, বিএমআর সবকিছু মেনে একটা ডায়েট প্ল্যান করা উচিত ৷
প্রঃ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাহলে কী কী খাবার রাখা উচিত আর কোনটা বাদ দেওয়া উচিত?
উঃ খাবার বাতিলের ক্ষেত্রে বলব, আনহেলদি খাবার আগে বাদ দিতে হবে ৷ জাঙ্ক ফুড, কোল্ড ড্রিংকস, ভাজা খাবার বাদ দিতে হবে ৷ হেলটি ফ্যাট, ড্রাই ফ্রুটস, বেরিস, ফল, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, বিনস ইত্যাদি রাখা উচিত ৷ যেমন ধরা যাক কলা ৷ এতে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেড রয়েছে ৷ এবার কেউ যদি মাঝারি সাইজের একটা পাকা কলা খায়, তাহলে তা থেকে 105 কিলো ক্যালোরি থাকে আর 25-27 গ্রাম কার্বোহাইড্রেড থাকে ৷ তাহলে যাঁদের ওবেসিটি নেই তাঁদেরকে কলা খাওয়ার পরামর্শ দেব ৷ কিন্তু যাঁদের ওবেসিটি রয়েছে তাঁদের বলব এটা কম খেতে ৷ লাইটস্টাইলে পরিবর্তন না আনলে কিছু হবে না ৷ এখন কেউ যদি রাতে 11টায় খেয়ে সাড়ে 11টায় ঘুমোতে যায় তাহলে তাঁর 6-7 ঘণ্টা ঘুম মাস্ট ৷ ঘুম যদি ঠিক না হয়, তাহলে তা শরীরে প্রভাব ফেলে ৷ সেক্ষেত্রে রাতের খাবার খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যবধান থাকতে হবে ঘুমোতে যাওায়ার মধ্যে ৷ কিন্তু আমরা সেটা মেনে চলি না ৷ খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়িস যা শরীরের ক্ষতি করে ৷ আর একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সারাদিন ঠিক করে খাওয়া হয়নি বলে, রাতে অনেকটা খেয়ে নিলাম এটা ঠিক নয় ৷ ব্রেকফাস্ট ভালো খাব ৷ তারপর দুপুরের খাবার ৷ রাতে থাকবে একদম হালকা খাবার ৷
প্রঃ সাপ্লিমেন্ট নেওয়া কতটা কার্যকর?
উঃ অনেকেই ভাবেন, সাপ্লিমেন্ট নিচ্ছি মানে, ডায়েট করা হয়ে গেল ৷ বা কোনটা একটা সময়ের খাবার স্কিপ করছি মানে ডায়েট হয়ে গেল, সেটা একদম ভুল ধারণা ৷ অনলাইনে, গুগলে একাধিক সাপ্লিমেন্টের কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলো আসলে আনহেলদি ৷ এটে কাজের কাজ কিছু হয় না বরং শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় ৷ একমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা উচিত ৷ নচেৎ নয় ৷
প্রঃ যারা রোগা থেকে মোটা হতে চান, তাহলে কীভাবে ডায়েট প্ল্যান করবেন?
উঃ তাঁরা বাটার খাবেন, রিফাইন ওয়েল খাবেন ৷ হোলগ্রেইন খাবেন ৷ ভাত-রুটি সবকিছু খেতে পারেন ৷ দুগ্ধজাতীয় খাবার, ফল, স্প্রাউটস, মাছ, মাংস, ডিম পরিমাণ মতো খেতে হবে ৷ তবে সবকিছুতেই পরিমাণ জানাটা জরুরি ৷ অনেকে ভেবে থাকতে পারেন, ডায়েট মানে একটু আইসক্রিম বা জাঙ্কফুড একদম বাদ দিয়ে দেব ৷ তা নয় ৷ মাসে একবার এই সব জিনিস খাওয়া যেতেই পারে ৷ তবে তার পরিমাণ হতে হবে অল্প ৷ সেই সব কিছু মাথায় রাখলে শরীরও ঠিক থাকবে ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে ৷
আরও পড়ুন: ফ্রিজে খাবার তো রাখছেন, ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে না তো? সংরক্ষণের টিপস দিলেন পুষ্টিবিদ