আমরা প্রায়ই শুনি, অভিভাবকরা তাঁদের শিশুদের সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে, তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না । যেমন ভাবা হয়, শিশুরা হয়তো তেমন পড়তে, লিখতে বা জানতে না পেরে প্রায়ই তাদের অভিভাবকদের বিরক্তির কারণ হয় । আর এই বয়সে এটা খুব সাধারণ বিষয় । কিন্তু কখনও কখনও, কিছু কিছু পরিস্থিতিতে কোনও শিশু হয়তো অক্ষর চিনতে, শব্দ পড়তে এবং লিখতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ে । এটা সাধারণ নয়, স্বাভাবিকও নয় । একটি লার্নিং ডিজ়অর্ডারের জন্যই তা হয় । একে বলে ডিসলেক্সিয়া । কিছু কিছু হলিউডের এমনকী বলিউডের ছবিতেও এই অবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে এবং এই বিষয়ে আরও জানতে আমাদের দল, একজন বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র সাইক্রিয়াটিস্ট ড. বীণা কৃষ্ণণের সঙ্গে কথা বলেছে ।
ডিসলেক্সিয়া কী?
ডা. কৃষ্ণণের ব্যাখ্যা যে, ডিসলেক্সিয়া হল এক ধরনের মানসিক অবস্থা । যেখানে কোনও শিশু, কোনও তথ্য গ্রহণ, উপলব্ধি এবং ব্যবহার করতে অপারগ হয় । একেও এক ধরনের লার্নিং ডিজ়অর্ডার বলা হয় । এটা কেবল সেই শিশুর পড়াশোনার উপরই প্রভাব ফেলে না, তার রোজকার কাজকর্ম যেমন স্পোর্টস—গেমস যা তাদের দৈনন্দিন রুটিনের অন্যতম অঙ্গ, তাকেও সমানভাবে প্রভাবিত করে । পরিসংখ্যান বলে, যে শিশুদের অন্তত 10 শতাংশেরই লার্নিং ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত । যেমন, যদি বলা হয়, একটি ক্লাসে 30 জন পড়ুয়া থাকে, তাদের মধে্য অন্তত তিন জনের এই সমস্যা থাকে ।
কারণ এবং উপসর্গ
ডিসলেক্সিয়া স্নায়ুতন্ত্র থেকে উদ্ভূত নিউরোলজিক্যাল ডিজ়র্ডার এবং জিনগত কারণেও হতে পারে । যেহেতু এটা কোনও শারীরিক রোগজ্বালা নয়, তাই তার উপসর্গ শুধুমাত্র কোনও শিশুর স্বাস্থ্য একবার পর্যবেক্ষণ করলেই চিহ্নিত করা যায় না । সাধারণত, এই সব উপসর্গ তখন ধরা পড়তে পারে, যখন কোনও শিশু স্কুলে যায় কারণ তখনই তারা কোনও নতুন ভাষা এবং আরও নতুন, নানা জিনিস শিখতে শুরু করে । লার্নিং ডিজ়অর্ডার মূলত তিন রকম হতে পারে ।
- ডিসলেক্সিয়া : যখন কোনও শিশুর কোনও শব্দ পড়তে অসুবিধা হয় ।
- ডিসগ্রাফিয়া : যখন কোনও শিশু যথাযথভাবে লিখতে পারে না ।
- ডিসক্যালকিউলিয়া : যখন কারও অঙ্ক করতে, বুঝতে সমস্যা হয় ।
ডা. কৃষ্ণণ বলেন, ডিসলেক্সিয়া কোনও মানসিক অসুস্থতা নয় । যে সব শিশু এতে আক্রান্ত, তাদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি’ তথা মানসিক আত্তীকরণের ক্ষমতা হয়তো গড় বা গড়ের থেকে বেশিই হয় । এই সব শিশুরা অসাধারণ বাগ্মী হয় । যদিও কোনও নির্দেশ বুঝতে এদের অসুবিধা হয়, অক্ষর চিহ্নিত করতে সমস্যা হয়, স্বাভাবিক ও বক্র অক্ষরের মধে্য তফাত করতে অসুবিধা হয়, সঠিক বাক্য গঠনে সমস্যা হয় এবং কোনও পাঠ্য বা শব্দ মনে রাখতেও অসুবিধা হয় । এর উপর আবার, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সহজ কোনও কাজ করতেও সমস্যা হয় যেমন জুতোর ফিতে বাঁধা, শার্টের বোতাম তাড়াতাড়ি আটকানো এবং অন্য যে কোনও কাজ, যাতে মনোযোগের দরকার হয় ।
শিশুদের উপর এর প্রভাব
আমাদের বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা হল, অনেক সময় তথ্যের অভাব এবং উপসর্গ চিহ্নিত করতে ব্যর্থতার জন্য, শিক্ষক এবং অভিভাবক, উভয়ই মনে করেন যে, শিশু ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না এবং মনোযোগের অভাব, আলস্য এবং দুষ্টুমির জন্য ইচ্ছা করে ভুলভ্রান্তি করছে । ফলে সে অনেক সময় বিনা কারণেই বকা খায় কিংবা তাকে মারধর করা হয় ।
এছাড়াও এই সব শিশুর বিকাশ, তাদের সমবয়সি অন্যদের তুলনায় একটু ধীর গতিতে হয়, যে কারণে তাদের বন্ধু এবং সহপাঠীরা তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করে আর এর জন্য তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি হয় । এই ধরনের পরিস্থিতিতে, শিশুটি যে কাজ করতে পারে, সেটিও তখন তার পক্ষে করা সম্ভব হয় না ।
এর নিরাময় কি সম্ভব?
ডিসলেক্সিয়া একটি মানসিক অবস্থা এবং এর কোনও নির্দিষ্ট বা নিশ্চিত চিকিৎসা নেই । যত তাড়াতাড়ি এর উপসর্গগুলি চিহ্নিত করা যাবে, ততটাই জরুরি ভিত্তিতে কোনও বিশেষজ্ঞ সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ নিতে হবে । ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত কোনও শিশুর পড়া ও লেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায় সঠিক শিক্ষাদানের কৌশল এবং নির্দেশ অনুসরণ করার মাধ্যমে । এই ধরনের শিশুদের সেই সব কাজ করায় উৎসাহ প্রদান করা উচিত, যা করতে তারা পারদর্শী । যেমন আঁকা, গান গাওয়া, সংগীতের যন্ত্র বাজানো, গেমস এবং স্পোর্টস এবং এই ধরনের অন্যান্য কাজকর্ম যাতে তাদের অবস্থার উন্নতি করা যায় । তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ভরে দেওয়া যায় । সুতরাং, এই ধরনের শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করতে, জরুরি হল তার অভিভাবক, শিক্ষক এবং বাড়ির বড়দের অসীম ধৈর্য্য এবং সহজ স্বাভাবিক মেজাজ । স্বাভাবিক আর পাঁচটি শিশুর মতো এই শিশুদের সঙ্গেও সহজ—স্বাভাবিক ব্যবহার করা, তাদের উদ্বুব্ধ করা এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ।