বারাসত, 9 এপ্রিল: আজকের মুখ্যমন্ত্রী তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী ৷ তারিখটা, 1994 সালের 21 ফেব্রুয়ারি ৷ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ৷ বাম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে রাজ্যজুড়ে ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কংগ্রেসে ৷ সেদিন উত্তর 24 পরগনার বারাসতের শাসনে মজিদ মাস্টার একচ্ছত্র অধিপতি ৷ আর সেখানে ঢুকবেন যুব কংগ্রেস নেত্রী ৷ তাঁর একডাকে হাজার হাজার কর্মীরা হাজির হলেন ৷ সূত্র মারফত জানা যায়, সেদিন গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু ৷ যার জেরে তিনজন সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারান ৷ আর জখম বহু ৷ তার মধ্যে একজন ছিলেন নির্মল দাস ৷ সেদিনের তরতাজা যুবক আজ প্রৌঢ় ৷
পুলিশের চালানো গুলি পায়ে লেগেছিল আর তিনি উলটে পড়ে গিয়েছিলেন ৷ চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল ৷ কোনও হুঁশ ছিল না । জ্ঞান ফিরলে দেখলেন তিনি হাসপাতালের বেডে ৷ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন ৷ পরে একাধিক অস্ত্রোপচার হয় পায়ে আর চোয়ালে ৷ ধার-দেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছিল কংগ্রেস কর্মী মমতার অনুগামী নির্মল দাসকে ৷ এখন তিনি সুস্থ ৷ ভ্যান চালান ৷ কোনও রকমে দিন আনা দিন খাওয়া সংসার ৷
সেদিনের পুলিশের নির্মম গুলি চালানোর ঘটনা আজও টাটকা নির্মল দাসের স্মৃতিতে ৷ এরপর প্রায় 28 বছর কেটে গিয়েছে ৷ সেদিন যিনি বিরোধী নেত্রী ছিলেন আজ তিনিই বাংলার মসনদে ৷ কিন্তু রক্তাক্ত যুবক নির্মল দাসের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি ৷ কেউ জানতে চায়নি তিনি কি বেঁচে আছেন ? থাকলেও কীভাবে ? না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন-তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও কেউ আসেনি নির্মল দাসের কাছে ৷ জোটেনি কোনও সরকারি চাকরি কিংবা দলের তরফে আর্থিক সাহায্য ৷ তাই নিরুপায় হয়ে পরিবারের জন্য আজ তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে দু'চাকার ভ্যান ৷ অশক্ত শরীর, গুলি লাগা পায়ে ভ্যান চালিয়ে দিন কাটছে 72 বছরের নির্মলের ৷ এখন জীবনের শেষবেলায় তিনি এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান ৷ সুযোগ পেলে তাঁর কাছে চাকরির দরবার করবেন সেদিনের যুবক নির্মল দাস ৷
আরও পড়ুন: বামজমানায় সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর শাসন ! পরিবর্তনের দাবি তৃণমূলের
কী হয়েছিল সেদিন ?
তৎকালীন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে উত্তর 24 পরগনার বারাসতে জমায়েত করেছিল কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক ৷ বারাসতের কাছারি ময়দানে আইন অমান্য আন্দোলন হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৷ প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সৌমেন মিত্র, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী-সহ দলের প্রথম সারির একাধিক নেতা হাজির ছিলেন যুব কংগ্রেসের সেই আন্দোলনে ৷ প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন হলেও পরে তা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ৷
তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার রচপাল সিংয়ের নির্দেশে পুলিশ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় বলে অভিযোগ ৷ গুলিতে সেদিন গোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে বারাসতের এক বাসিন্দার মৃত্যু হয় । এছাড়া গুলিবিদ্ধ হন আরও অনেকে ৷ সেই তালিকায় ছিলেন নির্মল দাসও ৷ বসিরহাটের সন্দেশখালি 2 নম্বর ব্লক থেকে ম্যাটাডোর বোঝাই করে সেদিন তিনিও এসেছিলেন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিতে ৷ তখন তাঁর বয়স ছিল 43 বছর ৷ পালাতে গিয়ে গুলি এসে লাগে যুবকের ডান পায়ে ৷ সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি ৷ তাতে মারাত্মক জখম হয় গালের চোয়ালও ৷ এরপর গুলিবিদ্ধ ওই যুবককে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঘটক পুকুরের কাছে এক বেসরকারি হাসপাতালে ।
সেখানে প্রায় তিনমাস চিকিৎসা চলে তাঁর ৷ হাসপাতালের বিপুল খরচ মেটাতে গিয়ে একসময় সন্দেশখালির গ্রামের পৈতৃক ভিটে এবং জমিজমা সবকিছুই বিক্রি করে দিতে হয় ৷ সাহায্য করা দূরের কথা, খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করেননি শাসকদলের কোনও নেতা অথবা মন্ত্রী ৷ বর্তমানে বারাসতের রামকৃষ্ণপল্লির এক চিলতে বাড়িতে কোনওরকমে দিনযাপন করছেন নির্মল দাস ৷ পরিবার বলতে স্ত্রী, দুই ছেলে, পুত্রবধূ, নাতনি রয়েছে তাঁর ৷ দুই ছেলের সামান্য রোজগারে ঠিকমতো সংসার চলে না ঠিকমতো ৷
এই বিষয়ে নির্মল দাস বলেন, "সেদিনের ঘটনার পর থেকে কোনও নেতা খোঁজ খবর রাখেনি ৷ অনেকের কাছে গিয়েছি সাহায্যের জন্য ৷ কিন্তু কিছুই মেলেনি ৷ ইচ্ছে আছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করব ৷ তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন করতে চাই ৷ আমার তো বয়স হয়েছে ৷ আর কতদিনই বা বাঁচব ৷ তার আগে যদি ছোট ছেলের একটি চাকরির ব্যবস্থা হয় তাহলে খুব উপকার হবে ৷"
একই সুর শোনা গিয়েছে নির্মলের ছোট ছেলে উৎপল দাসের গলাতেও ৷ তাঁর কথায়, "বাবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনও স্নেহ করেন ৷ আমরাও তৃণমূলের সমর্থক ৷ আমরা চাই, বর্তমান সরকার আমাদের পরিবারের কথা ভেবে কিছু একটা ব্যবস্থা করুক ৷ তাহলে এই দুর্দিন কাটতে পারে ৷" এ প্রসঙ্গে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ৷ সেদিনের ঘটনায় যিনি মারা গিয়েছিলেন, সেই গোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ এই বিষয়টি হয়তো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছায়নি ৷ আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেব ৷ স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলব ৷ যাতে নির্মল দাসের বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় ৷ আশা করছি, নিশ্চয় তাঁর কিছু একটা বন্দোবস্ত হবে ৷"
আরও পড়ুন: যোগ্যতা ছাড়াই কোটায় চাকরি হয়েছে, বাম আমলে 'নিয়োগ দুর্নীতি' নিয়ে সরব উদয়ন