হাবড়া, 30 মে : আমফানের বিধ্বংসী রূপ দেখেছে উত্তর 24 পরগনা ৷ বহু মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন ৷ একই অবস্থায় পড়েছেন হাবড়ার বাসিন্দা জাতীয় স্তরের সারিন্দাবাদক গোবিন্দ দাস ৷ ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর মাটির বাড়ির দেওয়ালের বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে ৷ টিনের চাল উড়ে যাওয়ায় প্রশাসনের থেকে পাওয়া ত্রিপল টাঙিয়ে থাকছেন শিল্পী ও তাঁর পরিবার ৷
যত ঝড় আসুক জীবনে, শিল্পীর শিল্প সাধনা থেমে থাকে না ৷ শিল্পের মধ্যে দিয়ে তাঁর সুখ-দুঃখ প্রকাশ করেন ৷ 20 মে আমফান এসে সারিন্দা বাদক গোবিন্দ দাসের মাটির বাড়ি ভেঙে দিয়ে গেছে ৷ উড়ে গেছে টিনের চাল । ত্রিপল টাঙিয়ে তার নীচেই মা-দাদার সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন শিল্পী ৷ কিন্তু চোখের সামনে সব শেষ হতে দেখেও বিচলিত হননি ৷ চালিয়ে গেছেন সুরের সাধনা ৷ হাবড়া থানার মহিষা মছলন্দপুর গ্রামে বাড়ি গোবিন্দর । বয়স 30 । জন্মের পর থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী । তবু মনের জোরে এগিয়ে গেছেন জীবনের পথে । রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে M.A করেছেন । কলকাতার বড় বড় মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছেন । প্রখ্যাত লোকশিল্পী পার্বতী দাস বাউলের সঙ্গে সারিন্দা বাজিয়েছেন । 2017 সালে দিল্লিতে জাতীয় স্তরের অনুষ্ঠানে রাজ্য থেকে সারিন্দা বাদক হিসেবে গেবিন্দ প্রতিনিধিত্ব করেছেন । কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে দোতারা বাজিয়ে মন ভরলেও পেট ভরেনি তাঁর । মাকে নিয়ে মাটির কুঁড়েঘরে দিন কাটান । এতে অবশ্য কোনও আক্ষেপ ছিল না তাঁর ।
ঝড়ের পর কেটে গিয়েছে 10 দিন । সরকারি ত্রাণ হিসেবে পঞ্চায়েত থেকে মিলেছে মাত্র একটি ত্রিপল । তাই দিয়ে কোনওমতে ঘরের চাল ঠিক করেছেন ৷ শিল্পী বলেন, ‘‘মনের আনন্দে সারিন্দা বাজাই । দোতারা বাজাই । এর মধ্যে দিয়েই আমার সুখ-দুঃখ সব প্রকাশ পায় ৷ চোখের সামনে বাড়ি ভাঙতে দেখেও কিছু করতে পারিনি ৷ সরকারি সাহায্য বলতে একটা ত্রিপল ছাড়া কিছু নেই ৷’’ পাশে গোবিন্দর দাদার একটা ছোট্ট টিনের ঘর আছে । কিন্তু মা গঙ্গাদেবীকে নিয়ে মাটির ঘরে থাকেন শিল্পী । গঙ্গাদেবী বলেন, ‘‘ঝড়ে ঘর ভেঙে গেছে । মাথা গোঁজার ঠাই নেই । উনুন, কাঠ সব ভেজা ৷ রান্না করতে পারছি না ৷ সরকার যদি সাহায্য করত তাহলে বেঁচে যেতাম ।’’ জাতীয় স্তরের শিল্পী দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নীচে । খবর পেয়ে লোকশিল্পী শ্রীপর্ণা মিত্র গোবিন্দর বাড়ি যান । সব দেখে তিনি বলেন, ‘‘গোবিন্দর সঙ্গে আমিও অনেক অনুষ্ঠান করেছি । ওর মতো গুণী শিল্পীর যদি এরকম অবস্থা হয়, সেটা বড় বেদনাদায়ক । সরকার ওঁকে সাহায্য করলে শিল্পীকে সম্মান জানানো হবে । আমি চাই, সরকার ওকে সাহায্য করুক ।’’
মনে একরাশ অভিমান । দিনের শেষে ভাঙা বাড়ির সামনে বসে শিল্পী একমনে দোতারা বাজিয়ে চলেন । গোবিন্দ যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শিল্পী' গল্পের মদন তাঁতি । গোবিন্দর দোতারা যেন মদন তাঁতির তাঁতঘর । চোখে হাজার রঙিন স্বপ্ন । মহিষার মেঠোপাড়ায় লোকগানের সুর ভাসে, ‘‘কত রঙ্গ দেখব দুনিয়ায় ভাই রে । ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে ।’’