দেগঙ্গা, 14 জুন : বাগানে সারি সারি আঙুরের থোকা । দেখে যে কেউ অবাক হতেই পারেন । মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের কোনও অখ্যাত গ্রামে কিভাবে তা সম্ভব । তাও আবার পলিমাটিতে । তবে অবাক হলেও এমনই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন উত্তর 24 পরগনার দেগঙ্গার হায়াত আলি । নিজের দেড়কাঠা জমিতে আঙুর ফলিয়ে রীতিমতো কর্মসংস্থানের দিশা দেখাচ্ছেন বছর চল্লিশের এই যুবক । বেকার যুবকদের এই চাষে উৎসাহিতও করছেন হায়াত । যার প্রশংসা এখন গ্রামের সকলের মুখে মুখে ।
দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা এক নম্বর পঞ্চায়েতের পশ্চিম চ্যাংদানা গ্রামে বাড়ি হায়াত আলির । পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা ছাড়াও স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে । সংসার চালাতে গিয়ে একসময় হিমশিম খেতে হয় এই যুবককে । এমব্রয়োডারির ব্যবসা শুরু করেও সেই ব্যবসা বেশিদিন টেকাতে পারেননি হায়াত । এরপর ধারদেনা করে 107 গাড়ি কিনেছিলেন ভাড়া খাটাবেন বলে । কিন্তু লকডাউনের জেরে দীর্ঘদিন গাড়ি রাস্তাতেই নামাতে পারেননি তিনি । ফলে রুটিরুজিতে টান পড়ে । লকডাউনে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে গিয়ে যখন দিশেহারা অবস্থা তখন ভেঙে না পড়ে নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন এই যুবক । তখনই ইউটিউব ঘেঁটে বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ দেখতে পান হায়াত । বিশেষ করে আঙুর চাষ সংক্রান্ত আলোচনা শুনে সেই চাষে আকৃষ্ট হন ।
এবিষয়ে বিভিন্ন নার্সারির সাথে কথা বলেন তিনি । তাদের বলা হয়, আঙুরের চারা নিয়ে আসার জন্য । কিন্তু প্রথমে অনেকেই আমল না দিলেও পরে এক নার্সারির মালিক 13টি আঙুর গাছের চারা নিয়ে আসেন হায়াতের জন্য । কিন্তু তা নিয়েও তাঁকে কম হাসিঠাট্টা শুনতে হয়নি । পাড়া প্রতিবেশী থেকে গ্রামবাসীদের অনেকেই হাসি মস্করা করে বলতে থাকেন সেই আঙুর চারায় আদৌও ফুল আসবে তো । যদিও বা ফলন হয়, সেই আঙুর শেষ পর্যন্ত মুখে দেওয়া যাবে তো । তবে কোনও কথায় কান না দিয়ে গত বছরের জুন মাসে বাড়ির সামনের দেড়কাঠা জমিতে সেই আঙুর চারাগুলি রোপণ করেন হায়াত ।
সঠিক পরিচর্চায় তিন মাস যেতে না যেতেই ফুল আসে গাছে । আকারে ছোট হলেও ডিসেম্বর মাসে ওই গাছেই প্রায় সাত কেজি আঙুরের ফলন হয় । এই গাছেই এখন সারি সারি আঙুরের থোকা দেখে যে কেউ ভিমরি খেতেই পারেন । স্বাদেও অতুলনীয় । ইতিমধ্যে স্বাদেভরা সেই আঙুরের কিছুটা তিনি বিক্রি করেছেন দেগঙ্গা বাজারে । এখনও বাগানে এক কুইন্টাল আঙুর রয়েছে হায়াতের বাগানে । জিভে জল আনা মিষ্টি স্বাদের আঙুর খেয়ে সমালোচকরাও এখন মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজছেন । আঙুরের পাশাপাশি হায়াত পাশেই বেশ কয়েক কাঠা জমিতে আপেল, নাসপাতির মতো ফলের চাষও করেছেন । তবে তাতে এখনও ফুল আসেনি । আঙুরের মতো তাতেও একদিন ফলন হবে বলে আশাবাদী দেগঙ্গার যুবক ।
এই বিষয়ে হায়াত আলি বলেন, "ইউটিউব চ্যানেল দেখে আঙুর চাষের প্রতি আকৃষ্ট হই । তারপরই এই গাছের চারার সন্ধান শুরু করি । তবে যে প্রজাতির চারা চেয়েছিলাম তা পাওয়া যায়নি । বীজহীনের পরিবর্তে বীজযুক্ত প্রজাতির চারা দেওয়া হয় আমাকে । যখন এই আঙুর চাষ শুরু করলাম তখন অনেকেই হাসিঠাট্টা করেছে । পাগলও বলেছে অনেকে । এখন তো গাছের ফলন ও তাতে মিষ্টতা দেখে প্রশংসা করছেন সকলে । আঙুরের ফলন দেখতে ভিড়ও করছেন অনেকে ।"
তিনি আরও বলেন,"এই চাষ লাভজনক । আমার ধারণা, প্রতি বিঘায় পাঁচ থেকে ছয় টন আঙুর ফলবে । তাই এলাকার বেকার যুবকদেরও বলব, তারাও যেন এই চাষে এগিয়ে আসেন । যাতে তাঁরা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন ।"
বিষয়টি নিয়ে হায়াতের কাকা ইমান আলি বলেন, "প্রথমে চিন্তা হয়েছিল দেগঙ্গার মতো পলিমাটির জমিতে আদৌও আঙুর চাষ হবে কি না । তবে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে হায়াত । এর জন্য প্রচুর দৌড়াদৌড়িও করেছে ও । সমস্ত কৃতিত্ব ভাইপোর । লোকে দেখে প্রশংসা করছে । এটা খুব ভালো লাগছে আমাদের ।"
আরও পড়ুন : বাংলার আবহাওয়ায় শীতের দেশের ফল চাষ, পরিদর্শনে কৃষি আধিকারিকরা
সবমিলিয়ে দেগঙ্গার হায়াত আলির ‘ফল বাড়ি’ এখন গ্রামবাসীদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ।