পুরুলিয়া, 26 জুলাই : সমাজ সেবায় মাধুকরী বৃত্তি নরেন হাঁসদার । জেলার বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী অনাথ শিশুদের নিয়ে এবং আদিবাসী সমাজে বহিষ্কৃত লাঞ্চিত, স্বামীহারা মহিলাদের আশ্রয় দিয়েছেন তিনি ৷ গান গেয়ে ভিক্ষে করেই গড়ে তুলেছেন আশ্রম । নাম দিয়েছেন 'সিদো-কানহু মিশন' । সেখানে অনাথ শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন বিদ্যালয় । অনাথ আবাসিকদের পাশাপাশি লেখাপড়া শেখাচ্ছেন এলাকার আরও শতাধিক ছেলেমেয়েকে । স্বপ্ন একটাই, তারা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজ গড়ার কাজে হাত লাগায় । শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই অনাথ ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নরেন হাঁসদা ।
পুরুলিয়া শহর থেকে 30 কিলোমিটার দূরে আড়ষা থানা থেকে বাঁ দিকে আরও 3 কিলোমিটার গেলে দেখা মিলবে নরেন হাঁসদার আশ্রম ৷ আড়ষা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ফাঁকা জঙ্গলের মাঝে ছোটো ছোটো ডুংরির তলায় ভালিডুংরির নিচে মনোরম পরিবেশে রয়েছে এই সিদো-কানহু মিশন । সেখানে রয়েছে 27 জন আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনাথ ছেলেমেয়ে । শুধু পড়াশোনাই নয় গান বাজনা, তিরন্দাজি, খেলাধুলো, আদিবাসী রীতিনীতি, চাষাবাদ, গাছ লাগানো সব কাজই শেখানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের । একইসঙ্গে আশ্রম চালাতে 20 জনের একটি গানবাজনার দলও গড়ে তুলেছেন নরেন হাঁসদা । সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে গানবাজনা করে যে চাল-ডাল ও টাকা পয়সা মেলে তা দিয়েই চলে এই আশ্রম । কিন্তু বর্তমানে কোরোনা আবহে সংকটের মুখে পড়েছে নরেন হাঁসদার সিদো-কানহু মিশন ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চার মাসের বেশি সময় ধরে গ্রামে গঞ্জে, গ্রাম্য মেলায় গানবাজনার আসর বসা বন্ধ হয়ে উপার্জনও বন্ধ নরেন হাঁসদার । অনাথ আদিবাসী ছেলেমেয়েদের ও আবাসিক মহিলাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে । তাই এই পরিস্থিতিতে মিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন নরেন হাঁসদা । তিনি জানান, "মাঝেমধ্যে কোনও সহৃদয় ব্যক্তি বা স্থানীয় থানা থেকে এবং পঞ্চায়েত থেকে কিছু চাল সাহায্য দেওয়া হয়েছে । কিন্তু চাল দিয়েই তো আর সব হয় না । অন্য খরচ খরচাও রয়েছে । বর্তমানে কীভাবে আশ্রম চলবে, এতগুলো ছেলেমেয়েদের কীভাবে ভরণপোষণ হবে বুঝে উঠতে পারছি না ।"
এই মিশন গড়ে তোলার বিষয়ে নরেন হাঁসদা জানান, জেলার বিভিন্ন জায়াগায় গান গেয়ে বেড়াতেন । সেই সময়ই ধরেই জেলা জুড়ে পরিচয় নরেন হাঁসদার । একসময় অযোধ্যা পাহাড়তলি এলাকায় গান গাইতে গিয়ে দেখতে পান অনাথ ছেলেমেয়েদের । গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন ওই শিশুরা পথেই কাটায় । তাঁদের আশ্রয় নেই । তাই সেই অনাথ ছেলেমেয়েদের তাঁর সাথে নিয়ে যেতে বলেন গ্রামবাসীরা । সেই দুজন অনাথ শিশুকে তিনি নিয়ে আসেন আড়ষার ভালিডুংরিতে একটি ছোট্ট বাড়িতে । তারপরই তাঁদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা করেন । এরপরই 2014 সালে সিদো-কানহো মিশনের প্রতিষ্ঠা হয় । প্রতিষ্ঠার সময় অনাথ শিশুদের সংখ্যা ছিল প্রায় 13 জন এবং শিক্ষিক-শিক্ষিকার সংখ্যা ছিল তিন জন । পরে ধীরে ধীরে অনাথ শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে । বর্তমানে মিশনে 27 জন অনাথ ছেলে মেয়ে রয়েছে আবাসিক হিসেবে । যার মধ্যে ছয় জন মেয়ে ও 21 জন ছেলে রয়েছে । পাশাপাশি শিক্ষক রয়েছেন দুজন এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত মহিলা রয়েছেন চার জন । এছাড়াও আশপাশের সালগা-দুমদুমি, বারুঘুটু, চকেদাবাদ এবং কামাজারা গ্রাম থেকে 102 জন ছাত্র-ছাত্রী সিদো-কানহো মিশন বিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আসেন । একইসঙ্গে নরেন হাঁসদার গান বাজনার দল বিভিন্ন জায়গায়, গ্রামে গঞ্জে, গ্রাম্য মেলায় গানবাজনা করে থাকেন । ওই গানবাজনার আয় দিয়েই চলে এই আশ্রমের খরচ খরচা ।
তিনি আরও জানান, "আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি এই মিশন চালিয়ে যাব । কিন্তু তার পর আর কি হবে? কারণ কোনো সরকারি সাহায্য নেই । কোনো সহৃদয় ব্যক্তিরা যেটুকু সাহায্য করে এবং গানবাজনা করে যা আয় হয় তা দিয়েই আশ্রম চলে । ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য কোন সঞ্চয়ও নেই । তাই আমি ছেলেমেয়েদের বলি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর, তারপর তোদেরকেই এই আশ্রম চালানোর দায়িত্ব নিতে হবে ।"