ETV Bharat / state

ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা সতীর্থরা,প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীর আক্ষেপ, সেদিন আমি কেন মরলাম না? - Tamralipta Jatiya Sarkar

গান্ধির ডাকে সাড়া দিয়ে অগাস্ট আন্দোলনের শরিক হন । তখন নবম শ্রেণির ছাত্র । বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্তের নির্দেশে 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর মহিষাদল থানা দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেন স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত । আজ বয়স প্রায় একশো ছুঁই ছুঁই । আজও ঘুমের মধ্যে কানে বাজে সে দিনের গুলিবিদ্ধ সতীর্থদের আর্তনাদ ।

চিত্তরঞ্জন সামন্ত
author img

By

Published : Aug 15, 2019, 10:01 AM IST

Updated : Aug 18, 2019, 7:27 PM IST

মহিষাদল, 15 অগাস্ট : সালটা 1942 । ডিসেম্বরের 17 তারিখ পরাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সরকার । তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত । সেই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন মহিষাদলের স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত । ঘুমের মধ্যে আজও কানে বাজে গুলিবিদ্ধ সতীর্থদের আর্তনাদ । 73 তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ETV ভারতকে জানালেন কী হয়েছিল 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর ।

মহিষাদলের কালিকাকুণ্ডু গ্রামে ছিল চিত্তরঞ্জনবাবুর বাড়ি । তখন নবম শ্রেণিতে পড়েন । গান্ধিজীর ডাকে সাড়া দিয়ে অগাস্ট আন্দোলনের শরিক হন । বাবা হরিরাম সামন্ত । পেশায় শিক্ষক ও কংগ্রেস কর্মী । বাবার সহকর্মী সুশীলকুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত । তাঁদের সঙ্গে প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন । এখন বয়স 96 । শরীরে সেই জোর নেই । কিন্তু চোখে আজও সেই তেজ । মনে সাহস ।

একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । অন্যদিকে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী দেশের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছে । গান্ধিজিও ইংরেজ 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন । এই সময় আন্দোলনের গতি রুখতে ব্রিটিশ সরকার ঘর পোড়া নীতি নেয় । ভয়, নেতাজি যদি পৌঁছে যায় তাহলেই বিপদ । তাই আগেভাগেই তারা সাইকেল, গোরুর গাড়ি, নৌকা সব তুলে নিতে শুরু করে । খাদ্যশস্য, সবজি সিজ় করে । সে সময় ব্রিটিশ বাহিনীকে রুখতে থানা দখলের নির্দেশ আসে । নির্দেশ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত । ঠিক হয় 29 সেপ্টেম্বর মহিষাদল থানা দখল করা হবে । তমলুকের ছ'টি থানার মধ্যে মহিষাদল থানা দখলের দায়িত্বে ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু । তাঁর দাদা ছিলেন সুতাহাটা থানা দখলের দায়িত্বে । আগের দিন রাতেই পুলিশ বা মিলিটারি যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে, বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখা হয় রাস্তায় । 29 তারিখের মিছিলে চিত্তরঞ্জনবাবুর সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন ধনী- দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় 40 থেকে 50 হাজার মানুষ । মিছিল মহিষাদল রাজবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায়, সে সময় হঠাৎ করে গুলি চালানো শুরু করে পুলিশ । ভোলানাথ মাইতির বুকে প্রথম গুলি লাগে । তাঁকে কোনওরকমে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । তবুও দমে না গিয়ে মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান চিত্তরঞ্জনবাবু । এরপর একে একে গুলিবিদ্ধ হন হরিচরণ দাস, বটু মাইতিরা । পুলিশের গুলি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ঢাল হিসেবে টিনের কপাট সামনে রেখে এগিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা । কপাট ভেদ করে গুলি লাগে সাধারণ মানুষের গায়ে । ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল । সে দিনের সেই থানা দখল অভিযানে মৃত্যু হয় 13 জনের । আহত হয়েছিলেন প্রায় 70 হাজার মানুষ । সে দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জনবাবুর আক্ষেপ, "আমার সঙ্গে থানা দখল অভিযানে গিয়ে ভোলানাথ মাইতি ও হরিচরণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন । ওনারা দু'জনেই হতদরিদ্র ছিলেন । সে দিন আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমি কেন মরলাম না ? ওনাদের বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেব ? শুধুমাত্র ভোলানাথের মৃতদেহ পেয়েছিলাম । বাকি অনেকের মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে গেছিল । "

দেখুন ভিডিয়ো

এরপরই ডিসেম্বরের 17 তারিখ তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত । স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুশীলকুমার ধাড়া । অজয় মুখোপাধ্যায় ছিলেন অর্থমন্ত্রী । পুরো সরকারটাই গোপনে চালানো হত । ব্রিটিশ পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও কাউকে ধরতে পারেনি । কারণ সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল । ব্রিটিশ পুলিশ যাদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করত তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এই সরকার । চিত্তরঞ্জনবাবু জানান, লব খাঁ নামে এক ডাকাতের কথা । লব খাঁ ব্রিটিশ পুলিশের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত । তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে সে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানিয়েছিল জাতীয় সরকারের কাছে । পরে এই লব খাঁ-কেই চাপ দিয়ে পুলিশ 44 জনের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে । তিনি ও তাঁর দাদাও সেই কেসের আসামি ছিলেন । পুলিশি ধরপাকড় থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করেছিলেন তাঁরা । তবে বয়স কম থাকায় তাঁর নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ।

তিনি আরও জানান, তাঁদের আশা ছিল নেতাজির সঙ্গে যোগ দেবেন । কারণ তখন নেতাজি মণিপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন । কিন্তু গান্ধিজি যখন খবর পান সহিংস পথে আন্দোলন করে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , তিনি সরকার ভেঙে দিতে বলেন । 1944 সালের 30 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র 21 মাস সক্রিয় ছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ।

মহাত্মা গান্ধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন । 73 বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালতে ভারতের পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান । এর মধ্যেই সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্ব নারকেলদহ গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এক গোপন বৈঠক করেন । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ব্রিটিশ শাসন অস্বীকার করে নতুন স্বাধীন সরকার গঠন করা হবে ।

মহিষাদল, 15 অগাস্ট : সালটা 1942 । ডিসেম্বরের 17 তারিখ পরাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সরকার । তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত । সেই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন মহিষাদলের স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত । ঘুমের মধ্যে আজও কানে বাজে গুলিবিদ্ধ সতীর্থদের আর্তনাদ । 73 তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ETV ভারতকে জানালেন কী হয়েছিল 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর ।

মহিষাদলের কালিকাকুণ্ডু গ্রামে ছিল চিত্তরঞ্জনবাবুর বাড়ি । তখন নবম শ্রেণিতে পড়েন । গান্ধিজীর ডাকে সাড়া দিয়ে অগাস্ট আন্দোলনের শরিক হন । বাবা হরিরাম সামন্ত । পেশায় শিক্ষক ও কংগ্রেস কর্মী । বাবার সহকর্মী সুশীলকুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত । তাঁদের সঙ্গে প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন । এখন বয়স 96 । শরীরে সেই জোর নেই । কিন্তু চোখে আজও সেই তেজ । মনে সাহস ।

একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । অন্যদিকে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী দেশের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছে । গান্ধিজিও ইংরেজ 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন । এই সময় আন্দোলনের গতি রুখতে ব্রিটিশ সরকার ঘর পোড়া নীতি নেয় । ভয়, নেতাজি যদি পৌঁছে যায় তাহলেই বিপদ । তাই আগেভাগেই তারা সাইকেল, গোরুর গাড়ি, নৌকা সব তুলে নিতে শুরু করে । খাদ্যশস্য, সবজি সিজ় করে । সে সময় ব্রিটিশ বাহিনীকে রুখতে থানা দখলের নির্দেশ আসে । নির্দেশ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত । ঠিক হয় 29 সেপ্টেম্বর মহিষাদল থানা দখল করা হবে । তমলুকের ছ'টি থানার মধ্যে মহিষাদল থানা দখলের দায়িত্বে ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু । তাঁর দাদা ছিলেন সুতাহাটা থানা দখলের দায়িত্বে । আগের দিন রাতেই পুলিশ বা মিলিটারি যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে, বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখা হয় রাস্তায় । 29 তারিখের মিছিলে চিত্তরঞ্জনবাবুর সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন ধনী- দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় 40 থেকে 50 হাজার মানুষ । মিছিল মহিষাদল রাজবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায়, সে সময় হঠাৎ করে গুলি চালানো শুরু করে পুলিশ । ভোলানাথ মাইতির বুকে প্রথম গুলি লাগে । তাঁকে কোনওরকমে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । তবুও দমে না গিয়ে মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান চিত্তরঞ্জনবাবু । এরপর একে একে গুলিবিদ্ধ হন হরিচরণ দাস, বটু মাইতিরা । পুলিশের গুলি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ঢাল হিসেবে টিনের কপাট সামনে রেখে এগিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা । কপাট ভেদ করে গুলি লাগে সাধারণ মানুষের গায়ে । ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল । সে দিনের সেই থানা দখল অভিযানে মৃত্যু হয় 13 জনের । আহত হয়েছিলেন প্রায় 70 হাজার মানুষ । সে দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জনবাবুর আক্ষেপ, "আমার সঙ্গে থানা দখল অভিযানে গিয়ে ভোলানাথ মাইতি ও হরিচরণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন । ওনারা দু'জনেই হতদরিদ্র ছিলেন । সে দিন আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমি কেন মরলাম না ? ওনাদের বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেব ? শুধুমাত্র ভোলানাথের মৃতদেহ পেয়েছিলাম । বাকি অনেকের মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে গেছিল । "

দেখুন ভিডিয়ো

এরপরই ডিসেম্বরের 17 তারিখ তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত । স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুশীলকুমার ধাড়া । অজয় মুখোপাধ্যায় ছিলেন অর্থমন্ত্রী । পুরো সরকারটাই গোপনে চালানো হত । ব্রিটিশ পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও কাউকে ধরতে পারেনি । কারণ সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল । ব্রিটিশ পুলিশ যাদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করত তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এই সরকার । চিত্তরঞ্জনবাবু জানান, লব খাঁ নামে এক ডাকাতের কথা । লব খাঁ ব্রিটিশ পুলিশের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত । তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে সে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানিয়েছিল জাতীয় সরকারের কাছে । পরে এই লব খাঁ-কেই চাপ দিয়ে পুলিশ 44 জনের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে । তিনি ও তাঁর দাদাও সেই কেসের আসামি ছিলেন । পুলিশি ধরপাকড় থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করেছিলেন তাঁরা । তবে বয়স কম থাকায় তাঁর নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ।

তিনি আরও জানান, তাঁদের আশা ছিল নেতাজির সঙ্গে যোগ দেবেন । কারণ তখন নেতাজি মণিপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন । কিন্তু গান্ধিজি যখন খবর পান সহিংস পথে আন্দোলন করে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , তিনি সরকার ভেঙে দিতে বলেন । 1944 সালের 30 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র 21 মাস সক্রিয় ছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ।

মহাত্মা গান্ধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন । 73 বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালতে ভারতের পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান । এর মধ্যেই সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্ব নারকেলদহ গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এক গোপন বৈঠক করেন । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ব্রিটিশ শাসন অস্বীকার করে নতুন স্বাধীন সরকার গঠন করা হবে ।

Intro:মহিষাদল,১৪ আগস্ট: পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে প্রথম জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল তমলুকে। সেদিনের বিদ্যুৎ বাহিনীর সক্রিয়তায় ও মহিলাদের প্রতি চরম অত্যাচার ও ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গড়ে উঠেছিল ঐতিহাসিক তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। লক্ষ্য ছিল সসস্ত্র বিপ্লবের কাণ্ডারী নেতাজীর স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হওয়া। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গান্ধিজীর নির্দেশে ভেঙে দিতে হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। তাই আজও এই আফসোষের মধ্যে জীবনের অন্তিমকালেও দুচোখের পাতা এক করে ঘুমোতে পারছেন না তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম যোদ্ধা তথা মহিষাদলের স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত। ঘুমের মধ্যে আজও সতীর্থদের গুলি বিদ্ধ আর্তনাদ কানে বাজে চিত্তরঞ্জনবাবুর। কাশ্মীর বিতর্কের মাঝেই দেশের ৭৩তম স্বাধীনতা দিবসের প্রক্কালে ইটিভি ভারতের মুখোমুখি হয়ে একান্ত সাক্ষাতকারে এমন বিতর্ক উসকে দিলেন তমলুকের এই স্বাধিনতী সংগ্রামী। স্মৃতিচারণ করলেন ১৯৪২ এর ২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মহিষাদল থানা দখলের রোমহর্ষক কাহিনী।
মহিষাদলের কালিকাকুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দা সেদিনের সেই একরত্তি ছেলে চিত্তবাবু। নবম শ্রেণির এই ছাত্র সেদিন গান্ধিজীর ডাকে সাড়া দিয়ে আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাবা হরিরাম সমন্ত ছিলেন পেশায় শিক্ষক ও কংগ্রেস কর্মী। বাবার সহকর্মী হিসেবে সুশীলকুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, শতীশচন্দ্র সামন্তের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রবল পরাক্রমী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছিলেন ওই একরত্তির ছেলেটি। বর্তমানে তাঁর বয়স গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬তে। শরীরিক নানান প্রতিবন্ধকতা সত্বেও মনের দিক থেকে আজও তিনি তরুণ যুবক।
Body:তাঁর কথায়, ৪২ এর আগষ্ট বিপ্লব ছিল গান্ধীজীর শেষ সংগ্রাম। গান্ধীজীর নির্দেশ মতোই এই সংগ্রাম চলত। গান্ধীজী যখন বললেন এটাই আমার শেষ সংগ্রাম তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ভারতের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছে। ব্রিটিশ এর ধারণা হয়েছিল এবার নেতাজি বোধহয় এসে যাবে। তাই তারা ঘর পোড়া নীতি নিয়েছিল। যদি এসে যায় তাহলেই বিপদ তাই ইংরেজরা সাইকেল, গরুর গাড়ি নৌকো সব তুলে নেওয়া শুরু করেছিল। ধান চাল সব সিজ করতে চেয়েছিল। সে সময় ব্রিটিশদের রুখতে ২৯ শে সেপ্টেম্বর থানা দখলের নির্দেশ এল স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ সামন্ত এর কাছ থেকে। তমলুক এলাকায় ছটি থানা ছিল আমি মহিষাদল থানা দখলের দায়িত্বে ছিলাম আমার দাদা সুতাহাটা থানা দখলের দায়িত্বে ছিল। বকশি চক গ্রামের প্রতিবেশী দের নিয়ে আমি থানা দখলের উদ্দেশ্যে মিছিলে নিয়ে যাই। ২৯ সেপ্টেম্বর এর আগের দিন রাতে পুলিশ মিলিটারিরা যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে তাই দিকে দিকে রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলে দেওয়া হয় ক্যালভার্ট গুলিকে ভেঙে দেওয়া হয় পুলিশদের আটকে দেওয়ার জন্য। মিছিলে প্রচুর দরিদ্র  মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আমার সঙ্গী হয়েছিল সেদিন। মিছিল যে সময় মহিষাদল রাজবাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো হঠাৎ করে পুলিশ গুলি চালানো শুরু করলো। আমার সৌভাগ্য আমি যে মিছিলটা নিয়ে গিয়েছিলাম মহামিছিলের সামনে স্থান পেয়েছিল। আমার এক সঙ্গী ভোলা নাথ মাইতির বুকে গুলি লাগে। গুলি লাগা মাত্রই ও সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। ওর গুলিবিদ্ধদেহ কোনরকমে আমরা তুলে নিই। আমরা তাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। এতেও আমরা দমে যায়নি আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ফের গুলি ছোড়া শুরু করে পুলিশ। গুলি লাগে শ্রী হরিচরণ দাস ও বটু  মাইতির। অন্য এক দিক থেকে সুশীল ধাড়া আরেকটি বিশাল মিছিল নিয়ে মহিষাদল থানার দিকে আসছিলেন। থানা দখলের উদ্দেশ্যে সুশীল বাবু আগে থেকেই একটি বিদ্যুৎ বাহিনী তৈরি করেছিলেন। বাহিনীটি আগে থেকেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিল। বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল গুলি লাগলেও থেমে যাওয়া যাবে না। গতি কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না। যার গুলি লাগবে সে সেখানেই থেকে যাবে। বাকিরা এগিয়ে যাবে। দু'দিকের খবরা খবর জানার জন্য গোয়েন্দা  ছিল আমাদের। সেদিন পুলিশের বিরুদ্ধে থানা দখল অভিযানে প্রায় ৪০-৫০ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। পুলিশ একের পর এক গুলি চালানো শুরু করলে ঢাল হিসেবে টিনের কপাট সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে বিপ্লবীরা। গুলি কপাট ভেদ করে মানুষের গায়ে লাগে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মানুষ। থানা দখলে গিয়ে মারা গিয়েছিল ১৩ জন প্রায় ৭০ জন মানুষ আহত হয়েছিল। বহু জনের মুখে ও পায়ে গুলি লাগে। আমার সাথে থানা দখল অভিযানে গিয়ে ভোলানাথ মাইতি ও শ্রী হরি চরণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিল। ওরা দুজনেই একেবারে হতদরিদ্র ছিল। সেদিন বারবার আমার মনে হচ্ছিল আমি কেন মরলাম না। এতজন যে মারা গেল এদের পরিবার বা কিভাবে চলবে। ওদের বাড়িতে গিয়ে কি জবাব দেব। এসব ভেবেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। শুধুমাত্র ভোলানাথের মৃতদেহ পেয়েছিলাম বাকি অনেক এর মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন। এর পরেই ১৭ ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার রুখে দেওয়ার জন্য তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্যাচার ও নারীদের ওপর পুলিশি ধর্ষণ রুখে দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ বাহিনী ও নারী বাহিনী নতুন করে তৈরি করা হলো। জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুশীল ধাড়া। অজয় বাবু অর্থমন্ত্রী। পুরো সরকার টাই চলত গোপনে। ব্রিটিশ পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। কারণ প্রতিটি মানুষ এই সরকারের পাশে ছিল। আর এই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারই প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ তাদের তথ্য জানার জন্য কাদের স্পাই হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের ধরে বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে অঙ্গচ্ছেদন এমনকি প্রাণনাশেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। মহিষাদল এলাকায় পুলিশের স্পাই হিসেবে কাজ করতো লব খাঁ নামের এক দুর্ধর্ষ ডাকাত। তাকে ধরে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি দিয়েছিল জাতীয় সরকার। তাঁর প্রাণভিক্ষার আবেদন মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে দুটি চোখ পিন দিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও লব খাঁ জানিয়েছিল আমি কোন অভিযোগ করবো না। পরে পুলিশের আইবিরা এসে তার কাছ থেকে অভিযোগ নিয়ে ৪৪ জন বিপ্লবী কে আসামি করা হয়েছিল। আমি ও আমার দাদা সেই কেসের আসামি ছিলাম। ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় চলছিল দীর্ঘদিন আমাদের কোনভাবেই ধরতে পারেনি পুলিশ। আমরা আত্মগোপন করে ছিলাম বাড়িতে এসে বাবার উপর অত্যাচার চালাত পুলিশ। একদিন রাতে আমি আমার দাদা বাড়িতেই ছিলাম। দাদা খুব অসুস্থ ছিল দুজনকে গ্রেপ্তার করতে এসে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পরে দাদাকে পুলিশের কাছে স্যারেন্ডার করাই। বয়স কম থাকার কারণে কয়েকদিন থানায় রেখে আমার নাম চার্জশীট থেকে বাদ দিয়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু এক সবের পরও গান্ধীজী আমাদের জাতীয় সরকার তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন। আর এতেই মনের দিক থেকে প্রচণ্ড ভাবেই ভেঙে পড়ি আমরা।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার আগে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র এই নামেই আমাদের জাতীয় সরকার চলছিল। আমরা যুক্ত হয়ে যেতে পারতাম নেতাজির সাথে। আমাদের খুব আশা ছিল নেতাজির সাথে যোগ দিয়ে দেব কারণ ভারতের পূর্ব প্রান্ত মনিপুর পর্যন্ত তিনি এসে গেছেন। কিন্তু গান্ধীজী যখন ব্রিটিশ ও কিছু কট্টর গান্ধীবাদী নেতাদের কাছ থেকে জানলেন অহিংসার পথে আন্দোলন না করে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তিনি আমাদের এই সরকার ভেঙে দিতে বলেন। এবং এই সরকার যাতে না চলে সে কারণে ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর গান্ধীজী তমলুক এসেছিলেন। গান্ধীজীর নির্দেশেই ২১ মাস সরকার চালানোর পর আমরা বাধ্য হই জাতীয় সরকার বন্ধ করতে। এখানকার জনগণ জাতীয় সরকার কে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। মন প্রাণ দিয়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গান্ধীজীর নির্দেশে তা বন্ধ করতে বাধ্য হই আমরা।Conclusion:উল্লেখ্য, মহাত্মা গাঁধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নানাদিক থেকে এসে তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন। ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধূ মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালতের উপরে ভারতের ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান।
এইসব ঘটনার মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্ব নারকেলদহ গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এক গোপন বৈঠক করেন। সেই বৈঠকেই ইংরেজেদের শাসন অস্বীকার করে নতুন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয়। সর্বাধিনায়ক হন বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত। এই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী গঠিত হয়। এই জাতীয় সরকার সে সময় পৃথক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, প্রচার, সমর ইত্যাদি বিভাগে পৃথক পৃথক সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল। সবার উপরে ছিলেন সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত। অর্থসচিব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় এবং সমর ও স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন সুশীলকুমার ধাড়া। ১৯৪৪ সালে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব।
Last Updated : Aug 18, 2019, 7:27 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.