পূর্ব বর্ধমান, 23 ডিসেম্বর: 23 ডিসেম্বর দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় কৃষক দিবস ৷ মূলত কৃষকদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতেই এই কিষাণ দিবস পালন করা হয় । কিন্তু যাদের জন্য এই দিবস উদযাপন, সেই কৃষকরা কেমন আছেন; খোঁজ নিল ইটিভি ভারত ।
27 এপ্রিল 2023 তারিখে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হয় স্বপন মণ্ডল নামে এক চাষির । তার বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার বড়শুলের অন্নদাপল্লী এলাকায় । তার পরিবারের দাবি আলু ও ধান চাষে ক্ষতির কারণেই তিনি বিষ পান করে আত্মঘাতী হন ।
9 ডিসেম্বর 2023 তারিখে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আলুর জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন এক আলুচাষি । তার নাম রূপসনাতন ঘোষ (45)। তার বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী 2 ব্লকের নিমদহ পঞ্চায়েতের ছাতনি উত্তরপাড়া এলাকায় । পরিবারের অভিযোগ বাজার থেকে ঋণ নিয়ে তিনি আলু চাষ করেছিলেন । প্রাকৃতিক দুর্যোগে আলুর জমিতে জল জমে যায় । নষ্ট হয়ে যায় আলুর গাছ । ক্ষতি সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মঘাতী হন ।
কৃষকদের মতে, চিত্রটা শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলায় নয় । রাজ্যজুড়ে কৃষক আত্মহত্যার একই ছবি দেখা যাচ্ছে । চলতি ডিসেম্বর মাসেই পূর্ব বর্ধমান ছাড়াও হুগলির খানাকুল ও পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় চাষির আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে । যদিও কৃষিমন্ত্রীর দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের জন্য যে বন্দোবস্ত করেছেন তারপর আর কৃষকদের আত্মহত্যার কোন সুযোগই নেই । মন্ত্রীর মত ছিল, কয়েক জায়গায় কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনাকে কৃষকের আত্মহত্যা বলে দেখানো হচ্ছে ।
নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, "রাজ্য সরকার যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা কৃষকদের জন্য রেখেছে তাতে কোন কৃষক আত্মঘাতী হওয়ার কথা নয় । বিজেপি যেহেতু কৃষি আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে সেটাকে ম্যানুপুলেট করার চেষ্টা করছে । "
শুধু তাই নয় বেশ কয়েকবার মুখ্যমন্ত্রীও বর্ধমানে এসে কৃষকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের যে কোনও কৃষকের থেকে আমাদের কৃষকেরা গর্বে থাকেন, ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন ।
কিন্তু কৃষকেরা বলছেন চাষ করা মানেই ঝুঁকি থেকেই যায়। বেশি ফলন হলেও কৃষকেরা লাভের মুখ দেখে না আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হলে তো কথাই নেই । ক্ষতিপূরণের টাকা মেলেনা ৷ অথচ পূর্ব বর্ধমান জেলার শীতকালীন অর্থনীতি অনেকটাই আলু চাষের উপরে নির্ভরশীল । চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে 67 হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছিল । মূলত জ্যোতি আলুর পাশাপাশি পোখরাজ, এস এস এস ওয়ান কিংবা কুফরি জাতের আলুর ফলন ভালো হয়েছিল ৷ চাষিদের আশা থাকে ভালো ফলন হলে বিঘা প্রতি জমিতে 90 থেকে 120 বস্তা আলু পাওয়া যায় । চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিঘা প্রতি জমিতে 70 থেকে 80 বস্তা আলু মিলেছিল । কিন্তু ভালো ফলন হলেও মেলেনি দাম । কারণ আলু বীজ থেকে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গোবর সার, অনুখাদ্য কিংবা শ্রমিক খরচ অনেক বেশি লেগেছিল । ফলে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় ।
শুধু তাই নয় বিগত বছর দুয়েক ধরে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে ধান কিংবা আলুর ফলন ভালো হয়নি । আলুর গুণগত মান ভালো না হওয়ায় চাষিরা আলু হিমঘরে রাখলেও দাম পাননি । পাশাপাশি ধানের ক্ষেত্রেও ভিন রাজ্যে ধান বিক্রি করতে গিয়ে দাম না মেলায় কম দামে খোলা বাজারে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকেরা । লাভের মুখ দেখতে পাননি ।
কৃষক সরিফুল মল্লিক বলেন, "ধান কিংবা আলু কোন চাষ করেই আজ শান্তি নেই । হয় অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি বারবার ক্ষতির মুখেই পড়তে হয় । সেই সঙ্গে জল কিনতে হচ্ছে,বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে । কৃষি ঋণ নিয়ে চাষ করছি । ফসলের দাম পাচ্ছি না । সার কিংবা কীটনাশকের দাম দিনে দিনে বেড়েই চলেছে । বাড়ছে লেবার খরচও । আমরা চাষিরা বাঁচবো কীভাবে । আর এই ক্ষতি সহ্য করতে না পেরেই চাষিরা আত্মহত্যা করছে । আবার চাষে ক্ষতি হলেও আমরা ক্ষতিপূরণ পাই না । ক্ষতিপূরণের টাকা আসছে । একশ্রেণির মানুষ সেই টাকা লুটে খায় ।"
কৃষক কাদের খান বলেন, "আমাদের চাষ করতে হয় তাই করি । কৃষকেরা লাভের মুখ দেখে না । আলু কিংবা ধান কিংবা সবজি যাই চাষ করি না কেন ক্ষতির মুখেই পড়তে হয় । জল কিনে আজ চাষ করতে হয় । বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে । আবার বলছে ডিভিসি চাষের জন্য জল দিলেও প্রয়োজনীয় জল পাওয়া যাবে না । ফলে আবার জল কিনতে হবে । এই তো চাষিদের অবস্থা । অথচ মহাজনের কাছে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করেছি । সারের, কীটনাশকের দাম বাড়ছে । ফলে ক্ষতির মুখেই পড়তে হচ্ছে । অনেক চাষি ক্ষতির বিষয় মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন ।
কৃষি ও কৃষক বাঁচাও কমিটির পূর্ব বর্ধমানের জেলা সম্পাদক অনিরুদ্ধ কুণ্ডু বলেন, "কৃষক দিবসে কৃষক আত্মত্যাগ নয় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন । আজ কৃষকদের অবস্থা খুব শোচনীয় । কৃষকেরা ঋণে জর্জরিত । কেন্দ্রীয় রিপোর্ট বলছে, কৃষিঋণ শোধ করতে না পেরে বেশিরভাগ চাষি আত্মহত্যা করছেন । সরকারের উচিত কৃষি ঋণ মকুব করা । সাম্প্রতিক যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ গেল সেখানে পূর্ব বর্ধমান জেলার বহু জায়গায় ক্ষতি হয়েছে । এখনও পর্যন্ত সরকার কোনও ক্ষতিপূরণের টাকা ঘোষণা করেনি । আবার বোরো চাষ শুরু হবে । অথচ পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই । চাষের খরচ বাড়ছে । এই অবস্থায় চাষিদের আত্মত্যাগ নয় আত্মহত্যার দিন হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত দিনটা ।"
আরও পড়ুন: